ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

থাইল্যান্ড ক্রিকেটের মশালবাহী বাংলাদেশি তিতাস

ক্রীড়া প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৩১, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
থাইল্যান্ড ক্রিকেটের মশালবাহী বাংলাদেশি তিতাস

বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশিরা। যারা তাদের কর্মদক্ষতা, একাগ্রতা আর ডেডিকেশন দিয়ে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করছে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে। তেমনই একজন থাইল্যান্ড ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের ডেভেলপমেন্ট অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম তিতাস। যিনি গেল ১৩ বছর ধরে থাইল্যান্ডের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করছেন। এক সময় নিজে খেলেছেন থাইল্যান্ডের হয়ে। এখন তার হাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে থাইল্যান্ডের ক্রিকেট। সমৃদ্ধ হচ্ছে পাইপলাইন। ক্রিকেট ছড়িয়ে পড়ছে প্রদেশ থেকে প্রদেশে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য পেতে শুরু করেছে থাইল্যান্ড। তিতাস থাইল্যান্ড ক্রিকেটের আলোকবর্তিকা হাতে এগিয়ে চলছেন। থাইল্যান্ড ক্রিকেটের এই মশালবহনকারীর সাক্ষাৎকার পড়ুন :

প্রশ্ন : থাইল্যান্ড ক্রিকেটের সঙ্গে আপনি কত বছর ধরে আছেন?

তিতাস : এখানে আমি ১৩ বছর ধরে আছি। ক্রিকেট থাইল্যান্ডের সঙ্গে ১৩ বছর, এসিসির সঙ্গেও ১৩ বছর।

প্রশ্ন : আপনার শুরুটা হয়েছিল কিভাবে?

তিতাস : শুরুটা থাইল্যান্ড ক্রিকেটেই। আমি আসলে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের অ্যাসিস্ট্যান্ট মিডিয়া ম্যানেজার। আমি তখন থাইল্যান্ড ক্রিকেটের প্রাথমিক পর্যায়ের কোচিং দিয়ে শুরু করি। তারপর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। তারপর এডুকেটর। আমি লেভেল-৩ করা। থাইল্যান্ড ন্যাশনাল টিম দেখেছি। নারী ক্রিকেট দল, পুরুষ ক্রিকেট দল দেখেছি।সবগুলোই দেখেছি।

প্রশ্ন : এখন আপনি থাইল্যান্ড ক্রিকেটের কোন দিকটা দেখছেন?

তিতাস : এখন আমি থাইল্যান্ড ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের ডেভেলপমেন্ট অফিসার। আমাদের থাইল্যান্ডে সর্বমোট ৪২টা প্রদেশ রয়েছে।সেগুলোর মধ্যে ২৯টা প্রদেশে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। আমি যখন শুরু করি তখন আমাদের মাত্র ৫টা প্রদেশে খেলা হত। এরপর আস্তে আস্তে উন্নতি করতে করতে এ পর্যন্ত আসা। স্পোর্টস অথরিটি অব থাইল্যান্ড যাকে থাইল্যান্ডের মাদার অব স্পোর্টস বলা হয়- তাদের মোট ৫৬টা ডিসিপ্লিন রয়েছে। আমরা তাদের আন্ডারেই খেলি।২০১১ সালে থাইল্যান্ড ক্রিকেট শিফট হয়েছে স্পোর্টস অথরিটি অব থাইল্যান্ডে।তার আগ পর্যন্ত আমাদের অফিস ছিল দুই তলা একটা বাসা। সেটার নিচতলায় আমরা অফিস করতাম। আর দ্বিতীয় তলায় ছেলে ও মেয়েরা থাকত, যারা বাইরে থেকে আসতো। তখন অবশ্য আমাদের অবকাঠামো অতো ভালো ছিল না।

 

 

প্রশ্ন : আপনাদের হাত ধরে ক্রিকেট থাইল্যান্ডের উত্থানটা আসলে কিভাবে?

তিতাস : ২০১২ সাল থেকে আমাদের মূল উন্নতিটা হয়েছে। ২০১০ সালে আমরা প্রথমবার এশিয়ান গেমস ক্রিকেট খেলি। সেবার ক্রিকেটে মেয়েরা চতুর্থ হয়। পরেরবার (২০১৪) আবারো চতুর্থ হয়। সাউথ এশিয়ান গেমসে আমরা গোল্ড পেলাম। তারপর থেকেই ক্রিকেটের প্রতি সরকারের আগ্রহটা বেড়ে গেল। আর যখন দেখলো যে প্রত্যেকটা প্রদেশে ক্রিকেট ছড়িয়ে যাচ্ছে। তখন থেকে সরকারও সবরকম সহযোগিতা দিতে শুরু করে। আমার কাজ হচ্ছে মূলত ডেভেলপমেন্ট প্লানটা করা। আগে আমি কোচ ছিলাম। এরপর আমি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে চলে এসেছি। আমি যেহেতু কোচিংয়ে লেভেল-৩ করা, এডুকেটর করা। আমার তত্ত্বাবধানে অনেক কোচ। প্রত্যেকটা প্রদেশ। তাদের জন্য ডেভেলপমেন্ট প্লান করা হচ্ছে আমার থাইল্যান্ডের কাজ। আর থাইল্যান্ড ছাড়া আমি যখন এসিসির সঙ্গে কাজ করতাম তখন আমি ২৭টা দেশের সঙ্গে কাজ করতাম। তখন টুর্নামেন্ট হলে সেটা কাভার করতাম এসিসির হয়ে ক্রিকেট থাইল্যান্ডের জন্য। সেটা আমার অতিরিক্ত একটা চাকরি ছিল।

প্রশ্ন : থাইল্যান্ড ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে বিদেশি কতজন?

তিতাস : এখানে আমি একমাত্র বিদেশি। বাকি যারা আছে তারা সবাই থাই পাসপোর্টধারী। গেল ১৩ বছর ধরে তাদের সঙ্গে কাজ করছি। মেয়েদের টিম, ছেলেদের টিম, ছোটদের টিম দেখেছি। এখন আমি কেবল জুনিয়র ডেভেলপমেন্ট ও সিনিয়র ডেভেলপমেন্ট দেখি।এখন আমাদের যে কোচিং স্টাফ সেট-আপ রয়েছে সেটা খুবই ভালো।

প্রশ্ন : থাইল্যান্ডের নারী ক্রিকেট দল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জায়গা করে নিল...

তিতাস : আমাদের মেয়েরা খুবই ভালো করেছে। এটা আমাদের ক্রিকেট থাইল্যান্ডের জন্য বিশাল অর্জন ও উন্নতি। আমরা আসলে সরকার থেকে যে প্রশংসা কিংবা মিডিয়া থেকে যে কাভারেজ আশা করিনি সেটা পেয়েছি। আমাদের মেয়েদের এই প্রচেষ্টাটা শুরু হয়েছে মূলত নারী এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পর। তখন আমরা লাইম লাইটে চলে আসি। আমাদের কিন্তু আন্ডারডগ হিসেবে সবাই চিন্তা করত। আসলে এটা সম্ভব হয়েছে থাইল্যান্ড নারী ক্রিকেট দলের কয়েকজন খেলোয়াড়ের কারণে। আমাদের অধিনায়ক, সহ-অধিনায়কসহ ছয়-সাতটা খেলোয়াড় আছে যারা অনেকদিন ধরে একসঙ্গে খেলছে। তারা ২০০৮ সাল থেকে ক্রিকেট খেলতেছে। তারাই কিন্তু টিমটাকে টানতে টানতে এই পর্যন্ত নিয়ে আসছে।

প্রশ্ন : ক্রিকেট কাঠামোটা কেমন?

তিতাস : এখন আমরা একটা ফেজে চলে আসছি। আমাদের জাতীয় দল, ‘এ’ টিম, ‘বি’ টিম, অনূর্ধ্ব-১৯, অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৬ দল রয়েছে।পাইপলাইনে অনেক ক্রিকেটার আছে। এভাবে করেই র‌্যাপিড ডেভেলপমেন্টটা হচ্ছে। আগে আমাদের থাইল্যান্ড ক্রিকেটে কোনো রোল মডেল ছিল না। আগে কোনো প্লেয়ার অনেক ভালো খেলছে এমন কিন্তু ছিল না। এখন কিন্তু একটা কাঠামোতে চলে আসছে। আমাদের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক কিন্তু সেঞ্চুরি করেছে। ২০১২ সালে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের অধিনায়ক অপরাজিত ১১৭ রান করেছে।

 

 

প্রশ্ন : থাইল্যান্ড ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কবে থেকে কাজ শুরু করেছিল?

তিতাস : ১৯৯৫ থেকে থাইল্যান্ড ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কাজ শুরু করেছে। তখন অবশ্য এটা বোর্ড ছিল। এখন থাইল্যান্ড ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। আমরা কিন্তু আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের আগে প্রতিষ্ঠিত। আসলে এটার পেছনে জাগমোহন ডালমিয়া, সৈয়দ আশরাফুল হক ওনাদের ভূমিকা রয়েছে। তখনই তারা বলেছিলেন যে থাইল্যান্ড ক্রিকেটে ভালো করবে।  তখন অবশ্য অনেক বিতর্ক ছিল। তখন অবশ্য আমরা ছিলাম না। আমরা ডেভেলপমেন্টের সেকেন্ড ফেজ পার হয়ে আসছি। এখন থার্ড ফেজ চলছে।

প্রশ্ন : আপনাদের কতগুলো ক্রিকেট একাডেমি আছে?

তিতাস : জ্বি, আমাদের একাডেমি আছে। আমরা আসলে তিনটা সেন্টার এক্সিলেন্স করেছি। এটা আমাদের ডেভেলপমেন্টের আন্ডারে। সেগুলো হচ্ছে চিয়াংমাই, ব্যাংকক ও খোনক্যানে অবস্থিত। সেখানে ন্যাশনাল গেম, ন্যাশনাল ইয়ুথ গেম হয়। সেখান থেকে আমরা খেলোয়াড় বাছাই করি। সেন্টার অব এক্সিলেন্সে নিয়ে আসি। ওখানে আমরা ওদের শিক্ষা, খাওয়া-দাওয়া সবকিছু ফ্রি থাকে।

প্রশ্ন : সরকার কেমন সাপোর্ট দিচ্ছে?

তিতাস : খুবই ভালো সাপোর্ট দিচ্ছে। এখন তো অনেক ভালো। এসএ গেমসের পর থেকে আমরা এখন অনেক ফোকাসে। তার আগ পর্যন্ত আমরা এতোটা ফোকাসে ছিলাম না। এসএ গেমসে গোল্ড পাওয়ার পর সরকারের নজরে চলে আসছে। সরকার বুঝতে পেরেছে ক্রিকেট একটা স্পোর্টস এবং যেটার মাধ্যমে থাইল্যান্ড গোল্ড পেয়েছে।

প্রশ্ন : স্থানীয়দের কাছে ক্রিকেট কতোটা জনপ্রিয়?

তিতাস : এখন অনেক জনপ্রিয়। কারণ, এখন থাইল্যান্ডে ক্রিকেট বেশ প্রচার পাচ্ছে। আমরা কিন্তু গেল দশ বছরে অনেক সংগ্রাম করেছি একটা নিউজ মিডিয়ায় দেওয়ার জন্য। কেউ কিন্তু আসলে প্রচার করেনি। এখন আমাদের চ্যানেল পার্টনার ৬টা। আগে ছিল জিরো! ভারতের মিডয়াগুলোও গুরুত্ব দিচ্ছে আমাদের। আমাদের মেয়েরা যেদিন বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত করল সেদিন ভারতের পত্রিকাগুলোতেও শুধু থাইল্যান্ড, থাইল্যান্ড, থাইল্যান্ড। আমরা কিন্তু আসলে একটা ফোকাস পয়েন্ট। অনেকেই থাইল্যান্ডে খেলতে আসতে চায়। আমরা ওটাকেই রিসোর্স হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছি।

 

 

প্রশ্ন : আগামী দশ বছরে থাইল্যান্ড ক্রিকেটকে কোথায় দেখতে চান?

তিতাস : এখন তো আমরা ওয়ার্ল্ড কাপে। এরপর তো আর কোনো স্টেপ নাই। এরপর আমরা চাচ্ছি যে আমাদের সাথে বড় বড় দলগুলো খেলুক। যেমন আমাদের সাথে বাংলাদেশ খেলবে। নেদারল্যান্ডস, স্কটল্যান্ডস এরা আসলে আমাদের সঙ্গে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে চায়। আমরা দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বাড়াচ্ছি। এখন অন্যান্য টেস্ট প্লেয়িং, নন টেস্ট প্লেয়িং দেশগুলো আমাদের টার্গেটে রয়েছে। 

প্রশ্ন : ক্রিকেটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কেমন থাইল্যান্ডে?

তিতাস : এখন অনেক ভালো। ব্যাংককেই আমাদের ক্রিকেট মাঠ রয়েছে চারটা। সবগুলোই টার্ফ। তার মধ্যে তিনটা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব থাইল্যান্ড চালায়। একটা প্রাইভেটাইজেশনে চলে। ব্যাংককের বাইরে ফুকেট, চিয়াংমাইতে আমাদের চারটা করে মাঠ রয়েছে। সবগুলো ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের আন্ডারে। এছাড়া অন্যান্য জায়গায়ও রয়েছে। কিন্তু সেগুলো অ্যাস্ট্রোটার্ফ। আমাদের যতগুলো আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য যত টুর্নামেন্ট হয় সবগুলো ব্যাংকক ও চিয়াংমাইতে হয়। 

প্রশ্ন : আপনার স্বপ্ন কী?

তিতাস : আমার স্বপ্ন তো একটা পূরণ হয়েছে। মেয়েরা বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত করেছে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা অর্জন। পুরুষ ক্রিকেটের র‌্যাঙ্কিংয়ে আমরা অনেক পেছনে, ৫৭। আমরা চাই দ্রুত উন্নতি করতে। এখন আমরা এথনিক (থাইল্যান্ডের স্থানীয়) দিয়ে কাজ করতে চাচ্ছি। একটা সময় ছিল আমাদের হয়ে এখানে মিশ্র সংস্কৃতির মানুষজন ক্রিকেট খেলত। এশিয়ানরা খেলত। আমিও থাইল্যান্ডের জন্য খেলেছি। আমরা এখন চাই থাইল্যান্ডের মানুষই খেলুক। পুরো টিম থাইদের হোক। এখন কিন্তু আমাদের পাইপলাইনে সব থাই ক্রিকেটার। আমরা কিন্তু এখন আর বিদেশি ক্রিকেটার রিক্রুট করি না। একটা সময় ছিল বিদেশিরা খেলত। হ্যাঁ, প্রতিভা থাকলে আমরা বাইরের মানুষকেও সুযোগ দিই। এরকম একটা-দুইটা সুযোগ তো দিতেই হবে। নইলে আসলে রোল মডেল থাকছে না। বিদেশি আমরা কেন চাই না? কারণ, তারা কিছুদিন খেলার পর চলে যাচ্ছে। আমাদের অ্যাসেট হচ্ছে না। যেহেতু আমি ডেভেলপমেন্টটা দেখি তাই আমার টার্গেট হচ্ছে শুধু থাই ক্রিকেটাররাই আসুক থাইল্যান্ড ক্রিকেট দলে। এখন আমরা থাই আম্পায়ার, থাই স্কোরার-সবকিছু থাই দিয়ে করা চেষ্টা করছি। এজন্যই ভালো করছে। থাইরাও বুঝতে পারছে ক্রিকেটের একটা ভবিষ্যত আছে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি ও খ্যাতি রয়েছে।

সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ

তিতাস : আপনাকেও ধন্যবাদ।


থাইল্যান্ড/আমিনুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়