বিপদ এখনও কাছেই আছে
কাজী জহিরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম
অনলাইন ক্লাসে লগ ইন করে বসে আছি, শিক্ষকের খবর নেই। অন্য সহপাঠীদেরও কোনো দেখা নেই। বিষয় কী? আমি কী ভুল ক্লাসে লগ ইন করলাম? ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাই। আবার লগ ইন করি।
না, কেউ নেই। শিক্ষকের নাম কিম নারে, কোরিয়ান তরুণী। আমার বড় মেয়ে জলের শ্রেণিশিক্ষক। জলের বয়স ষোল। ও একজন অটিস্টিক শিশু। কথা বলে না। শারিরীক কোনও সমস্যা নেই। একজন ষোল বছরের তরুণীর মতোই সুস্থ সবল। বেশ দীর্ঘাঙ্গিনীও। কিন্তু বুদ্ধি শিশুদের মতো। নিজের প্রয়োজনটাও অনেক সময় প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু খুব অভিমানী। যদি টের পায় কোনও বিষয়ে ওকে আমরা ততটা গুরুত্ব দিইনি, তাহলে কেঁদে একাকার করে ফেলে। এমন তো হবার কথা না।
কিম নারে খুব দায়িত্বশীল একজন শিক্ষিকা। আমি সঙ্গে সঙ্গে টেক্সট ম্যাসেজ পাঠাই। আজ কী ক্লাস নেই? সাথে সাথে উত্তর আসে। ‘আমি সবাইকে ইমেইলে জানিয়েছি, আমার পরিবারের একজন সদস্য মারা গেছেন। কিছুদিন ক্লাস নিতে পারবো না’। এই সময়ে কেউ মারা গেছেন শুনলেই, ঘাতক করোনাভাইরাস ছাড়া আর কিছুই মনে আসে না। বিকেলে জলের স্কুল থেকে ফোন আসে। ভাইস প্রিন্সিপাল জানান, কিম নারের একজন নিকটাত্বীয় করোনাভাইরাসে মারা গেছেন। দুদিন ও ক্লাস নিতে পারবে না। রোজ দুপুরে সহকারী শিক্ষক টনি ত্রিশ মিনিট জলের সাথে অনলাইনে কাজ করে। কাজ করে মানে ভিডিও দেখায়, গান শোনায়, গণনা করায়, এটা সেটা ছবি দেখায়। টনি জানালো কিমের শ্বশুর মারা গেছেন।
দুদিন শেষ পর্যন্ত পুরো সপ্তাহে গড়ায়। এক সপ্তাহ পরে সোমবারে কিম যথারীতি ক্লাসে আসে। ক্লাস মানে অনলাইনে টিমস সফটওয়ারের মাধ্যমে ক্লাস। জল যেহেতু একা এসব ম্যানেজ করতে পারে না তাই ওর সঙ্গে রোজ সকালে এক ঘণ্টা আমাকে বসতে হয়। মেয়ের সাথে আমিও ক্লাস করি।
মঙ্গলবার সকালে পাঁচ মিনিট আগে ক্লাসে ঢুকে দেখি কিমও আছে, আর কেউ তখনো যোগ দেয়নি। তখন সমবেদনা জানিয়ে জিজ্ঞেস করি, ঘটনা কী? কিম জানায় ওর শ্বশুর এমটিএ-র (নিউইয়র্কের বাস কোম্পানি) বাস ড্রাইভার ছিলেন। ওরা একই বাসায় থাকে। ওর শ্বশুরের প্রথম সংক্রমণ হয়, দুদিনের মধ্যেই ওর শ্বাশুড়ি এবং স্বামীও অসুস্থ হন। অ্যাম্বুলেন্সের সাথে প্যারামেডিক এসে দেখেশুনে বলে, তোমার তো বেশি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না। তুমি বাসায় থাকো। দুই সপ্তাহ বাসায় থেকে ওর শ্বশুর করোনার সাথে যুদ্ধ করেছে। এরপর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ততদিনে শ্বাশুড়ি এবং স্বামীর অবস্থার অবনতি ঘটলে ওদেরকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুজন সুস্থ হয়ে ফিরে এলেও শ্বশুর ফিরতে পারেননি। পাড়ি জমান এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো দুনিয়ায়। কিম জানায়, ভদ্রলোকের বয়স ষাট, সুঠাম দেহের অধিকারী, খুব করিৎকর্মা মানুষ ছিলেন। বাড়ির সব কনস্ট্রাকশনের কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। সবজির বাগান করতেন। অন্য কোনো অসুখ ছিল না তার। না ডায়াবেটিস, না হৃদরোগ, কিছুই না। সম্পূর্ণ নিরোগ একজন মানুষ ছিলেন।
কিমের কাছে বিস্তারিত শুনে আমি কিছুটা ঘাবড়ে যাই। আমার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড় একজন তরতাজা মানুষ, করোনার সাথে যুদ্ধ করে হেরে গেলেন! মে মাসের ৪ তারিখে কোরিয়ান এই ভদ্রলোক করোনায় মারা গেলেন। পরিসংখ্যান বলছে, মৃত্যু এবং সংক্রমণ দুইই কমে এসেছে। কিছু কিছু কর্মক্ষেত্রে নিউ ইয়র্কের লোকেরা যেতেও শুরু করেছে। আমরাও হাঁটতে বেরুচ্ছি, মাঝে মাঝে গ্রোসারি শপে যাচ্ছি। কিন্তু এই ঘটনা আমাদেরকে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা দিয়ে বলে দিল, সাবধান, যেভাবে চলছিলে সেভাবেই চলো, বিপদ এখনো কাছেই আছে।
এই ঘটনাটি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হলো, যারা সাবধানতায় কিছুটা ঢিলে দিয়েছেন তাদেরকে জোরেসোরে আরো একবার বলা, যেভাবে চলছিলেন সেভাবেই চলুন, ‘সাবধানের মার নেই’ প্রবাদটি মেনে চলাই এখনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এই সাবধানতা আমাদের ততদিন মেনে চলতে হবে যতদিন পর্যন্ত করোনা থেকে মুক্তির কার্যকর ওষুধ হাতের নাগালে না আসে।
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ১৩ মে ২০২০।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক
ঢাকা/সাইফ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন