সিংহাসনে আরোহনের প্রথম দিনেই সুলতান সুলেমান বলেছিলেন, ‘‘ আপনাদের কী ধারণা আছে মানচিত্র এখানে কেন এনেছি? এই মানচিত্র দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে। আমাদের সাম্রাজ্য শুধু বলকানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বেলগ্রেড, রোম, বুদাপেষ্টে আমাদের তরবারি ঝলসে উঠবে। আমাদের আঘাতে পড়াস্ত হবে ইউরোপিয়ানরা। আমরা পাড়ি দেব কাস্পিয়ান সাগর, আমরা পাড়ি দেব ভূমধ্যসাগর। রোমান সম্রাট চার্লস, ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিস হ্যান্ডিটকে আমরা শায়েস্তা করব। ভূমধ্যসাগর থাকবে আমাদের করতলে। আমাদের অনুমতি ছাড়া কোন জাহাজ পাল তুলবে না, কোন জাহাজ নোঙর ফেলবে না।’’
সুলতান সুলেমান, যার পুরো নাম সুলতান সুলেমান আল-কানুনী আল উসমানী। তিনটি মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল যার সাম্রাজ্য। ছয় চল্লিশ বছরের শাসন পরিচালনাকালে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন প্রায় ১০ বছর। তিনি ১৩টি যুদ্ধে স্বশরীর অংশ নিয়েছিলেন। তাকে বলা হয় সর্বকালের সেরা সুলতানদের একজন। তার পিতা যে সাম্রাজ্য রেখে গিয়েছিলেন সেটি ছিল ৬৫ লক্ষ ৫৭ হাজার কিলোমিটার পর্যস্ত বিস্তৃত। সুলতান সুলেমান সেই সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করেছিলেন ১ কোটি ৬৮ লক্ষ ১৩ হাজার কিলোমিটারে। তিনি ছিলেন দশম অটোম্যান সুলতান। ইসলামী আইন অনুযায়ী সাম্রাজ্যের আইন সংস্কারের কারণে তার নাম হয়েছে আল-কানুনী। পশ্চিমারা তাকে নাম দিয়েছে সোলেমান দা ম্যাগনিফিসেন্ট।
বেলগ্রেড হয়ে উঠেছিল হাঙ্গেরি আক্রমণের ঘাঁটি
সুলতান সুলেমানের জন্ম ছয় নভেম্বর, ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে ট্রেন্ডিফোন শহরে। তার পিতা সুলতান প্রথম সেলিম, যিনি মামলুক সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে মিশরকে অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তার মা হাফসা সুলতানা ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান।
সুলতান সুলেমান বেড়ে উঠেছেন ৮-১০ তুর্কি শাহজাদার মতোই। সাত বছর বয়সে তাকে তোপকাপি প্রাসাদের পাঠশালায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি সাহিত্য, বিজ্ঞান, সামরিক, ইতিহাস বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিদ্যা লাভ করেন। ১৪ বছর বয়সে দাদা সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ তাকে কারাইসার শহরে গর্ভনর হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু চাচা শাহজাদা আহমেদের বিরোধীতার কারণে তার এই নিয়োগ বাতিল করে তাকে ক্রিমিয়ার থিউডোসিয়াতে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি তিন বছর অবস্থান করেন। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর সুলতান প্রথম সেলিম ইন্তেকাল করেন। শাহজাদা সুলেমান তখন ম্যাগনেসিয়ায় অবস্থান করছিলেন। উজির আজম পীরে পাশা সুলতান এর মৃত্যু সংবাদ গোপন রেখে শ্যামবাগার কাছে পত্র লিখে দ্রুত তাকে রাজধানীতে ফেরার আদেশ দেন। পীর পাশার আশা ছিল তিনি সাত দিন সুলতানের মৃত্যুর খবর গোপন রাখতে পারবেন। তার আশঙ্কা ছিল সুলতানের মৃত্যুর খবর জেনে গেলে জেনিসারিরা বিদ্রোহ করে বসবে। যাদের দমন করা কঠিন হবে তরুণ শাহজাদার জন্য। কঠিন গোপনীয়তার পরও ৫ দিন পর সুলতানের মৃত্যুর খবর জানাজানি হয়ে যায়। এরপর পীরে পাশা স্বীকার করেন যে সুলতান ইন্তেকাল করেছেন। যদিও এরপর জেনিসারিরা কোনো গোলযোগ বাঁধায়নি। বরঞ্চ তারা শোক প্রকাশ করছিল। ৩০ সেপ্টেম্বর সুলাইমান বসফরাস প্রণালীর উপকূলে এসে পৌঁছান এবং এখানে উজিরে আজম পীরে পাশা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। পরদিন আলেম-ওলামা অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ সুলতান সুলেমানকে স্বাগত জানান। সুলেমানের আর কোন ভাই জীবিত ছিলেন না তাই শাসন ক্ষমতার জন্য আর তাকে কোন বিশেষ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি।
শাইখুল ইসলাম সুলেমানের হাত ধরে তাকে একটি মঞ্চে নিয়ে আসেন। এবং ‘সুলতান’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর তিনি সুলতানের কোমরে ঐতিহ্যবাহী তরবারি বেঁধে দেন। এ সময় সুলেমানের বয়স ছিল ২৯ বছর। এর কিছুদিন পর ভেনিসীয় দূত সুলতানের সাথে দেখা করেন তার বর্ণনা মতে সুলতানের দেহ ছিল লম্বা ও সরু, পল্লব ছিল ঘন এবং তাকে দেখতে বন্ধু সুলভ মনে হতো।
ঐতিহাসিকগণ মন্তব্য করেন, দিনের শুরু দেখে বোঝা যায় দিনের শেষটি কেমন হবে। সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী খ্রিস্টানদের থেকে শুধু মসজিদুল আকসা কেড়ে নিয়েছেন কিন্তু সুলতান সুলেমান আর কয়েকদিন জীবিত থাকলে তাদের পায়ের নিচ থেকে পুরো ইউরোপই ছিনিয়ে নিতেন।।
ক্ষমতায় বসার পরপরই তার কাছে রাজ্য জয় এর হাতছানি আসে। হাঙ্গেরিতে রাজস্ব সংগ্রহের নিয়োজিত অটোম্যান কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যা সুলতান সুলেমানকে ক্রোধান্বিত করে তোলে। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন হাঙ্গেরিতে অভিযান চালাবেন। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দের পুরো শীতকাল কনস্টান্টিনোপলে চলে যুদ্ধের মহড়া। সেনাবাহিনীর জন্য সংগ্রহ করা হয় রসদ ও ঘোড়া। সেনাবাহিনীর যাত্রা পথে নির্মাণ করা হয় সড়ক ও সেতু। সুলতানের লক্ষ্য ছিল দানিয়বের প্রবেশদ্বার বেলগ্রেড। বেলগ্রেড দুর্গের পতন ঘটলে অটোম্যান সেনাদের ভিয়েনা ও ভিজা উপত্যকা উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
(চলবে)