ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

এসএ গেমসে বাংলাদেশের অর্জন

ক্রীড়া প্রতিবেদক, নেপাল থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এসএ গেমসে বাংলাদেশের অর্জন

ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে ১০। এই দশদিন নানা ডিসিপ্লিনে বুঁদ হয়ে ছিল ৭টি দেশের ৩ হাজার ২৫০ জন অ্যাথলেট, হাজারের অধিক ম্যানেজার-প্রশিক্ষক-কর্মকর্তা, হাজার হাজার ক্রীড়ামোদি। দশটি দিন উঁচু-নিচু, জাতি-ধর্ম-গোত্রের ভেদাভেদ ভুলে একই ছাদের নিচে থেকেছে তারা। সব বিভেদ ও পার্থক্য ভুলে লড়াই করেছে একই মঞ্চে। বাংলাদেশ থেকে এবারের ত্রয়োদশ এসএ গেমসে অংশ নিয়েছিল ৫৯৬ জন অ্যাথলেট। তারা ২৫টি ডিসিপ্লিনে পদকের জন্য লড়াই করেছে। যদিও সবগুলো ডিসিপ্লিন থেকে পদক আসেনি। তবে আজ আমরা অপ্রাপ্তি নিয়ে কথা বলব না। কথা বলব নেপালে সদ্য সমাপ্ত এসএ গেমসে বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে। সেটা মিলিয়ে দেখবো আয়োজক, সাংবাদিক, বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বয়ানে।

অর্জনের দিকে তাকালে বাংলাদেশের এবারের আসরটি ছিল ৩৫ বছরের মধ্যে সেরা। কারণ, দেশ এবং বাইরে এবারই প্রথম সবচেয়ে বেশি পদক জিতেছে বাংলাদেশ। সেটা সোনার পদক থেকে শুরু করে রূপা ও ব্রোঞ্জের ক্ষেত্রেও। এবারই প্রথম বাংলাদেশ তাদের এসএ গেমসের ইতিহাসে সর্বাধিক ১৯টি সোনা জিতেছে। রূপা জিতেছে সর্বাধিক ৩৩টি। ব্রোঞ্জ জিতেছে সর্বাধিক ৯০টি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পদক ১৪২টি।

প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছে আর্চারি দল, কারাতে দল, ভারোত্তোলন দল, বাংলাদেশ নারী ও পুরুষ ক্রিকেট দল। উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স করেছে তায়কোয়ানদো দল। প্রথমবারই চমক দেখিয়েছে ফেন্সিং দল। গলফ, শ্যুটিং, সাঁতার, উশু ও কুস্তি প্রত্যাশা মেটাতে না পারলেও অল্পের জন্য সোনা হারিয়েছে।

ইতিবাচক দিক বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে আর্চারির কথা। আগের আসরে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও বাজিমাত করেছে এবার। এই ডিসিপ্লিনের দশটি সোনার দশটিই জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ। যা এসএ গেমসে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস।

কারাতে তাদের প্রত্যাশামাফিক পারফরম্যান্স না করতে পারলেও ১৮টি পদক উপহার দিয়েছে। তার মধ্যে সোনা ৩টি, রূপা ৩টি, ব্রোঞ্জ ১২টি। ভারোত্তোলন গেল আসরের মতো এবারও প্রত্যাশা মিটিয়েছে। ২টি সোনা জয়ের পাশাপাশি ৬টি রূপা ও ৫টি ব্রোঞ্জ জিতেছে। পুরোপুরি প্রত্যাশা মিটিয়েছে নারী ও পুরুষ ক্রিকেট দল। তাদের হাত ধরে এসেছে দুটি সোনা। তায়কোয়ানদোর হাত ধরে এবারের এসএ গেমসে বাংলাদেশের প্রথম সোনার পদক আসে। এরপর অবশ্য ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে তারা। বাকি দিনগুলোতে আর সোনা জিততে পারেনি। তবে ১০টি ব্রোঞ্জ জিতেছে। আর একটু ভালো পারফরম্যান্স হলে এই পদকের রঙ হয়তো বদলে যেতে পারতো বেশ কয়েকটির।

প্রথমবারের মতো ফেন্সিংয়ে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ সোনা জিতেছে ১টি। রূপা ৩টি। ব্রোঞ্জ ৭টি।

শুধু সোনা আর রূপার পদকের নিরিখে নয়, অর্জনগুলো বিশ্লেষণ করা যায় দীর্ঘমেয়াদের ভিত্তিতেও। এবারই প্রথমবার এসএ গেমসে অংশ নিয়ে সোনা জিতেছেন কারাতেকা মারজান আক্তার প্রিয়া, হুমায়রা আক্তার অন্তরা ও মো. আল-আমিন। আর্চার রোমান সানা, সোহেল রানা, সোমা বিশ^াস, ইতি খাতুনরা প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে সোনা জেতার পাশাপাশি তিনজন করেছেন হ্যাটট্রিক। ফেন্সিংয়ে ২০ বছর বয়সী ফাতেমা মুজিব, ভারোত্তোলনে ২০ বছর বয়সী জিয়ারুলও প্রথমবার অংশ নিয়ে রাঙিয়েছেন মঞ্চ। তাদের পাশাপাশি ৩৩টি রূপা জেতা অ্যাথলেটদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা প্রথমবার অংশ নিয়েছেন। তাদের পরবর্তী গেমসের জন্য দুই বছর সময় নিয়ে প্রস্তুত করলে এসএ গেমসে বাংলাদেশের সোনার পদকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।

এবার জানা যাক এসএ গেমসে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ও অর্জন নিয়ে কে কি ভাবছে? শুরুতেই নেপাল অলিম্পিক কমিটির জীবন রাম শ্রেষ্ঠা বলেছেন, ‘ধন্যবাদ বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের। আপনাদের আগমণে আমাদের আয়োজন পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলাদেশ অন্যান্য আসরের তুলনায় ভালো করেছে। বিশেষ করে আর্চারিতে। এছাড়া ক্রিকেটে তারা বলতে গেলে দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম সেরা। ভারোত্তোলনেও ভালো করেছে। অনেক তরুণ অ্যাথলেট দেখেছি। তাদের পরিচর্যা করলে ভবিষ্যতে এই ধরনে গেমসে বাংলাদেশের সম্ভাবনা আরো বাড়বে।’

শ্রীলঙ্কার অলিম্পিক কমিটির হেড অব মিডিয়া এসআর পাথিরাভিতানা অবশ্য এসএ গেমসের সাফল্য নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে চান না। এসব আঞ্চলিক গেমসের সাফল্য নিয়ে মাতামাতি করার পক্ষেও নন তিনি। তিনি এশিয়ান গেমস ও অলিম্পিকে ভালো করার পথও বাতলে দিয়েছেন, ‘আসলে এখন এসএ গেমসের অর্জন নিয়ে ঢেকুর তোলার সময় নয়। আমরা আঞ্চলিক এই প্রতিযোগিতার বাইরে চিন্তা করতে পারছি না। আসলে আমরা যদি এশিয়ান গেমস ও অলিম্পিক নিয়ে চিন্তা করি ও প্রস্তুতি নিই তাহলে এসএ গেমসে এমনিতেই পদক বাড়বে। যেটা ভারত করছে। হ্যাঁ, আপতদৃষ্টিতে বাংলাদেশ ভালো করেছে এবারের আসরে। কিন্তু আমাদের উচিত হবে ২০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সামনে আগানো। ক্রীড়াক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এক্সপারটিস বাড়াতে হবে। লম্বা সময় ধরে প্রস্তুত করতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে এদিকে। তাহলেই আস্তে আস্তে আমরা ফল পেতে শুরু করব।’

নেপালের সাংবাদিক দীপেস তিমালসিনা বলেছেন, ‘হ্যাঁ, দক্ষিণ এশিয়ার বিবেচনায় বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ভালো করেছে। কিন্তু এর বাইরে আমরা কিন্তু পিছিয়ে। বাংলাদেশ খেলাধুলায় এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্রিকেট, আর্চারি। ফুটবলেও ইদানিং ভালো করছে। এসএ গেমসে বেশ কিছু ইভেন্টে তারা দারুণ পারফরম্যান্স করেছে। যদিও নেপাল আয়োজক হিসেবে বেশি সুবিধা পেয়েছে। সেটা না পেলে বাংলাদেশের পদক আরো বাড়তে পারত।’

তৃপ্তির ঢেকুর না তুললেও খুশি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা, ‘আমি সত্যি খুব খুশি। প্রত্যাশা যা নিয়ে এসেছিলাম এর খুব কাছাকাছি গিয়েছি। কিন্তু কিছু কিছু ডিসিপ্লিন খারাপ করেছে। আমরা হতাশ হইনি। এটা আমাদের ব্যাড লাক। আমরা যে রূপাগুলো পেয়েছি সেগুলোতে কিন্তু সোনার প্রত্যাশা ছিল। আমরা রূপাও পেয়েছি বেশ কিছু। যা আগের আসরের চেয়ে ডাবল। সোনার লড়াইয়ে কিছুটা পয়েন্টের জন্য হেরেছি। যদি এগুলো সোনা হতো তাহলে আমাদের আরো ভালো হতো।’

‘তবে আমাকে কিছু গেমস আইডেন্টিফাই করতে হবে। মার্শাল আর্টে অনেক সোনা আছে। একেকটার ২২-২৫টা ইভেন্টে গোল্ড আছে। এগুলোকে যদি নিজেদের নজরদারিতে নিয়ে আসি, দীর্ঘমেয়াদি ট্রেনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে পারি এবং এই ধরনের ডিসিপ্লিন থেকে যদি শতকরা ২৫ ভাগও সঠিকভাবে নিতে পারি, তাহলে আমাদের সোনার পদক ৪০-৫০ টার কাছাকাছি নিতে পারব।’

অর্জনের পাশাপাশি ব্যর্থতাও কম নয়। তবে শুধু অর্জন এবং ব্যর্থতা নিয়ে পরে থাকার সময় নেই। এগিয়ে যেতে হবে সামনে। দৃষ্টি রাখতে হবে সুদূরে। লড়াই যে এখানেই শেষ নয়। প্রস্তুত হতে হবে পরবর্তী লড়াইয়ের জন্য। ১৭ কোটি মানুষের দেশের জন্য আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় ১৯টি সোনা পাওয়া, আকাঙ্খা বাড়িয়ে দিক কয়েকগুণ। উদ্দীপ্ত করে তুলুক সোনা জয়ের নেশায়। দেখা হবে পরবর্তী গেমসের বিজয়ের মঞ্চে।

 

কাঠমান্ডু/আমিনুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়