ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

সবুজ জমিনে লাল বিউটি

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ৩১ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সবুজ জমিনে লাল বিউটি

জাফর সোহেল : গত বছর এমন শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে এমনকি বৈশ্বিক মিডিয়ারও নজর পড়েছিল সিলেট অঞ্চলের হাওরগুলোর ওপর। কতিপয় দুষ্টু লোক কর্তৃক বাঁধ নির্মাণে এদিক-সেদিক করে পকেট ভারী করার পরিণামে নিঃস্ব হয়ে যায় সেখানকার হাজার মানুষ। সেই বিপদ এখনো কাটেনি। এবারও তার প্রতিচিত্র দেখা যাবে কি না সে জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। তবে এরই মধ্যে আরেকবার হাওর চলে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রে। ফেসবুক-টুইটার হয়ে হাওর চলে গেছে দুনিয়ার মানুষের কাছে। মানুষ অবাক চোখে দেখছে, হাওরের সবুজ বুকে একখণ্ড লাল বাংলাদেশ শুয়ে আছে। সেই বাংলাদেশ নিষ্প্রাণ। সেই বাংলাদেশ বোবা, অন্ধ, অসার।

সবুজ ধানের ক্ষেতে বিউটি আক্তার নামে লাল টুকটুক কিশোরীর অসার দেহ আমরা দেখেছি। অর্জনের পর অর্জনের পেছনে ধাবমান এই বাংলাদেশ জানে না, একইসঙ্গে সে ডুবন্তপ্রায় অন্ধকার গহ্বরে। কী হচ্ছে এই বাংলাদেশে? সেকি অর্জনের গরিমা দিয়ে চাপা দিতে চায় ব্যর্থতার দায়ভার? রাষ্ট্র বলছে, জঙ্গিবাদ সমস্ত অন্ধকারের মূল। তাই সে কাউন্টার টেরোরিজম বাহিনী গড়ে তুলেছে। সেই বাহিনী জঙ্গিবাদের দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান সব নাটের গুরুর নাকে দড়ি দিয়ে ধরে আনছে। আমরা বাহবা দিচ্ছি। কিন্তু সামাজিক অবক্ষয়ের অন্ধকারে আমরা ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। এই অন্ধকার কতটা জেঁকে বসছে গোটা বাংলাদেশে তা কি এখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে পড়ছে না? এই অন্ধকার দূর করবে কোন বাহিনী?

‘উদ্দেশ্য বুঝেই নাকি কর্ম’- বাংলাদেশ তাহলে বুঝতেই পারছে না, তার উদ্দেশ্য কী, বিধেয় কী! একটি বৈষম্যহীন সমাজ উপহার পাওয়ার কথা বাংলার মানুষের। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষকে একটি ন্যায়ানুগ সমাজ ও রাষ্ট্র তিনি উপহার দেবেন। হাওরের বুকে পড়ে থাকা নিথর ‘বিউটি’ বলে, সেই ন্যায়ানুগ সমাজ ও রাষ্ট্র বাঙালি এখনো পায়নি। জীবিত থাকতে বিউটির প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারেনি এই রাষ্ট্র। মৃত বিউটি সেই ন্যায়বিচার কতটা পাবে তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। অথচ সত্য হলো এই, এত বছর পরে বাঙালি মনে করছিল, তারা বঙ্গবন্ধুর সেই ন্যায়ানুগ সমাজের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে; তারা চিন্তা করছিল আলোর উৎসব দিয়ে সমস্ত অন্ধকারকে চাপা দেবে, যেখানে তাদের সারথি হয়ে আছেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কন্যা। সুতরাং আশা আমরা করতে পারি।

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে। বাংলাদেশ তার উদ্দেশ্য ও বিধেয় ঠিকঠাক বুঝতে পারছে তো? দেশের পরিচালকেরা কোথাও ভুল করছেন না তো? তারা ঘনায়মান সব অন্ধকার ঠিক চিনতে পারছেন কি?   তারা উন্নয়নকে শুধু টাকা-পয়সা আর দালান-কোঠার পাল্লায় মাপার চেষ্টা করছেন; নৈতিক উন্নয়ন বলে যে একটা কিছু আছে তা তারা ভুলে যাচ্ছেন। জঙ্গিবাদ ছাড়াও সমাজের বুকে যে হরেক রকমের অন্ধকার বাসা বেঁধেছে তার হদিস এই রাষ্ট্রের অভিভাবকেরা পাচ্ছেন না। যদি পেতেন, তবে বিউটির ধর্ষক এতদিনে ধরা পড়ত। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি।

আমাদের জন্য সবচেয়ে আশহত বা বেদনাদায়ক হলো, জনগণ যা বুঝতে পারছে, রাষ্ট্র বুঝেও তা না বোঝার ভান করে আছে বা বুঝতে চাইছে না। রাজধানীতে গত ৭ মার্চ যে মেয়েটি নিগৃহীত হলো সে ব্যাপারেও এখন সবাই নীরব। বিধ্বস্ত অবস্থায় মেয়েটিকে উদ্ধার করেছিল রাজপথে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্য। তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। ফলে ধন্যবাদ পাবেন। অথচ, এখন শুনছি সেই পুলিশ সদস্যেরই নাকি হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে! নিঃসন্দেহে বছরের সেরা ‘জোক’ এটি। নিজেদের লোককেই খুঁজে পাচ্ছ না, মিছিলে থাকা জানোয়ারদের হদিস কীভাবে পাবে পুলিশ? উল্টো চিত্র দেখা গেল ইডেনছাত্রীর ঘটনায়। সেখানে ঐ ছাত্রীকে জোর করে বাসে আটকে রাখার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, সেই বাস খুঁজে বের করে চালক আর হেলপারকে ধরেছে পুলিশ। এ ঘটনায় আমরা কি বুঝব?

অনেকে আবার এই ঘটনাগুলোর পেছনে বহু রকম কারণ খুঁজে বের করছেন। সেসব কারণের কিছু কিছু হয়ত যুক্তির বিচারে টিকেও যাবে। অভিনেতা মোশাররফ করিমকে বিব্রত করতে উদ্ভুত ‘পোশাক তত্ত্ব’ অবশ্য ধোপে টিকবে না। কারণ পোশাক ধর্ষণের মূল কারণ না। তাহলে মূল কারণ কী? নীতি নির্ধারকদের উচিত বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সেগুলো খুঁজে বের করা। এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই ঘটনাগুলোকে উৎসাহিত করে। আমি বলব, ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর প্রতিকারে রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলা।

এমনিতেই সামাজিক কারণে ধর্ষণের পর নারী বা পরিবার থানায় গিয়ে মামলা করার সাহস পান না। মামলা হলেও পুলিশ ব্যবস্থা নেয় বাদি ও বিবাদির অর্থ-কড়ি আর সামাজিক অবস্থানের বিচারে।  এই বিরুদ্ধ পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। অন্যায় করে পার পাওয়ার সুখ যে একবার পায়, সে কেন বারবার একই সুখ লুফে নেবে না? যারা এই সুখ চোখে দেখে, তারাও তো ওঁত পেতে থাকবে এমন সুযোগের!

‘ব্যধিই সংক্রামক’ চিকিৎসা শাস্ত্র বলে। এখন দেখি, অন্যায়-অনাচারও সংক্রামক। এই সংক্রমণ আর ছড়াতে দেয়া যাবে না। রাষ্ট্র যদি জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে পারে তাহলে ধর্ষণের মতো ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করতে পারবে না কেন? উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকেই। এজন্য বেশি কিছু করতে হবে না। কেবল দেশের পুলিশ বাহিনীকে ‘জিরো টলারেন্স’ পালন করতে হবে। পুলিশ এর আগেও বিভিন্ন সময় যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে। তাদের কেবল পারতে চাইতে হবে। সেজন্য তাদের স্বাধীনতাও দিতে হবে। নেতা-নেত্রীর টেলিফোন বন্ধ করতে হবে। হয়ত এতে কিছু মিসফায়ার হবে। তবু, যে মহামারি রূপ পেয়েছে এই সামাজিক ব্যাধি, তা থেকে পরিত্রাণে, যাকে বলে ‘অলআউট অ্যাটাক’ তার বিকল্প দেখি না। 

লেখক : সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়