ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এত খ্যাতি, পরিচিতি, এতটুকু কলঙ্ক নেই || রেজাউদ্দিন স্টালিন

রেজাউদ্দিন স্টালিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২২ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এত খ্যাতি, পরিচিতি, এতটুকু কলঙ্ক নেই || রেজাউদ্দিন স্টালিন

নায়করাজ রাজ্জাকের কথা মনে হলে আমার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। ২০০২ সাল। সে-বছর ‘চাওয়া পাওয়া’ অনুষ্ঠানের জন্য সাক্ষাৎকার  নেয়ার উদ্দেশ্যে আমি গিয়েছিলাম তার সাথে দেখা করতে। এফডিসিতে তিনি আমাকে সেই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি যখন সিনেমায় হিরো হিসেবে অভিনয় করেছিলেন, তখন সপরিবারে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে পারতাম। এখন সিনেমার যে অবস্থা তাতে সপরিবারে একসাথে সিনেমা দেখার অবস্থা নেই। এখন সামাজিক এবং শিল্পসম্মত ছবি আমরা পাচ্ছি না কেন?

তিনি উত্তরে বললেন, যাদের হাতে টাকা আছে, সিনেমায় বিনিয়োগ করে মুনাফা করতে চায়, তাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত। স্বাধীনতার পরে এই শ্রেণির লোকেদের কাছে টাকা আসার ফলে, চলচ্চিত্রে তারা তাদের ইচ্ছে মতো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের ইচ্ছে মতো পরিচালক দিয়ে ছবি করছে। ফলে মূল শিল্পীদের কদর কমে যাচ্ছে। সিনেমা হলগুলোর আয়ও কমে যাচ্ছে। তার মধ্য দিয়েও শিল্পসম্মত সিনেমা যে হচ্ছে না, তা নয়। হচ্ছে এবং আমরা অভিনয় করে যাচ্ছি।

সে-সময় আমি যে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলাম পুরো ঘটনা মনে না থাকলেও আরও একটি প্রশ্ন আমার মনে আছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোন সাহিত্যিকের লেখা আপনার পছন্দ? উত্তরে তিনি বলেছিলেন জহির রায়হান এবং শহীদুল্লাহ কায়সারের নাম। এরপর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের নামও স্মরণ করেছিলেন। কবি হিসেবে জীবনানন্দ দাশের কথাও বলেছিলেন। ঐ অনুষ্ঠানে অভিনেতা বুলবুল আহমদেরও সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছিলাম কিন্তু রাজ্জাকের বিশাল তারকাখ্যাতির কারণে তিনি বেশি হাইলাইটস হয়েছিলেন। আমি মনে করি সাধারণ মানুষের মনে তার অবস্থান এখনো অনড়। যে কারণে তাকে ‘নায়করাজ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। সে সময়ের বিখ্যাত বিনোদন পত্রিকা ‘চিত্রালী’র সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী তাকে এই উপাধি দিয়েছিলেন।

শুধু যে সারাজীবন অভিনয় করে গিয়েছেন তা নয়, তিনি সামাজিক অনেক দায়িত্ব পালন করেছেন। আমরা জানি যে, কিছুদিন আগে একজন চিত্রনায়িকার সংসার ভেঙে যাচ্ছিল, তিনি অসুস্থ অবস্থাতেও সেখানে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং অনেক সত্য উচ্চারণ করেছিলেন।  একবার রাজ্জাক সাহেবের সাথে আমার দেখা হয়েছিল কলকাতার অ্যাপোলো হসপিটালে। তিনি চিকিৎসা করানোর জন্য গিয়েছিলেন, আমিও ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। সেবার আমি মূলত ভারতে গিয়েছিলাম কলকাতা বইমেলার উদ্দেশ্যে। ওখানে আমাদের বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল। সে-সময়ে তাকে আমার ম্লান মনে হচ্ছিল। আমি এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আমার চেয়ে তোমার ভাবীর শরীর বেশি খারাপ- উচ্চ রক্তচাপ, এজন্য মন খারাপ।

এই বিষয়টি আমার মধ্যে একটি চিন্তার সূচনা ঘটায়। রাজ্জাক ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের তেমন পরিচয় নেই। তিনি মিডিয়াতেও আসেননি সেভাবে। কিন্তু একটানা এত বছর সংসার করে গেলেন কোনো উচ্চবাচ্য ছাড়া, পঞ্চাশেরও বেশি হওয়ার কথা তাদের সাংসারিক জীবন। অথচ আজকাল কোনো সেলিব্রেটি বিয়ে করলেই যাকে বিয়ে করে সেও সেলিব্রেটি হয়ে যায়। আবার দুদিন পর ঝগড়া- সংসার টেকে না। অথচ রাজ্জাক ভাই এই বিষয়টিতে কত বড় একজন আদর্শ। এত বড় একজন শিল্পী, এত খ্যাতি, এত পরিচিতি কিন্তু তাতে এতটুকু কলঙ্ক নেই। যেন ঝলমলে সাদা একটি ক্যারিয়ার। তার এই ব্যাপারগুলো আমাকে বেশ আকৃষ্ট করত।

তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল দু’বছর আগে। আমি পুনরায় একটি সাক্ষাৎকারের জন্য তাকে ফোন করেছিলাম। তিনি বাসায় যেতে বলেছিলেন। আমি গিয়েছিলাম। অনেক কথা বলেছিলেন। তার কাছ থেকে শেখার অনেক কিছু ছিল। আজ নায়করাজ রাজ্জাকের মতো একজন বড় অভিনেতাকে বাংলা সিনেমা হারাল। এত বড় একটি ক্ষতি কখনোই পূরণীয় নয়। আমি আশা করব, তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এবং বাংলা সিনেমার স্বর্ণালি যুগের সাথে আমাদের তরুণদের পরিচয় করিয়ে দিতে নতুন করে সিনেমা হলগুলোতে রাজ্জাক অভিনীত পুরোনো সিনেমাগুলো মাঝে মাঝে প্রদর্শিত হবে। তাতে করে এই কিংবদন্তির সাথে আমাদের তরুণ প্রজন্মের গ্যাপ তৈরি হবে না। তিনি বেঁচে ছিলেন, বেঁচে থাকবেন তার কর্মের মধ্যে। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।


অনুলিখন : অহ নওরোজ



 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়