প্রায় ১৭ বছর চাকরি করেছেন দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে। বেতনের অংকটাও ছিল মোটাসোটা। তবে মোটরসাইকেলের প্রতি আসক্তি এবং দেশের সার্ভিস সেন্টারগুলোর বেহাল দশা দেখে সেই মোটা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে খুলে বসলেন মোটরসাইকেলের সার্ভিস সেন্টার। যার কথা বলছি, তিনি বাংলাদেশে মোটরসাইকেলের অত্যাধুনিক সার্ভিস সেন্টার প্রতিষ্ঠার অগ্রসেনানী। সবার কাছে সাইফ নামেই পরিচিতি তিনি। আসুন তার জবানিতেই শুনি সেই সার্ভিস সেন্টার প্রতিষ্ঠার গল্প।
আমার পুরো নাম মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন। ১৯৮৩ সালে ঢাকার লালবাগে আমার জন্ম। সহজ কথায়, আমরা হচ্ছি ঢাকাইয়া, তাই পৈত্রিক সূত্রেই আমরা অনেক কিছুর সাথে ‘ফ্রিতে’ পেয়েছিলাম দালানকোঠার এই শহর। ছোটবেলায় যা একটু খেলাধুলা করেছিলাম, কিন্তু কৈশোরের শেষ দিকে, তাও আর টানেনি। বরঞ্চ বই পড়তে অনেক ভালো লাগত; দুটি লাইব্রেরি থেকে শ্রেষ্ঠ পাঠক হিসাবে পুরস্কারও পেয়েছিলাম পরপর দুই বছর। অনেকে এটা শোনার পর হয়তো ভাববেন, আমি খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। বাস্তবে ছিলাম উল্টোটা। তাই কৈশোর পর্যন্ত কখনোই ভালো রেজাল্ট করা হয়নি। তবে গ্র্যাজুয়েশয়ানের সময় পুঁথিগত বিদ্যায় মনোযোগী হওয়ার তাড়না জন্ম নিয়েছিল। তাই বিবিএতে একটু ভালো রেজাল্ট করা হয়ে ওঠে। ২০০৬ সালে অল্প অল্প করে কর্মজীবনে প্রবেশ শুরু হয়।
শুরুটা করেছিলাম অ্যাডভ্যারাটাইজিং এজেন্সিতে গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসাবে। পররবর্তীতে স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানার হিসাবে পদোন্নতি হয় এবং ২০২২ সালে শেষ হয় ‘হেড অব ব্র্যান্ড’ হিসাবে। ২০০৮ সালে সংসার জীবনে প্রবেশ। সুখ-দুঃখের ভাগীদার হিসাবে চমৎকার একজন অর্ধাঙ্গিনী পেয়েছি, যিনি আমার কঠিন সময়ে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে সাহস জোগান।
কর্মজীবন শুরুতে দ্রুত যাতায়াতের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল মোটর সাইকেলের। ওই সময় থেকেই একটি আধুনিক মটোরসাইকেল ওয়ার্কশপ গড়ে তোলার পোকাটা মাথায় ঘুরতে শুরু করে। ২০১০ সালে প্রথম ইয়ামাহার EFI (Electronic Fuel Injection)মোটর সাইকেল আমাদের হাতের নাগালে আসে। ওই সময় থেকে বুঝতে পারছিলাম, প্রচলিত ওয়ার্কশপে এই বাইকগুলোর সার্ভিস করানো সম্ভব না। ২০১৬ সালের দিকে আমরা এই বাইকগুলোর সার্ভিসের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি শুরু করি। কিন্তু কোথাও প্রয়োজনীয় সার্ভিস পাচ্ছিলাম না। তাই নিজেই এই প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। এ সময় বাইক কমিউনিটির সঙ্গেও মেলামেশা শুরু হয়। আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় নতুন এক গল্প।
২০১৬ সালে আমাদের বাইক কমিউনিটির প্রধান কাজ ছিল আধুনিক প্রযুক্তির বাইকগুলো নিয়ে আলোচনা করা এবং সমস্যার সমাধান করা। সেখান থেকেই নতুন বন্ধু বানানো এবং সারাদেশে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো শুরু। তখন আমরা আমাদের এই গ্রুপটার নাম দিয়েছিলাম ‘FI Club Bangladesh।’ ২০১৭ সালের দিকে দেশে মোটর সাইকেল কমিউনিটি গড়ার জোয়ার শুরু হয়। ওই সময় ‘FI Club Bangladesh’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। কারণ, আমরা তখন এই ধরনের বাইকারদের কাউন্সিলিংয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানিতে গিয়ে অ্যাডভান্স লেভেলের সার্ভিসের ব্যাপারে তাদের তাগাদা দিতে শুরু করি। এর ফলশ্রুতিতে আমরা ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে রাখলাম ‘ফ্রি হুইলার্স ক্লাব বিডি।’ ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট বাংলাদেশের প্রথম বাইকার্স ‘রেজিস্টার্ড ক্লাব’ এর মর্যাদা পাই আমরা।
এখানেই কিন্তু গল্পের শেষ নয়। ২০১৭ সাল থেকেই আমার মাথায় চেপে বসে একটি আধুনিক মোটরসাইকেল ওয়ার্কশপ চালু করার। আমি কিংবা আমার কমিউনিটির মানুষগুলো বাইক নিয়ে যে সমস্যায় জর্জরিত ছিলাম, সেই ভোগান্তিতে যেন আর কাউকে পড়তে না হয় সেটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ওই সময়ে আমি মোটা অংকের বেতন পেতাম। তাই মোটা মাইনের নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে সার্ভিস সেন্টার খুলে বসার মতো সাহস হচ্ছিল না।
আধুনিক ওয়ার্কশপ শুরু করার সাহস জুগিয়েছিল শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রী। সে-ই ছিল আমার ওয়ার্কশপ খোলার মূল অর্থের যোগানদাতা। ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মটো ডক নামের এই অত্যাধুনিক সার্ভিস সেন্টারটি চালু করি। প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরুর ছয় মাস পর চাকরি ছেড়ে দেই।
মটো ডকে রয়েছে প্রায় ২৭ রকমের আধুনিক যন্ত্রপাতি। এর বেশিরভাগই আনা হয়েছে বিদেশ থেকে। এগুলোর মধ্যে এমন যন্ত্রাংশও রয়েছে যেগুলো এশিয়ার বাজারে পাওয়া না যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনতে হয়েছে। মটো ডক আরও সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য দুজন অংশীদারকে যুক্ত করেছে। এদের এক জন আবু বাকার সিদ্দিক রবিন। তিনি বর্তমানে মটো ডকের অপারেশন্সে রয়েছেন। পার্টস ও এক্সেসরিজের বিষয়ে প্রায় ২২ বছরের অভিজ্ঞতা তার। দ্বিতীয় জন হচ্ছেন, মাহবুব ই ইলাহি অমিত। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অমিত মটো ডকের টেকনিক্যাল ডিভিশন পরিচালনা করছেন।
আমাদের এখন অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা। এখানে শুধুমাত্র মোটরসাইকেলের বিষয়ে মানুষকে হাতেকলমে শেখানো হবে। কারণ আমরা বুঝতে পারছি, ভবিষ্যতে যেসব প্রযুক্তির মোটর সাইকেল দেশের বাজারে প্রবেশ করবে, তা অধিকাংশ টেকনিশিয়ানই সামাল দিতে পারবেন না। এর ফলে বড় একটি জনবল অকালেই হারিয়ে যাবে। সেই মানুষগুলোকে যোগ্য করে তোলার প্রয়াসেই একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।