পরপর দুই বার বঙ্গোপসাগরে জেলে বহরে জলদস্যুদের হামলায় আতঙ্কিত হয়ে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে ফিরছে উপকূলের জেলেরা। গত এক মাসে বিচ্ছিন্নভাবে ১০টি ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। জেলেরা বলছেন, দস্যুদের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে ফিরছেন তারা। ট্রলার মালিকরা বলছেন, সাগরে মাছ শিকার করতে নামলেই বেড়ে যায় দস্যুদের উৎপাত। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ধস নামবে মৎস্য ব্যবসায়। আড়ৎদার-পাইকাররা বলছেন, দস্যু দমনে এখনই ব্যবস্থা না নিলে সারা দেশে বাড়বে মাছের দাম।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরে বরগুনার এফবি ভাই ভাই নামে মাছ ধরার ট্রলারে আক্রমণ চালায় সশস্ত্র জলদস্যুরা। এ সময় ট্রলারে থাকা ১৮ জেলের মধ্যে ৯ জনকে কুপিয়ে জখম করে। গুলিবিদ্ধ হয় একজন। বাকি ৯ জেলে জীবন বাঁচাতে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ হয়। ঘটনার তিন দিন পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় ৪ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করে জেলেরা। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। এরপর নিখোঁজ অন্য ৫ জেলের মধ্যে দুই জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয় ১ মার্চ। এখনও সন্ধান মেলেনি তিন জেলের।
এই হামলার আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই ফের বঙ্গোপসাগরে ঘটেছে ডাকাতের ঘটনা।
গত শনিবার (৪ মার্চ) বেলা ১২টার দিকে বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য বন্দর থেকে ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গোপসাগরে গভীরে ডাকাতি হয়। পাথরঘাটার বাদশাহর মালিকানাধীন এফবি ভাই ভাই ট্রলারে আক্রমণ করে ডাকাতরা। এতে ওই ট্রলারের আট জেলেকে জিম্মি করে মারধর করে মাছ, জালদড়ি, তেল, মোটর, সেলফ, ব্যাটারিসহ ২০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
একের পর এক দস্যুদের হামলা ও লুটের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে উপকূলের জেলেরা।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক জলদস্যদের হামলায় আহত এক জেলে ডাকাতির ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমানে জলদস্যু বাহিনী খুব ভয়ংকর। নতুন নতুন বিদেশি অস্ত্র নিয়ে জেলে বহরে ডাকাতি করে তারা। মাছ ও মালামাল লুট করে জেলেদের হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করে। তাই বাধ্য হয়ে সাগরে মাছ শিকার করা বন্ধ করে দিয়েছেন তারা।
মাঝি আমির হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, দস্যু বাহিনীগুলো এখন অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ডাকাতি করে। র্যাবের তৎপরতা ও অভিযান না বাড়ালে দস্যু দমন করা সম্ভব না।
ট্রলার মালিক আবুল হোসেন ফরাজী রাইজিংবিডিকে বলেন, জেলেরা ভয়ে সাগরে যেতে চাচ্ছে না। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ঘাটে অন্তত ৮ শতাধিক ট্রলার অবতরণ করে আছে। সাগরে সব সময় মাছ পাওয়া যায় না। যখন সাগরে মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তখনই জলদস্যুদের উৎপাত বেড়ে যায়। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ট্রলার মালিকদের পথে বসতে হবে। ধস নামবে মৎস্য ব্যবসায়।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের পাইকার আবুল কালাম, মো. সুলতান, আড়ৎদার সোহাগ মিয়া, মুস্তাফিজুর রহমানসহ অসংখ্য ব্যবসায়ীরা বলেন, অনেক জেলে সাগরে যাচ্ছে না, তাই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছের সংখ্যা দিন দিন কমছে। যে কারণে সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে পাইকারি বাজারে। এর প্রভাব পড়বে সারা দেশে।
বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সাগরে এখন মাছ শিকারের পরিবেশ নেই। গত এক মাসে ১০ বার গভীর বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের হামলার শিকার হয়েছে জেলেরা। এতে নিহত হয়েছে তিন জেলে, এখনও নিখোঁজ তিন জেলে। আহত হয়েছে অন্তত ৯০ জেলে। লুট করা হয়েছে দেড় কোটি টাকার মাছ ও রসদ। আমরা র্যাব ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে জেলেরা এখনও ভরসা করতে পারছে না।’
এ বিষয়ে দক্ষিণ স্টেশন কোস্টগার্ড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট শাফায়াত আবরার রাইজিংবিডিকে বলেন, বঙ্গোপসাগরে দস্যু দমনে টহল জোরদার করেছেন তারা।
বরিশাল র্যাব-৮ কোম্পানি কমান্ডার তুহিন রেজা রাইজিংবিডিকে বলেন, দস্যু দমনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।