ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

সুনামগঞ্জের অকুতোভয় কণ্ঠস্বর

মিনার মনসুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৫, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুনামগঞ্জের অকুতোভয় কণ্ঠস্বর

|| মিনার মনসুর ||

সব মৃত্যু শোকের নয়; কিছু কিছু মৃত্যু উদযাপনের। মহাকালের প্রেক্ষাপটে বিন্দুবৎ যে জীবন মানুষের- খুব কম মানুষই পারেন তার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে। যারা পারেন মৃত্যু তাদের কাছে পরাস্ত হয়। তাদের মৃত্যুও হয়ে ওঠে উদযাপনযোগ্য। দেহগত অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলেও তারা বেঁচে থাকেন আমজনতার হৃদয়ে। বাস্তবিকই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (৫ মে ১৯৪৬-৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) ছিলেন তেমনই একজন।

রাজনীতি অনেকেই করেন, করছেনও। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা এ যুগের রাজনীতিকদের কল্পনারও অগম্য। মৃত্যুর পর জাতীয় সংসদে এবং সংসদের বাইরে তাঁকে নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। নানাভাবে তাঁর মূল্যায়ন হচ্ছে। আরও হবে। তবে সবচেয়ে দামি ও খাঁটি কথাটি বলেছেন তাঁর নির্বাচনী এলাকা দিরাইয়ের ৫৫ বছর বয়সী আবদুল মতলিব। তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি করলেই মানুষের নেতা অওয়া যায় না। সেন বাবু আছলা সাধারণ মানুষের নেতা। তাইনের শরীরে মাটির গন্ধ আছিল। এর লাগি তাইন মানুষরে অত ভালোবাসতা।’

আবদুল মতলিব কোনো বোদ্ধা রাজনীতি বিশ্লেষক নন; একেবারেই নিখাদ কাদামাটির মানুষ। সে কারণেই আমরা তাঁকে চিনতে ভুল করলেও মতলিব করেননি।

দৃশ্যত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৭২ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অর্জন অনেক। দিরাইয়ের মতো দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া একটি এলাকা থেকে উঠে এসে তিনি যখন জাতীয় রাজনীতিতে আলো ছড়াচ্ছেন তখন স্বাধীনতার স্বপ্নে উত্তাল কিংবা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রের বড় অংশই অশিক্ষা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যসহ নানাবিধ অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সত্তরে নৌকার জোয়ারে যখন ভাসছিল দেশ তখন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (ন্যাপ) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। তার পর আরও ছয়বার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর গঠিত সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। দায়িত্ব পালন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা এবং সর্বশেষ আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে। সঙ্গত কারণেই তাঁর মৃত্যুর পর এসব বিষয়ই আলোচিত হচ্ছে গুরুত্বসহকারে।

বলা অনাবশ্যক যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের নজির আরও আছে। সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হওয়া কিংবা সরকারে ও সংসদে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার মাপকাঠি দিয়ে বিচার করলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রকৃত মূল্য নিরূপণ করা সম্ভব হবে না কখনোই। কারণ তার চেয়ে কম অগুরুত্বপূর্ণ অনেকেই তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৭০ সালে প্রথমবার যখন তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। পরবর্তী প্রায় অর্ধশতক ধরে জাতীয় রাজনীতির আলো কখনোই অপসৃত হয়নি তার অবয়ব থেকে। সেটা রাজনীতি যখন মুক্ত ছিল তখন যেমন, তেমনি রাজনীতিকে যখন সামরিক বুটের তলায় পিষ্ট করে বাক্সবন্দী করা হয় তখনো তার ব্যতিক্রম হয়নি। কীভাবে তা সম্ভব হলো? আমার বিশ্বাস, এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে প্রকৃত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে।

অনেকেই বলেছেন যে, সংসদ ও সুরঞ্জিত পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। কথাটি অযথার্থ নয়। তারা ছিলেন একে অপরের অলঙ্কারের মতো। একথা তো কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, পূর্ণচন্দ্রের মতো সংসদেই তিনি পূর্ণবিভায় উদ্ভাসিত হতেন। আবার সংসদও তার আসল জৌলুস খুঁজে পেত তাঁর সান্নিধ্যে। বস্তুত ভারতবিভাজনের প্রাক্কালে অবিভক্ত বাংলায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো গুণীজনদের হাত ধরে সংসদীয় রাজনীতি চর্চার যে স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি। সর্বশেষ প্রতিনিধি বললেও খুব একটা বাড়িয়ে বলা হয় না। কারণ জ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক রাজনীতিচর্চার যে-যুগ তা অস্তমিত হতে চলেছে।

শুধু যে সংবিধান ও সংসদীয় রীতিনীতি বিষয়ে সুপণ্ডিত ছিলেন তা-ই নয়, তিনি তার চর্চাও করতেন পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সঙ্গে। ফলে যখনই সংবিধান ও সংসদের মর্যাদার ওপর আঘাত এসেছে তিনি ফুঁসে উঠেছেন তৎক্ষণাৎ। এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুহত্যা পরবর্তীকালে যে হিসাবনিকাশ বা সুযোগসন্ধানী সতর্কতা রাজনীতিকদের চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন তার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে দ্বিধা করতেন না। তাঁর এ স্পষ্টবাদিতার কারণে রাষ্ট্রের প্রভাবশালী নানা মহল যে তাঁর ওপর খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন সে-আভাসও অস্পষ্ট ছিল না অনেকের কাছে। তিনিও তা জানতেন। কিন্তু পরোয়া করেননি। করেননি বলেই কখনোই তাঁর যথাযোগ্য আসনটি তিনি পাননি। এমনকি, এমত একটি আশঙ্কাও করা হয় যে, ক্ষমতার কুশীলবদের বিরাগভাজন হওয়ার কারণেই তাঁকে খুবই অমর্যাদার সঙ্গে মন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় নিতে হয়েছে।

হাওরবেষ্টিত শাল্লা-দিরাইয়ের মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণেই সম্ভবত তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা ও অকুতোভয় এক মানুষ। আবার তিনি যে আদর্শ ও ঐতিহ্য ধারণ করতেন নিজের ভেতরে এটা তার প্রভাবজাতও হতে পারে। সামরিক শাসকদের রক্তচোখ যেমন ভয় পাননি, তেমনি নিজের দল বা নেতাদেরও ছেড়ে কথা বলেননি। ফলে একদিক থেকে তিনি ছিলেন দলছুট একজন মানুষ। উপেক্ষিত হয়েছেন নানাভাবে। মৃত্যুর আগে এ-নিঃসঙ্গতা যে আরও প্রকট হয়েছিল তাও সবার জানা। তবে তিনি কখনোই শেকড়হীন মানুষ ছিলেন না। জনমানসে তার শেকড় কতটা পোক্ত ছিল সেটা বোঝার জন্যে আবদুল মতলিবের সাক্ষ্যই যথেষ্ট।

সন্দেহ নেই যে, এমন একটি যুগের অবসান হতে চলেছে, যে-যুগটি ছিল সত্যিকারের বড় মাপের মানুষের। নতুন একটি যুগের সূচনাও হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। তাক-লাগানো তথ্যপ্রযুক্তি ও বিত্তের পাশাপাশি এ যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী বামনাকৃতির মানুষ। মানুষ হিসেবে তারা লিলিপুট হলেও তাদের হাত-পা-নখ কিন্তু বেজায় বড় এবং চিতার মতোই শক্তিশালী। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তদের নেতা হওয়ার জন্যে দীর্ঘ কাদামাটির পথ পাড়ি দিয়ে ধরনা দিতে হয়েছে ঘরে ঘরে; মানুষের মন জয় করতে হয়েছে; অর্জন করতে হয়েছে জ্ঞান এবং স্বীকার করতে হয়েছে বিপুল আত্মত্যাগ। কিন্তু এ-যুগের নেতাদের এসবের কিছুই লাগে না। তাদের আছে আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ! তার নাম ক্ষমতা, তার নাম অর্থবিত্ত। এ চেরাগ দিয়ে তারা অসাধ্য সাধন করতে পারে!

তার অর্থ কি এই যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো বড় মাপের মানুষেরা লুপ্ত হয়ে যাবেন ডাইনোসরদের মতো? না, বরং উল্টোটাই হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। চেরাগধারী দৈত্যদের স্বরূপ যত উন্মোচিত হবে (যেমন হয়েছে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জসহ দেশের নানা স্থানে) দিগন্তবিস্তৃত হাকালুকির নীরব গর্জনের মতো তাদের শূন্যতা তত বেশি প্রকট হয়ে উঠবে। আর সবকিছু ছাপিয়ে হাওরের দুরন্ত বাতাসে ভেসে বেড়াবে অকুতোভয় এক কণ্ঠস্বর। দুর্যোগে-দুর্বিপাকে সেই কণ্ঠস্বরই পথ দেখাবে আবদুল মতলিবদের মতো দুর্গত-নিপীড়িত মানুষকে।


লেখক: কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়