ভোরের আলো ফুটতেই যে ভবনে আসতে শুরু করতো কর্মজীবী মানুষ, প্রতিটি ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়তো কর্মব্যস্ততা, সূর্যের আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তো সেলাই মেশিনের একটানা যান্ত্রিক শব্দ, ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে সেই ভবন আজ জনমানবশূন্য। কর্মজীবী মানুষের সমস্ত কোলাহল শূন্য করে ভবনটিতে এখন বিরাজ করছে ভুতুড়ে পরিবেশ। সেখানে আজও আগুনের লেলিহান শিখায় জমাট বেঁধে আছে আর্তচিৎকার আর মানুষের বাঁচার আকুতি। হাহাকারের সেই স্মৃতি নিয়ে ৯ বছর ধরে তাজরীনের সেই ভবন পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। অন্যান্য দিনের মতো এ দিনও আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। বিকেল গড়িয়ে গোধূলির লাল ছড়িয়ে পড়েছিল পশ্চিম-আকাশে। কিন্তু সেই আবির রাঙানো লাল হঠাৎ মিশে গিয়েছিল তাজরীনে লাগা আগুনের লেলিহান শিখায়। গোধূলির আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল কুণ্ডুলি পাকানো কালো ধোঁয়ায়। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে এ দিন মৃত্যুবরণ করেন ১১৪ জন শ্রমিক। আহত হন আরো প্রায় দুইশ। যাদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে গেছেন। করছেন মানবেতর জীবনযাপন।
ভবনটি আজও সেদিনের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। প্রচণ্ড তাপে বেঁকে যাওয়া জানালার গ্রিল, পুড়ে যাওয়া এডজাস্ট ফ্যানের পাখা, এমনকি আগুনের তাপে খসে পড়া দেয়ালের প্লাস্টার এখনও সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভবনটির চারপাশে আগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলেও এখন জন্মেছে আগাছা। বোঝা যায়, কেউ আর এদিকে আসে না, স্মরণ করতে চায় না সেই বিভৎস দিনের স্মৃতি। তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ভবনটি জানান দিচ্ছে এক নির্মম ইতিহাসের।
এলাকাবাসী জানান, ভবনটির কিছু অংশ ঠিক করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে মালিকের লোকজন আসে। বর্তমানে ভবনের দেখভালের দায়িত্বে আছেন বয়স্ক এক ব্যক্তি। তবে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি তিনি। এমনকি নাম বলতেও তিনি রাজি নন।
ভবনের আশপাশের বাসিন্দারা স্মৃতিচারণ করে জানান, সন্ধ্যার দিকে পোশাক কারখানার নিচ তলার তুলার গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ৮ তলা কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কারখানায় সহস্রাধিক শ্রমিক ছিলেন। তারা জীবন বাঁচাতে ভবন থেকে নামার চেষ্টা করেন। চিৎকার করে সাহায্য চাইতে থাকেন। আজও তাদের কানে বাজে শ্রমিকদের ‘বাঁচাও… বাঁচাও' আর্তনাদ।
তারা জানান, একসময় সকাল হলেই যে কারখানা কর্মব্যস্ততায় মুখরিত থাকতো, অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে সেটি বন্ধ। তেমন কেউ না আসায় সবসময় জায়গাটিতে নীরবতা বিরাজ করে। দূর থেকে মনে হয় ভুতুড়ে বাড়ি।
এ দিকে ভবনটিতে সরকারিভাবে শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল ও ডরমেটরি নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র সাভার-আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক খাইরুল মামুন বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যখন জীবন বাঁচাতে শ্রমিকরা চিৎকার করছিলেন, তখনও মালিক দেলোয়ার হোসেন কারখানা থেকে বের হওয়ার সবগুলো গেট খুলে দেননি। তালা লাগিয়ে রেখেছিলেন। প্রাণে বাঁচাতে শ্রমিকদের অনেকে সেদিন ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে লাফ দিয়েছেন।
যে কারণে এই ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বর্ণনা করে আইএলও কনভেনশন-১২১ অনুসারে শ্রমিকদের সারাজীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ প্রদান, পুনর্বাসনসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা এবং ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের সন্তানদের লেখাপড়া নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
আরও পড়ুন
তাজরীনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন জরিনা, মানবেতর জীবন
তাজরিন ট্রাজেডির ৯ বছর: নিহত শ্রমিকদের স্মরণে শ্রদ্ধা