সময়টা ছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। কোরবানি ঈদের দিন সকালে শামীম রেজওয়ান ফোনে বললেন, ছবি তুলতে কোথাও যাবেন? আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমার সম্মতি পেয়ে সেদিন রাতের বাসের টিকিট কাটা হলো। অনেকটা হুট করেই কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে যাওয়ার পরিকল্পনা। রাত ১১টার বাসে উঠে ভোর ৫টায় চট্রগ্রাম পৌঁছালাম। আগে থেকেই বাস কাউন্টারে অপেক্ষায় ছিলেন ডাক্তার শাহীদ। তিনিও আমাদের সঙ্গী হলেন।
সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে আমরা তিনজন কাপ্তাইয়ের দিকে রওনা হলাম। কিছুটা পথ পাড়ি দেবার পর হঠাৎ বিকট শব্দে আমাদের বহনকারী অটোরিকশা রোড ডিভাইডারে সজোরে আঘাত করলো। তিনজনই দ্রুত পায়ে নামলাম। ডিভাইডারে ধাক্কা লাগার কারণ জানতে চেয়ে জানা গেল চালক দুই রাত নির্ঘুম ছিলেন। যাই হোক, সে যাত্রায় বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পাই।
কাপ্তাই মোড়ে অটোরিকশা পরিবর্তন করে জাতীয় উদ্যানের উদ্দ্যেশে রওনা হলাম। সকাল ৮টায় আমরা বন বিভাগের রেস্ট হাউজে মালপত্র রেখে বড়ছড়ায় গেলাম। সামান্য পানিতে পাথরের উপর দিয়ে হাঁটছি আর নানা প্রজাতির পাখির ছবি তুলছি। প্রায় ৫কিলোমিটার পথ ভেতরে ঢোকার পর বন্য হাতির তাজা মল দেখতে পেলাম। সতীর্থদের বললাম আর সামনে যাওয়া নিরাপদ মনে হচ্ছে না। কিন্তু তখন সবাই ছবি তোলার নেশায় মত্ত থাকায় ভয় কাজ করেনি। কিছুটা পথ যাওয়ার পর বন্যহাতি নজরে পড়লো। ভয়ে যে যার মতো দিলাম দৌড়। গাছের লতা-গুল্ম ধরে একটা উঁচু টিলায় উঠে নিজেকে আড়াল করলাম। সেই যাত্রায় বন্যহাতির হাত থেকে প্রাণে রক্ষা পেয়ে রেস্ট হাউজে ফিরলাম।
পরদিন ভোরে আমরা ব্যাঙছড়ায় গেলাম। দুর্গম পাহাড়ি পথে হাঁটছি। একটা ছোট ছড়া পার হয়ে অপর প্রান্তে গেলাম। পাহাড়ের ঢালে কলাবাগান ও ধান ক্ষেত। ধান ক্ষেতে সাদা কোমর মুনিয়ার ছবি তুলছিলাম। এমন সময় কলাপাতায় একটি ছোট পাখি বসলো। প্রথমে ভাবলাম টুনটুনি। কাপ্তাইয়ে লোকালয়ে টুনটুনির বাইরেও বেশ কয়েক প্রজাতির টুনটুনি আছে।পাখিটিকে দেখে কৌতূহল বেড়ে গেলো। ক্যামেরা তাক করে ভিউফাইন্ডারে দেখলাম অন্য প্রজাতির এক পাখি। আনন্দে মন নেচে উঠল। বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম। পরে পাখিটির পরিচয় জানলাম। আমার সংগ্রহে নতুন আরেকটি পাখি যোগ হলো।
বুনো টুনি ১০-১২ সে.মি. দৈর্ঘ্য ও ৬ গ্রাম ওজনের প্রিনিয়া বংশের সিস্টোলিডি পরিবারের অন্তর্গত একটি ছোট তৃণচারী পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠের দিক জলপাই-বাদামি। দেহের নিচের দিক সাদা। বুক ধুসর। তলপেট পীতাভ বর্নের। চোখ অনুজ্জ্বল সামান্য বাদামি-কমলা। ঠোঁট কালো। ডানা ও লেজের প্রান্তদেশ লালচে। পা ও পায়ের পাতা হলুদ থেকে সামান্য বাদামি। নখ কালো। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারায় ভিন্নতা রয়েছে। বুনো টুনি সাধারণত আবাদি জমির ধারের বৃক্ষতলে জন্মানো লতাগুল্ম, ছোট ছোট ঝোঁপসমৃদ্ধ তৃণভূমি, বাঁশবন ও চাষের জন্য পরিষ্কার জায়গায় বিচরণ করে।
এরা দলবদ্ধ পাখি। সচারচর ছোট ঝাঁকে থাকতে দেখা যায়। এরা মাটিতে খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে পোকা, শুয়োপোকা ও ফুলের মধু। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস এদের প্রজননকাল। প্রজননকালে পত্রগুচ্ছে পাতা, ঘাস ও আঁশ দিয়ে কলার মোচার মতো বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়েপাখিটি ৩-৪টি ডিম পাড়ে। উভয়ে মিলে ডিমে তা দেয়। ১১-১৫ দিনের মধ্যে ডিম থেকে ছানা বের হয়। মা-বাবা দুজনে মিলে ছানাদের পরিচর্যা থেকে সংসারের সব কাজ করে।
বুনো টুনি বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ঢাকা ও সিলেট বিভাগে বনে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও মিয়ানমারসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। এরা বিশ্বে ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বাংলা নাম: বুনো টুনি। ইংরেজি নাম: Grey-breasted Prinia বৈজ্ঞানিক নাম: Prinia hodgsonii (Blyth, 1844)