ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আমার দেখা টোকিও (পর্ব-৩)

পি.আর. প্ল্যাসিড, জাপান থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৫ এপ্রিল ২০২০   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমার দেখা টোকিও (পর্ব-৩)

৩. টোকিও টাওয়ার: টোকিও আসা মানেই যেন টোকিও টাওয়ার দেখা। যদিও একেক জনের ভিন্ন ধরনের সখ থাকে, সুতরাং আমার সখের সাথে অন্যদের মিল হবে না।

আমি ছাত্র থাকা অবস্থায় দেশে সময় সুযোগ পেলেই ভ্রমণ করেছি। টিউশনি করে টাকা জমিয়ে পশ্চিম বাংলা গিয়েছি ঘুরতে।  তাই ভ্রমণবিলাসী বলেই আমি জাপান এসে চাকরির মাঝে সাপ্তাহিক ছুটিগুলো কাজে লাগিয়েছি দর্শনীয় জায়গা দেখে।

দুই যুগের বেশি সময় আগে জাপানে আসার পর টোকিও টাওয়ার সম্পর্কে জেনেছিলাম। টোকিওর সাথে মিলিয়ে উচ্চতর স্ট্রাকচারের নামকরণ করা হয়েছে। টোকিও টাওয়ার আমার ঘুরে দেখার জন্য লোভনীয় জায়গাগুলোর তালিকায় এটিও ছিল।  দেশ থেকে পরিচিত কেউ জাপান বেড়াতে আসলে আমি তাদের এখনও টোকিও টাওয়ার দেখাতে নিয়ে যাই।

এক সময় আমাদের ছড়া সম্রাট লুৎফর রহমান রিটন জাপান বেড়াতে এলে তাঁকে আমার স্ত্রীসহ ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলাম টোকিও টাওয়ারে।  এরপর ডাকসুর এক সময়কার ভিপি আক্তারুজ্জামান ও তার পরিবারকে নিয়েও নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে। এমন অনেকেরই গাইড হয়েছি টোকিওর দর্শনীয় স্থান ঘুরে  দেখাতে।

আমরা সাধারণরা যাকে টোকিও টাওয়ার নামে চিনি, তার আরো একটি অফিসিয়াল নাম রয়েছে। যাকে জাপানি ভাষায় বলা হয়, নিপ্পন দেনপাতো আর ইংরেজিতে জাপান রেডিও টাওয়ার। এটি রাজধানী টোকিওর মিনাতো ওয়ার্ডের শিবা কোয়েন-এ অবস্থিত।

১৯৫৮ সালে এই টাওয়ারের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে।  এরপর একই সালের ২০ ডিসেম্বর সাধারণের জন্য টোকিও টাওয়ার খুলে দেওয়া হয়। ১,৫৫,৭৭,১৪৩ বর্গ মিটার জমির ওপর নির্মিত জাপানে সে সময় উচ্চতর এই স্ট্রাকচারটি নির্মাণে  মোট শ্রমিক কাজ করেছে ২১,৯,৩৩৫ জন এবং ব্যয় হয়েছিল ২.৮ বিলিয়ন ইয়েন যার মূল্য ইউ এস ডলারে ছিল ৮.৪ মিলিয়ন (১৯৫৮ সালের হিসাব)। টাওয়ারটি যিনি নির্মাণ করেছিলেন তিনি পেশায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, পাশাপাশি রাজনীতিও করতেন।  নাম তার মি. মায়েদা হিসাকিচি (সান)।

এ পর্যন্ত এই টাওয়ারে পর্যটক ভ্রমণ সংখ্যা ১৫০ মিলিয়নেরও বেশি।  নির্মাণকালে এটি ছিল পৃথিবীতে সবচেয়ে উচ্চতম টাওয়ার। বর্তমানে টাওয়ারটি উচ্চতার দিক দিয়ে জাপানেই দ্বিতীয় উচ্চতম। এর উচ্চতা ৩৩২.৯ মিটার বা ১০৯২ ফুট।  দেখতে এটি পুরোটাই ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের মতো। অ্যাভিয়েশন আইন অনুযায়ী আকাশযানের চলাচলে যেন সমস্যা না হয়, তাই এটি সাদা এবং কমলা রং দিয়ে রাঙানো হয়েছে।  প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এটিকে নতুন করে রঙ করা হয়।

টোকিও টাওয়ারের মূল আয়ের উৎস হচ্ছে পর্যটক এবং এনটিনা ভাড়া দেওয়া অর্থ।  ১৯৬১ সাল থেকে টিভি ব্রডকাস্টিং ও রেডিওর এনটিনার কাজে ব্যবহার করা শুরু করে। বর্তমানে জাপানের জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল, এন এইচ কে সহ টি বি এস, ফুজি টেলিভিশনের ব্রডকাস্টিং কাজে ব্যবহার করা হয়।

টাওয়ারের ভিতর নিচ তলায় রয়েছে বিভিন্ন জাপানিজ খাবারসহ জনপ্রিয় ফার্স্টফুড ম্যাগডোনাল্ডের দোকান।  ওপরে চার তলায় বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, রেস্টুরেন্ট, মিউজিয়ামসহ রয়েছে ছেলে-মেয়েদের বিনোদনের জন্য গেইম সেন্টার। এর ওপরে ১৫০ মিটার বা ৪৯০ ফুট উপরের তলায় পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানো ও ওপর থেকে টোকিও শহর দেখার ব্যবস্থা। চাইলে ইয়েন খরচ করে দুর্বীনের সাহায্যেও টোকিও শহর দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।  তার একটু উপরে আরেক তলা, উপরে গেলে আরো সুন্দর ও পরিষ্কারভাবে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।

নিচ থেকে টিকিট কেটে লিফটের মাধ্যমে ওপরে যাবার ব্যবস্থা রয়েছে। আবার সিঁড়ি দিয়ে হেঁটেও যাওয়া যায়।  ওপরে উঠতে ৬০০ কদম হাঁটতে বা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে হয়।  ২০১৮ সাল থেকে কাঁচের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে ১৪৫ মিটার থেকে নীচের অবস্থান দেখার সুবিধা করা হয়েছে। যাদের হার্টের সমস্যা তাদের সেখানে যাবার বিষয়টি সতর্ক করে দেওয়া হয়। সবাই সেখানে গিয়ে ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে দেখতে পারে না।  তাই দুর্বলচিত্তের পর্যটকরা সেখানে যাওয়া বিরত থাকেন।

আবহাওয়া ভালো থাকলে টাওয়ারের উপর থেকে পরিষ্কারভাবে ফুঁজি পাহাড়ও দেখতে পান।

জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যবহার করা বিভিন্ন যুদ্ধট্যাক্স যা যুদ্ধ শেষে অচল অবস্থায় পড়ে ছিল ওসব ট্যাংক।  ট্যাংক থেকে নেওয়া স্টিল দিয়ে এই টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে, যার উজন প্রায় ৪,০০০ টন।

জানা যায়, এই টাওয়ার প্রতি রাতে আলোকিত করতে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয় মোট ১৮০টি। যার খরচ প্রতি রাতে প্রায় ২১,০০০ থেকে ২১,০০০ ইয়েন (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকা)।

এ বছর জাপানে অলিম্পিক হবার কথা ছিল যদিও পৃথিবীতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট মহামারির কারণে তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা আগামী বছর অনুষ্ঠিত হবার কথা। অনুষ্ঠিতব্য সেই অলিম্পিক উপলক্ষে কিংবা এমনিতেই ভ্রমণ বিলাসী যারা বাংলাদেশ থেকে জাপান আসার পরিকল্পনা করছেন তারা একদিন অন্তত এই টোকিও টাওয়ার ঘুরে দেখার পরিকল্পনা করতে পারেন।

কাছাকাছি জে আর রেল স্টেশন হতে ইয়ামানোতে লাইন বা কেইহেনতকু লাইনের হামামাৎস্যু চ্যো স্টেশন রয়েছে। যেখান থেকে পায়ে হেঁটে প্রায় পনের  থেকে বিশ মিনিটের পথ এবং সাবওয়ে (আন্ডার গ্রাউন্ড) হিবিয়া লাইনের কামিয়া চ্যো স্টেশন থেকে সাত মিনিট মিতা লাইনের ওনারি মন স্টেশন থেকে ছয় মিনিট, তোয়েই ওয়েদো লাইনের আকাবানেবাশি স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিট সময় লাগে এই টোকিও টাওয়ারে আসতে।

পি.আর. প্ল্যাসিড:  জাপান প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক

পড়ুন

>>

>>

 

/সাইফ/

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়