ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

সাবধান! রাজাধিরাজের আগমন

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২৩ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাবধান! রাজাধিরাজের আগমন

(ভিয়েতনামের পথে: ৩৬তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: ওয়াট চাইওয়ামানারাম দর্শন শেষে টিয়াপাখি টুকটুক এগিয়ে চলছে নতুন গন্তব্যে। আবারও নদীর কিনার ধরে পথ। বৃষ্টি ভেজা কালো পথে একমাত্র বাহণ আমাদের টিয়াপাখি। ডানে, বামে এবং নদীর ওপাড়ের ঘর বাড়ি আর গাছপালার মাঝ থেকে উপরের দিকে উঠে এসেছে অনেক মন্দির বা মঠের চূড়া। নদীতে ভাসছে সুদৃশ্য নৌকা। বৃদ্ধ চালক এক ধ্যানে চালিয়ে যাচ্ছেন। মুখে কথা নেই, সমস্ত মনোযোগ ওই রাস্তার উপর। বয়সের ভারে বুক থেকে উপরের অংশ সামান্য সামনের দিকে ঝুকে পরেছে। ইচ্ছা হলো তার সাথে অনেক কথা বলি। জানতে চাই সেই সহজ ও সচরাচর কথাগুলি- কত বছর হলো এই বাহণ চালাচ্ছেন, এটা কি তার নিজের না ভাড়ায় চালান, বাড়িতে আর কে কে আছে? আরও জানতে ইচ্ছে করছে, তার বাহণে তো কত দেশের কত রঙের মানুষ যাত্রী হয়ে আরোহণ করে তাদের মাঝ থেকে এমন কেউ কি আছে যে কোন কারণেই হোক যার কথা মনে পড়ে?

মনে মনে উচ্চারিত এই ইচ্ছা থেকে জন্ম নিল আরেক বাসনা। যদি তার বড়ি যেতে চাই তাহলে কি কিছুক্ষণের জন্য আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবেন? কাছ থেকে দেখতাম একটি থাই পরিবারের জীবনযাপন! অমনি হালকা এক ব্রেক কষার ধাক্কায় ভাবনার জাল ছিঁড়ে চুরমার হয়ে গেল। এসে পরেছি গাছপালা ঘেরা এক অতি মনোরম পরিবেশের মধ্যে। সম্মুখেই বুদ্ধের একটি শয়ন মূর্তি। ডান পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। স্নেহ আর ভালোবাসার কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ভিক্ষু-শ্রমণদের দিকে। মূর্তির মাথার কাছ থেকে অল্প ব্যবধানের পর সবুজ বৃক্ষ সারি। মূর্তিটি দেখে বোঝা যায় গায়ে সোনালী রং করা ছিল। এখন তার প্রায় সবটুকুই চটে গেছে। সিমেন্টের ঢালাই করা মূর্তির দৌর্ঘ প্রায় একশ ফুট। আশীর্বাদরত গৌতম বুদ্ধকে পাশে রেখে এগিয়ে গেলাম পেছনের দিকটায়। এখান থেকে শুরু অনেক দূর পর্যন্ত চুন-শুরকিতে লাল ইটের গাঁথুনি। প্রাচীরগুলি আজ আর নেই। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে কেবল ভিত্তিমূলের সমাহার। ঠিক তারই মাঝামাঝিতে একাকি দাঁড়ানো এক উঁচু মঠ। খানিকটা অযত্নেই আছে বলা যায়। চূড়ার ওপর আপন খেয়ালে গজে উঠেছে ডালপালা ছড়ানো ছোট্ট একটি গাছ, যেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ ফুলদানী।
 


এখানে বেশিক্ষণ দেরি না করে পরবর্তী যে জায়গাটি আমাদের আপেক্ষায় আছে সেখানে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসলাম। বৃদ্ধ আবারও গভীর মনোযোগে এগিয়ে চললেন নতুন কিছু দেখানোর উদ্দেশ্যে। সবুজ শ্যামলে ঘেরা নিরিবিলি পথ। কি অসাধারণ বৃক্ষ বিন্যাস! এনশিয়েন্ট রয়্যাল প্যালেস অ্যান্ড প্রিন্সেস সিনাকরিন্দ্রা মোমোরিয়াল পার্ক। এখানে রয়েছে একশ থেকে একশ ত্রিশ বছরের পুরনো বৃক্ষ। সুবিশাল বাগানে গুনে গুনে আটশ একুশটি পুতসা গাছ আছে। প্রতিটি গাছের উচ্চতা সাত থেক আট মিটার হবে এবং ঘের দেড় থেকে আড়াই মিটারের কম নয়। টিপটিপ বৃষ্টি এখনও ঝরছে। তাতে ভ্রমণে সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেও মন্দ লাগছে না। মাথার উপর এই ছাতা মেলে ধরতে হচ্ছে তো এই বুজে রাখতে হচ্ছে ব্যাগের মধ্যে। সামনের প্রবেশ পথ দিয়ে যেতে হবে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায়। বৃক্ষের ছায়া তলে টিকিট কাউন্টার। জনপ্রতি পঞ্চাশ বাথের বিনিময়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হলো। দর্শনার্থী বলতে এখন পর্যন্ত আমরা এবং হাতে গোনা দু’চার জন। প্রবেশ করতেই দেখা দিল ধূসর মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে তিনটি সুউচ্চ মঠ, যেন আকাশ ফুটো করে উঠে যাবে আরও উঁচুতে। চলার পথে ছোপ ছোপ পানি জমেছে। অনুচ্চ প্রাচীরের গলি পথ দিয়ে চলে এসেছি মঠ তিনটির কাছাকাছি। প্রাঙ্গনজুড়ে স্থাপনার ভাঙ্গা প্রাচীরের অংশবিশেষ ও দণ্ডায়মান কলাম। পাশেই ছাদ বিহীন বৃহৎ কাঠামোটির গঠন দেখে অনুমান করা যায় এক সময় এটি মন্দির ছিল।

ভাবতেই বিস্ময় লাগে, কোন এক সময় শতশত ভিক্ষু-শ্রমণের শান্ত-শৃঙ্খল পদচারণায় মুখোর থাকতো! আত্মশুদ্ধির আকাঙ্খা আর শান্তিময় একটি পৃথিবীর প্রত্যাশা হতো যাদের ধ্যান-জ্ঞান। অল্প ব্যবধানে পাশাপাশি দণ্ডায়মান মঠ তিনটি টিলার ওপর অবস্থিত। অত্র এলাকার ভূমিরূপ বলে দেয় এখানে কোন প্রাকৃতিক পাহাড়-টিলা থাকার কথা নয়। সে থেকে ধারণা করা যায় মঠগুলি নির্মাণে উঁচু টিলাটি কিতৃমভাবে তৈরি। মঠের চারদিকে চারটি করে ছোট দরজা। প্রতিটি দরজা থেকে নেমে এসেছে সিঁড়ি। বিশেষ করে দুই ধারের সিঁড়ি নেমে এসেছে একেবারে টিলার গোড়ায় সমতল ভূমিতে। দর্শনার্থীরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে আরোহণ করছে। আয়ুথায়ায় বোধহয় এর চেয়ে উঁচু মঠ আর গড়ে ওঠেনি। মূলত মঠ তিনটিকে কেন্দ্র করেই এই প্রাঙ্গনের বর্তমান যাবতীয় আয়োজন। এর আগের দুইটি জায়গায় দেখা মঠ এবং এখানকার মঠের গঠনগত ভিন্নতা আছে। হয়তোবা এই মঠ তিনটি পরবর্তী সময়ে নির্মিত। চারপাশে যে আরও অনেক মঠ আছে সেগুলির গঠন আবার একই রূপ নয়।
 


মেমোরিয়াল পার্ক ঘুরে দেখার সুবিধার্থে পথের ব্যবস্থা আছে। তার মধ্যে বেশিভাগ পথে বৃষ্টির পানি এবং গাছের ছায়ার কারণে শ্যাওলার পাতলা পড়ত জমে গেছে। খুব সাবধানে পা না রাখলে যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। মঠের পেছন দিকটাতে পানি জমে আরও পিচ্ছিল হয়ে আছে। সামনে আর যেতে পারব কি না সে নিয়ে দ্বিধায় আছি। এ পর্যায়ে দৃষ্টিকে চারদিক থেকে গুটিয়ে নিয়ে শুধু পায়ের দিকে নিয়োজিত করতে হলো। কারণ প্রতিটি কদমের আছে পিছলে পরার আশঙ্কা। অমনি কানের ধার দিয়ে উড়ে গেল ধপাস এক শব্দ। তাকিয়ে দেখি পিচ্ছিল পথের মাথায় চিৎ হয়ে পরে আছে এক পশ্চিমা ললনা। মুহূর্ত বাদেই খলবলিয়ে উঠল। ফল তাতে ভালো হলো না। আহারে, সুন্দর পোশাকে কাদা আর শ্যাওলার পলেস্তারা লেগে গেল! এমন আচমকা ছোটখাটো ঘটনায় হাসি পাওয়া মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। দুর্ঘটনায় পতিত ললনা ও তার অক্ষত সঙ্গীটি নিজেদের মুখোমুখি তাকিয়ে আপাতত তাই করছে। হাসি যে আমাদের পেল না তা নয় তবে সংবরণ করে দুঃখটাই প্রকাশ করলাম। এখানে বৌদ্ধ মূর্তির সংখ্যা হাতে গোনা তবে পরিস্থিতি ওয়াট চাইওয়ামানারামের চেয়ে ভালো নয়। প্রতিটিই ভাঙ্গা। সবচেয়ে বড় মূর্তির ভগ্নাংশের যতটুকু টিকে অছে তা থেকে অনুমান করা যায় এর উচ্চতা কম করে হলে চৌদ্দ-পনের ফুট ছিল। এমন নির্মাণ শৈলীর মূর্তি সচারচর চোখে পরে না। ইটের উপর ইট গেঁথে গড়ে তোলা বুদ্ধ মূর্তি। এমনভাবে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র হাঁটু মোড়ানো দুই পা এবং নিতম্ব অংশটুকুরই অস্তিত্ব রয়েছে। ঝড় তাহলে এখানেও বেরসিক খেলা খেলে গেছে। এই ধ্বংসলীলা বিষয়ক কৌতূহলকে শেষ পর্যন্ত আর মনের ভেতর আটকে রাখতে পারলাম না। টিকিট কাউন্টারসহ আরও দু’এক জনের শরণাপন্ন হলাম। কিন্তু কিছুই জানতে পেলাম না! শেষ অবধি ব্যর্থ হয়েই বের হয়ে আসতে হলো।
 


বাইরে সবুজে মোড়ানো পিচ ঢালা পথে এখন পর্যটকের বেশ আনাগোনা। এক সাথে কয়েকটি হাতি থপথপ করে এগিয়ে আসছে। হাতির গলায় ঝুলে থাকা টুংটাং ঘুন্টির শব্দসমগ্র যেন পৌঁছে দিল কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের সেই দিনগুলিতে। সৈন্য সজ্জিত রাজা বেরিয়েছেন রাজ্য ঘুরে দেখতে। লাল, নীল মখমলে সোনালী কারুকাজের আলোয়ান জড়ানো হাতির দল কিছুক্ষণ পরপর সুর তুলে স্বভাবসূলভ ডেকে যাচ্ছে। জানান দিচ্ছে সাবধান, রাজ্যাধিপতির আগমন ঘটছে! হ্যাঁ, আজও সুসজ্জিত হাতির দল আসছে তবে তাতে রাজা নেই। রাজার সেই অনুভূতি নেয়ার জন্য সৌখিন পর্যটক হাতির পিঠে চড়ে পার্কের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করানোর অথবা তার একটু স্বাদ দিতে এটি একটি চমৎকার বন্দোবস্ত। এই প্রথম টুকটুক চালক মুখ খুললেন। জানতে চাইলেন আমরা হাতিতে চড়তে চাই কি না। তার টিয়া পাখির সওয়ারী হতে পেরেই যে আমরা খুশি এই কথাটি বুঝাতে পেরে আমার যেমন ভালো লাগল তেমনি তিনিও খুশি হলেন। আয়ুথায়া ভ্রমণ এখানেই শেষ। চলে এসেছি বাসস্ট্যান্ডে। নিজ থেকেই ছাতা মেলে ধরে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। এই সেবাটুকু নিতে অনিচ্ছা থাকলেও তার মুখের দিকে তাকিয়ে না বলতে পারিনি। এটা আসলে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, যা তার অধিকার। তবে আমাকে রক্ষা করতে গিয়ে তার শরীরে যে কয় ফোঁটা বৃষ্টির পানি পরেছে তা এতটাই বেদনাদায়ক ছিল, কেবলই মনে হয়েছে বৃদ্ধের শরীরে নয় প্রতিটি ফোঁটা আমার মন থেকে বেরিয়ে আসা পরম শ্রদ্ধেয় কোন পাত্রে জমা হচ্ছে। মাইক্রোবাস প্রস্তুত, আর দুইজন যাত্রী হলেই ছেড়ে দেবে। বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মধ্য দিয়ে শুধু আয়ুথায়া নয় যেন থাইল্যান্ডের কাছ থেকেই বিদায় নিলাম।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়