এই মুহূর্তে বৃষ্টি হচ্ছে খুব! ক’দিন প্রবল গরমের পর এই বৃষ্টিতে ভালো লাগবার কথা, কিন্তু খুব মন খারাপ হয়ে আছে! মন খারাপ গতরাত থেকেই। মন খারাপ কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। কবি চলে গেলেন বৃষ্টির রাতে।
এই মুহূর্তে আমি ঝিনাইদহে এবং আজ, বাংলা একাডেমির বটদ্বীপ মঞ্চে শেষবারের মতো কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর মরদেহ আনা হয়েছে। একটু আগে কবি সরকার আমিনের ফেইসবুক টাইম লাইনে সেই চিত্র দেখছিলাম। সেখানে কবির অনেক গুণগ্রাহী উপস্থিত আছেন। আমি বাড়িতে এসেছি। আজ বাংলা একাডেমিতে থাকতে পারলাম না। অবশ্য কবি সিরাজী ভাই আমার চেতনায় বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন।
একদিন, সেদিনও আমি ঢাকার বাইরে অর্থাৎ এই ঝিনেদাতেই ছিলাম। হয়তো ঈদের ছুটিতে এসেছিলাম। ঈদের পরদিন ঠিক দুপুরে ফোন পেলাম। ফোন করেছেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তখনো তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে জয়েন করেন নি। বললাম, ‘জী, সিরাজী ভাই বলেন।’ কবি বললেন, ‘তোমাকে আমি ফোন করলাম শাকিলের হয়ে। শাকিল আর আমি বসে আছি সাকুরায়। চলে আসো।’ বলি, ‘সিরাজী ভাই আমি ঝিনেদায়। কীভাবে আসব?’
একদিন, কলকাতায় রবীন্দ্র সদন চত্বরে ‘বাংলাদেশ বইমেলা’য় দেখা হলো তরুণ কবি মাহবুবুল হক শাকিলের সঙ্গে। আরো অনেকের সঙ্গে সিরাজী ভাইকেও পেলাম। কথা হলো। এ কথাও হলো যে, এইবার ঢাকায় গিয়ে আমরা সমুদ্রের ধারে বসব। সমুদ্রকে পান করব একসঙ্গে বসে। আমাদের সেই আশা পূর্ণ হয়নি। ঢাকায় ফিরলাম বটে, কিছুদিনের মধ্যেই শাকিল মারা গেলেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জব করতেন শাকিল। কবিতা লিখতেন। প্রচলিত রাজনীতির কেউ কবিতা লিখতে পারে, তাই তো ভাবতে পারি না; শাকিল লিখতেন। চলে গেলেন। শাকিলকে সিরাজী ভাই কবিতায় পুত্র জ্ঞান করতেন; এ তথ্য আমার জানা ছিল। আমাদের সেই তিনজনের আর বসা হয় নি।
একবার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার জন্মদিন উদযাপনে আমি কক্সবাজার যাচ্ছিলাম। ট্রেনের দুইটা কামরা রিজার্ভ আমাদের জন্যে। এক কামরায় পেলাম সিরাজী ভাইকে। তিনি সমুদ্রে যাওয়ার আগেই সামুদ্রিক হয়ে ছিলেন। ট্রেন চলছিল হেলেদুলে। আমরা প্রথমত চট্টগ্রাম যাই, তারপর চট্টগ্রাম থেকে বিপিএল ক্রিকেটের এক দারুণ বাসে যাই কক্সবাজার। কক্সবাজার থেকে দরিয়ানগর। কী এক আনন্দের দিন ছিল আমাদের! সিরাজী ভাইকে নানাভাবে পেয়েছি আমি।
পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার হলে। ‘দুই বাংলার ভালোবাসার কবিতা’ উৎসবে। পেলাম ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে, ইন্ডিয়ান দূতাবাসের আয়োজনে এক রাতের কবিতা উৎসবে। সিরাজী ভাইকে পেলাম রাজশাহীতে, রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার তখন কবি আসাদ মান্নান। তার আমন্ত্রণে আমরা অনেকে রাজশাহী যাই। সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ বা আরো অনেকে ছিলেন। আমরা রাতে রাজশাহী সার্কিট হাউসে ছিলাম। সিলেটে বেঙ্গল সাহিত্য উৎসবে আমাদের কী দারুণ সময় কেটেছে!
ঢাকায় কবি হাবীবুল্লা সিরাজীর সঙ্গে কত জায়গায় কত ভাবে দেখা হয়েছে, হিসাব নেই। জাতীয় কবিতা পরিষদ উৎসবে, পাবলিক লাইব্রেরিতে, নানান পত্রপত্রিকার অনুষ্ঠানে, কত ভাবে!
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হলেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। খুশি হলাম। কারণ, তিনি কবি। কবিদের বড় পদে খুব একটা আসীন হতে দেখা যায় না আমাদের দেশে। সিরাজী ভাই যোগ্যতা রাখতেন একাডেমি পরিচালনার। কবিতার হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সঙ্গে যে বিনিময় ছিল আমার বা কবিতার যে কারো, তার কোনো তুলনা নেই। আমি সেই কবিতায় আকণ্ঠ মাতাল মানুষের সঙ্গ খুঁজেছি আজীবন। যাদের পেয়েছি, সিরাজী ভাই সেই তাদেরই একজন। কবিকে হারিয়ে ফেলে মন খুব খারাপ হয়ে আছে। আকাশজুড়ে মেঘ, বৃষ্টি হচ্ছে। কবি, তোমার জন্যে জমানো কান্না নয় তো আজকের এই বারিধারা?
ক’দিন আগেই, ফেইসবুকে খবর ছড়াল কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী অসুস্থ হয়েছেন; হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। প্রথমে ভেবেছি করোনায় আক্রান্ত হলেন না তো তিনি? না, কর্কট রোগে তিনি আক্রান্ত। চিকিৎসা চলছিল। গতরাতে চলে গেলেন। আর কোনো দিন আমরা তাকে ফিরে পাবো না। ব্যথা জমে থাকল মনে।
বছর তিনেক আগে, একদিন সিরাজী ভাই ফোন করলেন। বললেন, ‘তুমি কোথায়?’ বললাম, ‘ফরাশগঞ্জ।’ ‘পুরান ঢাকায়? ওহ্, সিনেমার কাজ?’ ‘জী।’ ‘শাহবাগ এলাকায় আসবা কবে? তোমাকে আমার একটা কবিতার বই উৎসর্গ করেছি। বইটা নিজ হাতে তোমাকে দিতে চাই।’
আমার সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে, সেই বইটা আর কোনো ভাবেই আমি সিরাজী ভাইয়ের হাত থেকে নিতে পারি নি। আর কোনো দিন নিতে পারবোও না। কবি চিরতরে চলে গেলেন।
মনে হয়, যতই বুয়েটি ইঞ্জিনিয়ার হোন না কেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী জন্মেছিলেন বাংলা কবিতার জন্যেই। যতই তিনি চলে যান না কেন, বাংলা কবিতা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। সেই ক্ষমতার কবিতা তিনি রেখে গেছেন। তবু, খুব ব্যক্তিগতভাবে মনে আমার কিছু দুঃখ থেকেই যাবে, সিরাজী ভাইয়ের সান্নিধ্য, প্রশ্রয় যা পেয়েছি, সেগুলো তো আর পাবো না! কবির জন্যে গোপনে আমার চোখ থেকে লবণজল বেরিয়েই পড়বে। এখন যেমন পড়ছে...
২৫ মে, ঝিনাইদহ