ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

হোসেন আলীর বিড়াল সমাচার

হুমায়ূন কবির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হোসেন আলীর বিড়াল সমাচার

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

|| হুমায়ূন কবির ||

সারা ঘরের ভেতরে জানালা একটা দারুণ জায়গা। বিশেষ করে কিছু দেখার জন্য। আরো বিশেষ করে বলতে গেলে বৃষ্টি দেখার জন্য। কাছের জিনিসের সঙ্গে কেমন দূরত্ব বাজায় থাকে। বৃষ্টিতে না ভিজেও বৃষ্টি উপভোগ করা যায়। হোসেন আলী জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টিভেজা উঠান দেখছে। নিঃশব্দে বৃষ্টির ফোটা পরছে উঠানের লাউ গাছের পাতার ওপর। বৃষ্টির ফোটা পরার সাথে সাথে পাতাগুলো নরে উঠছে। জানালার নীল রং ভিজে পরিণত হয়েছে গাঢ় নীলে।
পান চিবোতে চিবোতে হোসেন আলী স্ত্রীকে বলল,‘এমন মেঘ হইতে থাকলে তো আইজ আর হাটে যাওন যাইবো না।’
‘আমি কি করুম। যাইবেন না।’
‘এমনে কতা কও ক্যান। মুখে কি আল্লায় রস কস কিছু দেয় নাই?’
‘হেইডা তারেই জিগান গা।’
‘পারলে কি জিগাইতাম না।’

তারপর দুইজনে চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। হোসেন আলী এই গ্রামের বিত্তবান ব্যক্তি। তার কথায় সবাই ওঠে-বসে। গ্রামের কোন কাজ তাকে ছাড়া হয় না। গরু বিয়াইলেও তাকে একটানা দশদিন দুধ দিতে হয়। ছাগলের বেলা দুইদিন। কারো মেয়ের বিয়ে হলে সেই হয় মধ্যমণি। কোন ঝগড়া হলে তার কাছে সবাই ছুটে আসে সমাধানের জন্য। কেউ তার ওপর কথা বলে না।
হোসেন আলী ঘরের এদিক-সেদিক তাকিয়ে বউকে জিজ্ঞাসা করে,‘হ্যা গো, আমার বিলাইডা কই?’
‘আমি কি জানি?’

কথা না বাড়িয়ে হোসেন আলী বিড়াল খুঁজতে থাকে। সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে তার আদরের বিড়ালের কোন হদিস না পেয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ছুটে অন্য ঘরে যায় খুঁজতে। এভাবে সারা বাড়ি খুঁজে বেড়ায় প্রিয় বিড়াল। কিন্তু কোথাও পায় না।
তার বউকে সে একটানা অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে থাকে। গালাগালি শুনে পাশের বাড়ির মতিন এসে হাজির হয়। ভয়ে ভয়ে সে জানতে চায়- ‘হুজুর কী হইছে?’
‘দেখ তোর চাচীর কামটা দেখ। আমাগো কোন পোলাপাইন নাই। একটা বিড়াল পালি হেইডাও ঠিকমত রাখতে পারে না। কই যাই বিলাইটা খুঁজতে?’
‘হুজুর আপনে চিন্তা কইরেন না। আমি সবাইরে কইতেছি।’
‘যা ক। দেখ পাস কিনা। ওরে ছাড়া আমার আবার একটুও ভাল লাগে না।’

মতিন বৃষ্টি অপেক্ষা করে চলে যায় মসজিদের দিকে। মাইকে ঘোষণা করে দেয় আমাদের হুজুর হোসেন আলীর বিড়াল হারিয়ে গেছে। সবাই যত দ্রুত সম্ভব চলে আসো বট তলায়।
সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সবাই হাজির হয়। হোসেন আলী কাদা-পানি অপেক্ষা করে বট-তলায় হাজির হলে সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সে ঘোষণা দেয়- ‘আমার বিলাই হারাই গেছে যে খুইজ্যা দিতে পারবা তাকে পুরস্কার দিমু।’
সবাই বুলেটের মত ছুটে চলে বিড়াল খুঁজতে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে সারা গ্রামময়। কোন জায়গা বাদ দেয় না। কয়েকজনকে পাশের গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষেতের মধ্যে অনেক পানি জমে গেছে বৃষ্টিতে। প্রায় হাঁটু পানি তো হবেই। যারা গেছে তাদের অনেক কষ্ট হয় পানি মাড়িয়ে হেঁটে অন্য গ্রামে যেতে। কিন্তু কিছু করার নাই- হুজুরের বিড়াল, খুঁজে দিতেই হবে।

বিড়াল খোঁজায় লোকজনের আগ্রহের কমতি না দেখে হোসেন আলী খুব খুশি হলেন। সে ঘরে বসে বসে পান খাচ্ছে। তার বউ রাগ করে আছে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসতে থাকল। কিন্তু কেউ কোন সন্ধান দিতে পারছিল না। সবাই ব্যর্থ।
সে চোখ বন্ধ করে আছে। পাশে মতিন। কোনো কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সে হোসেন আলীর দিকে তাকাচ্ছে। তখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বাড়ির উঠানের যেখানটায় পানি জমে আছে সেদিকে তাকালে বোঝা যায় বৃষ্টি থামেনি। খোলা আকাশের দিকে তাকালে অস্পষ্টভাবে বৃষ্টির প্রভাব ধরা পড়ে।

এক যুবককে আসতে দেখে মতিন কথা বলার মত একটি বিষয় পেয়ে বলে ওঠে, ‘হুজুর ঔ যে তারেক আসতেছে।’
সে চোখ খুলে। তারেকের অব্স্থা দেখে তার হাসি পেল। সারা গায়ে কাদা দিয়ে মাখামাখি। ভিজে চুপচুপ। কাছে এসে সে বলল, ‘হুজুর নয়নপুরে প্রত্যেকটা বাড়ি থেকে শুরু করে জঙ্গল-টঙ্গল যা আছে কোন কিছুই খুঁজতে...’
‘এত কথার দরকার কি? তুমি পাইছো নি সেইটা বল।’ কথা শেষ করতে না দিয়ে হোসেন আলী তার কাছে জানতে চায়।  
‘না। পাই নাই।’
‘ঠিক আছে, যাও।’

তারেক দুইপা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। হোসেন আলীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হুজুর আপনের একটা খবর আছে।’
‘কী খবর?’
‘না মানে,ইয়ে...’
‘তুমি মাইগ্যা নাকি। ইয়ে মানে কী?’
তারেক ভয় পেয়ে আমতা আমতা করে বলল,‘একটা মেয়ে পাওন গেছে।’
‘মেয়ে...’
‘হ্যাঁ। হুজুর মরা মেয়ে। মনে অয় কেউ মাইর্যা  জঙ্গলে ফালাই গেছে।’
‘ঠিক আছে তুমি যাও। আমি দেখতেছি ব্যাপারটা।’
‘ওই দাঁড়াও দাঁড়াও।’  তারেককে দাঁড়াতে বললে সে আবার ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়ায়।
‘কী হুজুর?’
‘লাশ কই রাখছ?’
‘বট-তলায়।’
‘ঠিক আছে যাও।’

হোসেন আলী খানিকক্ষণ নিজের মধ্যে অনেক কিছু ভাবতে থাকে। তারপর মোবাইল ফোনটা বের করে পুলিশকে ফোন করে জানিয়ে দেয় ঘটনা। পুলিশ বলে তারা খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
মতিনসহ সে বট-তলায় গিয়ে হাজির হয়। এখন আর বৃষ্টি হচ্ছে না। আকাশ নীল বর্ণ ধারণ করেছে। তবে সূর্য ডুবডুব অবস্থা। দারুণ দখিনা বাতাস বইছে। সবার শরীরে মৃদ ঠান্ডা হাওয়া ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। এমন সুন্দর পরিবেশেও বট-তলায় পুরোপুরি থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। মেয়েটির লাশ একটি খেজুর পাতার বিছানা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। তাই বোঝা যাচ্ছে না তার বয়স কেমন। মতিন বলল, ‘হুজুর মেয়েটার বয়স নাকি খুবই কম।’
‘কীভাবে মরছে কেউ কিছু বুঝছে?’
‘জহির কইল মেয়েটারে নাকি অত্যাচার কইরা মারছে। তার শরীরের কাপড় ছেড়া আছিল।’

হোসেন আলী কথা বলল না।  পুলিশ আসার অপেক্ষায় রইল। কেউ মেয়েটির বাড়ির খোঁজ নিবে কিনা ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন জানতে চাইলে সে বলল, ‘দরকার নাই। এইসব ব্যাপারে না যাওয়াই ভাল। পুলিশ আইস্যা নিয়া যাক আমাগো কাজ খতম।’
সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ রবে সায় দিল। হোসেন আলীর পাঞ্জাবি বাতাসের তোড়ে উড়ছে, সঙ্গে মৃদু উড়ছে দাঁড়ি। মাথার টুপিটা এখন সে হাতে নিয়ে বসে আছে চুপ মেরে।
আশপাশ থেকে শুধু ফিসফাস আওয়াজ ভেসে আসছে। সাথে বাতাসের হু হু শব্দ। বট গাছের পাতায় পাতায় ঘর্ষণের শব্দ।

প্রায় এক ঘণ্টা পর পুলিশ চলে এলো। হোসেন আলী পুলিশকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, তোরা কেউ মেয়েটিকে চেনে না। একইসঙ্গে সে বলে দিল মেয়েটিকে কে, কীভাবে কোথায় পেয়েছে। পুলিশ আর কথা না বাড়িয়ে লাশ ভ্যানে তুলে ফিরে গেল।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সবাই এবার যার যার বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু মতিন বলল, ‘সবাই কি হুজুরের বেড়ালের কথা ভুলে গেলা নাকি? আজকের মধ্যে খুঁইজ্যা আনো।’
সবাই কেমন যেন ঝিমিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ মুখে কোন টু-শব্দটি করল না। খালি একজন বলল,‘হুজুর রাইত অয়ে গেছে এহন কি আর পাওন যাইবো।’
‘বাতি নিয়া খুঁজো।’
যার যার বাড়ি থেকে রাতের খাবার খেয়ে হারিকেন, লাইট নিয়ে পুনরায় সবাই রাতে বিড়াল খুঁজতে বের হলো। কিন্তু পাওয়া গেল না। সবাই ঢুলুঢুলু চোখে ফিরে এলো। এবং এক সময় দরজায় খিল তুলে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে হোসেনের বউ চাঙ থেকে মুড়ির টিন নামাতে গিয়ে আবিষ্কার করল কালো ডোরা কাটা একটি বিড়াল। বিড়ালটির নাকের ওপর ভো ভো করে উড়ছে গোটা কয়েক মাছি।


লেখক :  মূলত গল্পকার এবং অনুবাদক। জন্ম ১৯৮৯, ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায়।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়