সারা বাংলা

যৌবন ফিরে পেয়েছে সবুজ পাহাড়, তবুও নেই পর্যটক 

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির পর্যটন খাত। গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, পরবর্তীতে  বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা এবং সম্প্রতি সহিংসতার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। এসব ঘটনায় গত তিন মাস রাঙামাটি প্রায় পর্যটক শূন্য। ফলে চরম হতাশায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট  ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। 

জানা গেছে, জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে। গত পাঁচ আগস্ট সরকার পতনের পর বন্যা ও ভারী বৃষ্টিপাতে কাপ্তাই লেকের পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। ডুবে যায় রাঙামাটির অন্যতম আকর্ষণীয় ঝুলন্ত সেতু। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে পর্যটন ব্যবসায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেটে না উঠতেই পাহাড় আবারও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাহাড়ি-বাঙালি সহিংসতার ঘটনায়। এ ঘটনায় জানমালের ক্ষতি হলেও দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব পড়ে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এখনো হ্রদের পানিতে ডুবে আছে ঝুলন্ত সেতু। জেলার সবগুলো পর্যটন স্পট পর্যটক শূন্য।

সরেজমিনে দেখা যায়, বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পানিতে চির-চেনা ভরা যৌবন ফিরে পেয়েছে সবুজ পাহাড় ও কাপ্তাই লেক। যেদিকে দুই চোখ যায়, দেখা মেলে সবুজ চাদরে মোড়ানো পাহাড়। এই পাহাড়গুলো কাপ্তাই হ্রদকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। যে কেউ এই দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবেন। প্রকৃতি তার নিজস্ব রূপে ফিরলেও পাহাড়ি ঢল ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে টইটুম্বুর কাপ্তাই হ্রদ।

রাঙামাটির সদর উপজেলার তবলছড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ডুবে আছে রাঙামাটির আইকন ঝুলন্ত সেতু। সেতু ঘিরে গড়ে উঠেছে শতাধিক ভাসমান দোকান। পর্যটক না থাকায় এসব দোকানে কাজ করা ব্যক্তিদের অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদের তীর ঘেঁষে নিরবে দাঁড়িয়ে আছে শত শত ট্যুরিষ্ট বোট। নীল আকাশ আর কাপ্তাই হ্রদের জলরাশির মিতালীতে পাহাড়ের সৌন্দর্য যেন আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। পাহাড় যেন কাপ্তাই হ্রদকে ঘিরে রেখেছে সবুজ চাদরে। 

পর্যটক না থাকায় নোঙর করে রাখা হয়েছে ট্যুরিস্ট বোটগুলো

রাঙামাটি পর্যটনের ট্যুারিষ্ট বোট চালক মো. আলমগীর বলেন, ‘এক মাস ধরে কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ডুবে আছে ঝুলন্ত সেতু। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় এবং পাহাড়ে  সংঘর্ষের কারণে কোনো পর্যটক নেই। ফলে আমরা খুবই কষ্টে আছি।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘প্রতি বছরই কাপ্তাই হ্রদের পানি বেড়ে গেলে ব্রিজটি ডুবে যায়। পর্যটন কর্তৃপক্ষ যদি সংস্কার করে আরো উঁচুতে ব্রিজটি তৈরি করেন, তাহলে সেটি আর পানিতে তলিয়ে যাবে না।’

বনানী টেক্সটাইলের ম্যানেজার টিনা চাকমা জানান, ঝুলন্ত সেতুটি ডুবে যাওয়ায় অনেক পর্যটক এসে ফিরে গেছে। তাদের কোনো পণ্যের বেচাবিক্রি নেই। প্রতি বছরই সেতুটি ডুবে যায়। ফলে ব্যবসায় লোকসান হয়। যদি সেতু থেকে পানি নেমে যায় তাহলে পর্যটকরা আসতে শুরু করবেন, বেচাকেনা শুরু হবে। 

ট্যুরিষ্ট বোট মালিক আব্দুর সবুর জানান, ‘ছাত্র আন্দোলন এবং পাহাড়ে সহিংসতার কারণে রাঙামাটিতে কোনো পর্যটক নেই। আগে এখানে দুই লাখ টাকার মতো ব্যবসা-বাণিজ্য হতো। এখন ২ টাকার বেচাকেনা নেই। এখানে প্রায় শতাধিক ভাসমান দোকান বন্ধ রয়েছে।’

পানিতে টইটুম্বুর কাপ্তাই হ্রদ

এদিকে, মেঘের বাড়ি খ্যাত সাজেক পর্যটন কেন্দ্রেও আশানুরূপ পর্যটকের সমাগম হচ্ছে না। সাজেক কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি সুপর্ণ দেব বমর্ণ বলেন, প্রতিবছর  জুলাই মাস থেকে এই স্পটে পর্যটকের আগমন ঘটে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কারণে তেমন পর্যটকের আগমন ঘটেনি। লোকসানে রয়েছেন রির্সোট ও কটেজ মালিক ব্যবসায়ীরা।’ 

বর্তমানে সাজেকে ১২৭টি রিসোর্ট এবং ১১৬টি রেস্টেুরেন্ট রয়েছে। ব্যবসায় লোকসানের কারণে অনেক কর্মচারী ছাঁটাই করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

রাঙামাটি  আবাসিক হোটেল সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মঈন উদ্দিন সেলিম জানান, গত দুই-তিন মাসে রাঙামাটিতে তেমন কোনো পর্যটকের আগমন ঘটেনি। আবাসিক হোটেলগুলোতে বুকিং নেই। কয়েক কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

রাঙামাটি পর্যটন ও হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা জানান, গত ২৩ আগস্ট থেকে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু পানিতে নিমজ্জিত। এখনো সেতুর পাটাতন পানিতে ডুবে আছে। আশাকরি, কয়েকদিনের মধ্যে সেতুর পাটাতনের পানি শুকিয়ে যাবে।  আবারো পর্যটকরা সেতুর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম বলেন, রাঙামাটিতে পর্যটন খাত কীভাবে উন্নত করা যায় এবং সমস্যাগুলো দূর করা যায় সেটা নিয়ে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্তের প্রয়োজন আছে। নতুন পরিষদ গঠন না হওয়া পর্যন্ত আর্থিক খাতগুলো বন্ধ রয়েছে। তাই আপাতত কিছুই করা যাচ্ছে না।

এদিকে, শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে রাঙামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের অডিটোরিয়ামে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘ট্যুরিজন এন্ড পিস’ অর্থাৎ ‘পর্যটন শান্তির সোপান’। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন- রাঙামাটি  পার্বত্য জেলা  পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার মোহাম্মদ রিজাউল করিম, রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর মো. শামীম হোসেন। বোট চালক সমিতি, অটোরিকশা চালক সমিতি, রিসোর্ট মালিক সমিতির নেতারা।