শিল্প ও সাহিত্য

আনন্দ-অশ্রু লেখা যায় না

ভাষার সঙ্গে আছি, ভাষার সন্ধানে আছি। দেখি, ভাষা আমাকে কোন দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়! কোথায় গেলে পাওয়া যাবে সেই ভাষা- যার মধ্যে ফলিত থাকছে এই সময়! নিজেকেই প্রশ্ন করি, হাহাকার কি আকার পাচ্ছে ভাষায়? অসহায়ত্ব কি ধরা যাচ্ছে বর্ণমালায়? চারদিকে শুধু মানুষ মরে যাচ্ছে। মানুষের ঘরবন্দী দিন কি ধরা পড়ছে গানে, কবিতায়, ছবিতে বা শিল্পকলায়?

খবর উড়ছে হাওয়ায়। খবর পাচ্ছি, মানুষ চুপচাপ চলে যাচ্ছে কবরের নির্জনতায়। মানুষ তার প্রিয়জন হারাচ্ছে সকাতর বেদনায়। রোগ উপশম হচ্ছে না, খাবার জুটছে না পেটে। সব কিছু অনলাইনে লাইভ হয়ে যাচ্ছে। ‘লাইফ’ শেষ হয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে ‘লাইভ’। জীবন ভার্চুয়ালিটিতে আটকে পড়ছে। সারাদিন ঘরের ভেতরে মানুষ। ঘরে মানুষ কী করে? খাওয়া-ঘুম-নির্ঘুমে মৌসুম চলে যাচ্ছে। সবাই বলছে, এ নাকি প্যানডেমিক মৌসুম! আকাশে উড়োজাহাজ চলছে না, সাগরে জাহাজ থেমে আছে, রাস্তায় গাড়ি নেই, সুনসান হয়ে আছে পৃথিবী। জানলার বাইরে মেঘ, বৃষ্টি হচ্ছে। পাখিদের স্বাধীনতা মিলেছে। পাখিরা ডাকছে পাখিদের। পাখিদের ভাষায় কবিতা লেখা যায় না, লেখাও হচ্ছে না। শুনতে পাচ্ছি, কোনো বাড়ির জানলার ধারে বসে কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে। বাঁশির টানে ভেসে যাচ্ছে নিঃসঙ্গতা। সেই নিঃসঙ্গতা লিখব কোন ভাষায়?

শৈশব ভেসে উঠছে। শৈশবের ভাষা শুনতে পাচ্ছি। মামাবাড়ি যাওয়ার রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছি। মাটির রাস্তায় ধুলো উড়ছে খুব, মাঠে মাঠে ফুটিফাটা রোদ। সেই রোদে নেচে যাচ্ছে ফড়িং, আমাদের শৈশবে দেখা ফড়িং। আমরা ভাইবোন মিলে যাচ্ছি ফড়িং ধরতে। ফড়িং উড়ে যাচ্ছে, আমরা উড়তে পারছি না। আমরা ভাইবোন মিলে যাচ্ছি বিলে মাছ ধরতে। ছোটবেলার বিলবাওড় মনে হয় সমুদ্রের মতো। বিলের ওপারে গ্রাম, সেই গ্রামে কারা বাস করে? তাদের সঙ্গে কি কোনোদিন দেখা হয়েছে আমাদের? ধুলোওড়া রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুপুর ঝুঁকে পড়ছে পশ্চিমের বিকেলবেলায়। জোড়াদহ ভায়না কত দূর? মাইলমারি ছাড়িয়ে রাস্তা পড়ল বাঘআঁচড়া গ্রামের মধ্যে। আমরা ভাইবোন হাঁটছি রাস্তা দিয়ে। সুগ্রীবপুর কতদূর? সামনে একটি নদী। আমাদের নদীদের ডাকনাম ‘গাঙ’। আমরা ভাইবোন গাঙপাড়ে পৌঁছে গেছি। বাঁশের যে সাঁকোটা ছিল, সেই সাঁকো ভেঙে গেছে। গাঙের ওপারে নৌকো। পাটনি নেই। পাটনি গেছে বাড়িতে, ভাত খেতে, তাই নৌকো চলাচল বন্ধ। ঠিক বন্ধও না, পারাপারের লোক যারা নৌকো বাইতে পারে, পাটনি না-আসা পর্যন্ত সেই লোকেরাই নৌকো চালায়। এপার থেকে ওপারে যাওয়ার পর নৌকো ঘাটে রেখে তারা চলে যায়। আবার কখন ওপারের কেউ নৌকো বেয়ে আনবে এপারে- সেই অপেক্ষায় বসে আছি ভাইবোন। হয়তো কেউ আসেও তখন; তারা এপারে আসে নৌকো বেয়ে। আমরা নৌকোয় উঠে বসি। এপারের কেউ নৌকো বায়। আমরা ভাইবোন মামাবাড়ি যাচ্ছি। আমার বোনের নাম বীথি, আমার ছোটবোন।

মধুপুর-গাড়াগঞ্জ-শৈলকূপা থেকে হরিণাকুণ্ডু কতদূর! সব গ্রামেই তো মাটির রাস্তা। রাস্তার ধারে বুড়ো বটগাছ। বটগাছে কত বাদুর ও পাখি। পথের মানুষ ঝিমায়-ঘুমায় বটের নিচে। বটগাছের পাশে মন্দির। মন্দির থেকে কীর্তনের সুর ভেসে আসে। ধারেকাছে কোথাও মোটরগাড়ির শব্দমাত্র নেই। আমি আর বীথি বাঘআঁচড়া পার হয়ে যাই। তারপর একটি খাল। শীতে শুকিয়ে গেলেও বর্ষায় খরস্রোতা। বাঁশের সাঁকো। সাঁকো পার হলেই খালি মাঠ আর মাঠ। দূরে-অদূরে কৃষকেরা কাজ করে। রাস্তায় বাবলা গাছের সারি। বাবলার ফুল হলুদ। আমরা দেখতে পাই, ওই আমাদের মামাবাড়ির গ্রাম- ভায়না। আমরা যাচ্ছি মামাদের গ্রামে। সেই গ্রাম আর ছবির মতো নেই, এখন শুধু বাড়ি বাড়ি ভর্তি। সেই মাটির রাস্তায় ইট পড়েছে। ইলেক্ট্রিকের তার ও খাম্বা বসেছে। বটগাছ নেই। মন্দির নেই। কীর্তনের সুর কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। কোথায় মিলিয়ে গেল? সীমান্তের দিকে? সেই মাঠ আর নেই। সব ঘনবসতি হয়ে গেছে। সেই শৈশবই আর নেই। আমরা বড় হয়ে গেছি। বাঁশির সুর থেমে গেল। একটি শিশুর কান্না ভেসে আসে।

আর আজ, করোনাকালের যাত্রায় মানুষের কোথাও যাওয়ার নেই। ঘরে বসে থাকা শুধু। ঘর এক বন্দীশালা হয়ে উঠেছে। এই করোনাভাইরাসে এরই মধ্যে পৃথিবী থেকে তিন লাখের বেশি মানুষ হারিয়ে গেছে। দেশে দেশে মৃত্যুর মহামারি চলছে। ক্ষুধার্ত মানুষ দিশে পাচ্ছে না। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতেই অসংখ্য মানুষ মরে যাচ্ছে। কত রকম মৃত্যুর খবর ছাপা হচ্ছে কাগজে কাগজে। মৃত্যু দেখছি আমরা টেলিভিশনের পর্দায়। আমরা মৃত্যুর খবর দেখছি সোশ্যাল মিডিয়ায়। শোনা যাচ্ছে, করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা দিনরাত একাকার করে ফেলছেন। আমরা তাকিয়ে আছি, ওষুধ আসবে, আক্রান্ত মানুষ বাঁচবে। কবে আসবে? কত দাম থাকবে সেই ওষুধের? এরই মধ্যে যারা মরে গেছে,তারা আর ফিরবে না। এরই মধ্যে যারা নিঃস্ব হয়ে গেছে, তারা ফের উঠে দাঁড়াবে কবে- কেউ জানে না। কান্নার অশ্রু শুকিয়ে যাবে, হাহাকার থেকে যাবে। ব্যথা বেজে উঠবে মৃতদের প্রিয়জনের আহত পাঁজরের শ্বাস-প্রশ্বাসে। ব্যথা বাজতেই থাকবে। ব্যথা কোন ভাষায় প্রকাশিত হবে? অশ্রু কোন ভাষায় লিপিবদ্ধ হবে?

যারা বিখ্যাত মানুষ, তাদের ছবি কাগজে ছাপা হচ্ছে, হবে- তাদের জন্যে আমাদের মনে ছাপ থেকে যাবে। যারা বিখ্যাত নয়, তাদের কথা আমি কোন ভাষায় লিখে রাখব? যারা বেঁচে উঠছে, গণমাধ্যমের ভাষায় তারা ‘করোনাজয়ী’। কোথাও কোথাও তারা বীর আখ্যা পাচ্ছে। আমার ছোটবোন বীথি করোনাজয়ী। বীথি করোনায় সেরে ওঠাদের একজন। ঝিনাইদহ জেলার সিভিল সার্জন অফিস থেকে প্রথম যে আটজন করোনাজয়ীকে সংবর্ধনা ও ক্রেস্ট দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে, আমার ছোটবোন তাদেরই একজন। ঢাকায় থাকার জন্যে আমি সেই সংবর্ধনা সরাসরি দেখতে পাইনি। আমার মা-বাবাও দেখতে পাননি। কেননা, এটা একান্তই সরকারি পর্যায়ের রুটিন ওয়ার্ক। দেখতে পায়নি আমার অন্য বোন, তার দুই মেয়ে বাচ্চাও। ২৪ দিন আইসোলেশনে থাকার পর বীথিসহ ঝিনেদার আটজনকে করোনাজয়ী ঘোষণা করা হলেও গতকাল থেকে নতুন করে আরও ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইন দেওয়া হয়েছে। আমার ছোটবোন বীথি, ডা. খসরু আল মামুন রেজা, বখতিয়ার উদ্দিন, শুকুর আলী, ডা. মার্ফিয়া খাতুন, ডা. আব্দুল্লাহ আল কাফী, জগদীশ ও কামনা- এই আটজন ঝিনাইদহের প্রথম করোনাজয়ী।  

বীথির হাতে করোনাজয়ী ক্রেস্ট ও ফুলের তোড়া

 

ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক জনাব সরোজকুমার নাথ, সিভিল সার্জন জনাবা সেলিনা বেগম, ঝিনাইদহের পৌর মেয়র জনাব সাইদুল করিম মিন্টুসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ জেলার করোনা প্রতিরোধ সেল হিসেবে ধার্য করা শিশু হাসপাতাল কম্পাউন্ডে আটজনের হাতে করোনাজয়ী ক্রেস্ট ও ফুলের তোড়া উপহার দিয়েছে গত ১৭ মে ২০২০ তারিখে। আটজনের বাড়ি থেকেই সরকারিভাবে ঘোষিত লকডাউন তুলে নেওয়া হয়েছে। আমার ছোটবোন বীথির হাতে করোনাজয়ী ক্রেস্ট ও ফুলের তোড়ার ছবি ফেসবুকে দেখার পর আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরে পড়ল। সারাদিনে কয়েকবার কান্না ঠেকাতে পারলাম না। কোন ভাষায় আমি তা লিখব? কেন এই জয়ের ছবি দেখে কান্না আসে? ভাষা কি তা ধরতে পারে?  আনন্দের ভাষা কি লেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে? নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-কে পরাজিত করে মানব সমাজে ফিরে আসার, বেঁচে ওঠার যে অভিব্যক্তি তা আমি লিখতে পারব না। এসব কথা লিখতে লিখতেই আমার চোখ থেকে লবণজল ঝরে পড়ছে। চোখ থেকে লবণজলের পতন কি লেখা সম্ভব? ভাষা কি তা লিখিয়ে নিতে পারে, কোনো ভাইকে দিয়ে? যার ছোটবোন মরে যেতে পারত এই করোনাযুদ্ধে, যেমন করে ইতোমধ্যেই বিশ্বের ৩ লাখের বেশি মানুষ মরে গেছে এবং প্রতিদিনই মরছে! যারা মরে গেছে গত ৩ মাসেই- তাদের জন্যে আমি কীভাবে শোকগাথা লিখব? কোন ভাষায়? যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্তের পর প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতেই মরে গেছে- মরে যাচ্ছে- তাদের জন্যে লেখার ভাষা কোথায় পাব? ঢাকা শহরেই মানুষ রাতে রাস্তায় শুয়ে থাকছে, ভোরে যাতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়! যাতে তারা বাঁচতে পারে। কত কতজন করোনা স্যাম্পল টেস্টই করাতে পারেনি, তার আগেই মরে গেছে বা মরে যাচ্ছে- তাদের জন্যে লেখার উপযুক্ত ভাষার সন্ধানে আমি কোথায় যাব? চোখ ফেটে অশ্রু ঝরে পড়ে। জানি না, এহেন অশ্রু কোন ভাষায়, কোন বর্ণমালায় লিপিবদ্ধ করা সম্ভব?

এ কথা তো ঠিক, এমন সময় আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল না। মানুষের সঙ্গে মানুষের এমন নিষ্ঠুর সম্পর্ক আমরা কখনো দেখিনি। স্বাভাবিক জীবনাচারণের অভ্যেস ভেঙে নতুন এক রীতিতে এসে আটকে পড়তে হবে_এমন তো আমরা কেউ ভাবিনি। ২০২০ সালে এসে হঠাৎ শুনতে হবে ‘প্যানডেমিক’ অর্থাৎ, বিশ্বের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভাইরাসঘটিত রোগ দ্বারা আক্রান্ত এবং বাকি অঞ্চলও ঝুঁকির বাইরে নয়। সমগ্র পৃথিবীই আক্রান্ত আজ। আক্রান্ত বাংলাদেশ। শহর-বন্দর ছাড়িয়ে আক্রান্ত বাংলার গ্রাম-জনপদ। করোনা মহামারিতে পৌঁছে গেছে। ফলত, মানুষের চিন্তারেখাও আর আগের মতো নেই। মানুষ বদলে যাচ্ছে। করোনা-বাস্তবতা নতুন এক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। নতুন এক স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে পরিপার্শ্ব। বদলে যাচ্ছে রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি, জীবনযাপন, মানবিক মূল্যবোধ। মানুষের সামাজিক সম্পর্কে পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।  কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী অনুমান করছেন, মানুষ আর আগের জায়গায় ফিরতে পারবে না! পরিস্থিতিই এমন, করোনা-আক্রান্ত যে মরার মরবে, যে বাঁচার, বাঁচবে। সে আমিও হতে পারি, তুমিও হতে পারো। যারা মারা গেছে, তারাও বেঁচে থাকতে ‘আমি’ ছিল, এতদিন তারাও ‘তুমি’ ছিল। অনেক ‘আমি’ মরে গেছি এরই মধ্যে, অনেক ‘তুমি’ও মরে গেছ। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে অনির্ধারিত, অচেনা, নিঃসঙ্গতার ঘেরাটোপ। তাই করোনা সন্দেহে মা’কে জঙ্গলে ফেলে গেল তার সন্তান-পুত্রেরা। কী নির্মম! হাসপাতালের বারান্দা থেকে করোনা আক্রান্ত পুত্রকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর জন্যে পিতা পাচ্ছেন না কোনো সাহায্যকারী। ছোঁয়াচে ভাইরাস করোনার কারণে পিতা নিজের কাঁধেই টেনে নিলেন তার পুত্রকে, জীবনের গভীরতম খেদে উচ্চারণ করলেন, ‘দেশ মইরা গেছে, তোর বাপ তো মরেনি এখনো, আয়, আমার কাঁধে আয়।’ এই ভাষা মনে হয় কখনো ভুলতে পারব না। করোনা-আক্রান্ত লাশ নিয়ে নিজের গ্রামে ঢুকতে পারছে না কারও স্ত্রী ও সন্তান। লাশ দাফন করতে দেবে না প্রতিবেশীরা। লাশ নিয়ে রাস্তায়, পথে পথে স্বজনেরা। এ কি পরাবাস্তব কোনো সিনেমা? নাকি মরাবাস্তব রিয়েলিটি? কোথাও মরদেহ কবর দেবার আগে তার জানাজার জন্যে খাটিয়া দিতে নারাজ গ্রামবাসী। করোনা মোকাবেলায় হাসপাতাল নির্মাণেও বাঁধা দিতে দেখা গেল খোদ ঢাকা শহরেই। কোথাও লাশ ফেলে গেছে কারা, তার হদিস নেই। শোক-দুঃখগাথার প্লাবন তৈরি হচ্ছে। যিনি মারা যাচ্ছেন বা করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন, তিনিও কারো স্বজন, কারো বাবা বা মা, ভাই বা বোন কিংবা স্ত্রী বা সন্তান। এসময় দরকার আক্রান্তের পাশে থাকা, কিন্তু চারদিকে ঘটছে এর বিপরীত কিছু। প্রচারণা দরকার ছিল শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করার, প্রচারণা হয়ে গেল সামাজিক দূরত্বের। দরকার ছিল আরো বেশি মানবিক হয়ে ওঠার, কিন্তু অমানবিকতাই প্রকাশ্য হয়ে পড়ছে।

করোনাজয়ী যে-কোনো পরিবারের সদস্যদের চোখে ঝরে পড়ে আনন্দের অশ্রু। যেন বা মরতে মরতে বেঁচে ওঠার এপিক। সেই এপিক লেখা যায় না। সেই অশ্রু লেখা যায় না। আগামীর পৃথিবীতে আজকের করোনাকাল কে কীভাবে মনে রাখবে জানি না, কিন্তু করোনা আক্রান্ত মানুষের প্রিয়জনেরা ঠিকই মনে রাখবে, এক ভয়ঙ্কর কাল এসেছিল। যখন মানুষ মানুষের স্পর্শ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। যখন মানুষ মানুষকে আর চিনতে পারছিল না। কারণ, সবার মুখই ছিল ঢাকা, মুখোশে মুখোশে। যখন নিজের হাত, হাতের আঙুলকেও আর বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না। সেই আগামীর মানুষ কি হাসবে এ কথা শুনে? ভাববে, তাহলে মানব সম্পর্কের ইতিহাসই বদলে গিয়েছিল?

এরকম ক্রুয়েলিটির কথা আমি লিখব কোন ভাষায়? আমার ছোটবোন বীথি করোনাজয়ী, কিন্তু তাকে কাছে টেনে নিতে পারছে না আমার মা, আমার বাবা। এ কোন বাস্তবতা? ঢাকা থেকে মাত্র দুশো পনেরো কিমি দূরত্বে ঝিনাইদহ, কিন্তু আমি যেতে পারছি না। রাস্তাঘাট বন্ধ। এই অসহ-বাস্তবতা লেখা যায়? কোন ভাষায় আমি একে ধরে রাখব? মানুষ আর মানুষের কাছে যেতে পারছে না, একে ভাষায় বর্ণনা করা যায়? কোন ভাষায়? সন্তানকে তার মা কাছে টানতে পারছে না, কী ভয়াল সময়ের তীরে এসে পৌঁছলাম আজ? মন খারাপ হয়। আমি জানি, এরকম মন খারাপের টীকাভাষ্য হয় না। শুধু অসহায়ত্ব নিয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকা সম্ভব। দূরের আকাশের কাছে অপ্রকাশিত গল্পগুলো জমা রাখা সম্ভব। লেখা সম্ভব না। সেই ভাষা আমার জানা নেই।

যে-কোনো প্রান্তরের যে-কোনো করোনাজয়ীকে ভালোবাসা, ভালো থেকো তোমরা। তোমরা বেঁচে না উঠলে তো আমাদের আশাটুকু শেষ হয়ে যায়। আর যারা চলে গেছে, ফিরবে না কোনোদিন, তাদের জন্যে শোকগাথা লিখবে আগামীর কোনো কবি। আমি পারিনি- অপারগতার সেই গ্লানি মাথা পেতে নিলাম। করোনাজয়ী যে-কোনো যোদ্ধার মতো আমার ছোটবোন বীথির জন্যে ভালোবাসা কামনা করি আপনার কাছে। কেন-না আপনি মানুষ, হাজার বিপর্যয়ের মধ্যেও আপনার কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না, আমার কর্তব্য শেষ হয় না। উঠে দাঁড়াতেই হবে, ঘুরে দাঁড়াতেই হবে...

১৮ মে, ২০২০

ধানমন্ডি, ঢাকা

 

ঢাকা/তারা