তিনি প্রাচ্যের অক্সেফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। একাডেমিক পড়াশোনা শেষে কোনো এক পেক্ষাপটে নতুন বিষয়ে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হলো তার।
আগ্রহের বিষয় ছিল শেয়ারবাজার। সেই থেকে শুরু হলো শেয়ারবাজার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া এবং জানা। তারপর বিনিয়োগ শুরু করলেন শেয়ারবাজারে। এক পর্যায়ে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্য পদ নিলেন।
একজন নারীর পক্ষে এই পথ পাড়ি দেওয়া খুব সহজ নয়। চলার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে দিয়ে সাহস নিয়ে এগিয়ে চলেছেন তিনি। মনোনীত হয়েছেন ডিএসইর পরিচালক। পরবর্তীতে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালক পদে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শেয়ারবাজারে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি হলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক নির্বাচিত পরিচালক এবং মডার্ন সিকিউরিটিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি)।
শুধু শেয়ারবাজারেই নয়, রাজনৈতিক অঙ্গনেও তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ২০১৯-২০২১ সালের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
রাইজিংবিডিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নারীর সক্ষমতা, ক্ষমতায়ন, শেয়ারবাজারে নারীর অংশগ্রহণসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডি’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজমুল ইসলাম ফারুক।
রাইজিংবিডি: শেয়ারবাজারে আসার পেক্ষাপট সম্পর্কে বলুন।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): আমি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছি। শেয়ারবাজার নিয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমার স্বামীর শেয়ারবাজারে কিছু বিনিয়োগ ছিল। ১৯৯৬ সালে যখন ধস হলো, তখন তা জানতে পারি। এর কিছুদিন আগে আমাদের বিয়ে হয়, আমাদের তখন অল্প বয়স। ৯৬ সালের ধসের পর শেয়ারবাজার আসলে কি তা জানার আগ্রহ হলো। এরপর এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করি এবং পড়াশোনা করি। ১৯৯৯ সালে আমার বাবা কিছু অর্থ দিয়েছিল, যা দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করি। পরবর্তীতে আমার স্বামী আমাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছে। তবে শুরু থেকে পুরো কাজগুলো আমি একাই করেছি।
রাইজিংবিডি: ব্যবসা করতে গিয়ে কি ধরনের প্রতিবন্ধকতায় পড়েছেন?
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): প্রথমে দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রতিবন্ধকতা। ইয়াং একটা মেয়ে এখানে এসেছে (শেয়ারবাজারে) সেটা তো কেউ সহজে মানতেই পারতো না। পুরুষদের অহংয়ে লাগতো। এটা তো পুরুষদের জায়গা, একটা মেয়ে কেন আসবে? স্বামী মারা গেলে উত্তরাধিকার হিসেবে স্ত্রী আসতে পারে কিন্তু একজন ইয়াং মেয়ে হিসেবে শেয়ারবাজারে আসার সাহস দেখায় কি করে? আসছে, তবে টিকতে পারবে না, দুই দিন পর চলে যাবে—এমন মনোভাব পুরুষদের ছিল। এমনকি যখন ডিএসইর পরিচালক পদে সরাসরি নির্বাচনে প্রার্থী হলাম তখনও বিভিন্ন জন নানা কথা শুনিয়েছে। তারপরও আত্মবিশ্বাস ছিল। এরপর ডিএসইর পরিচালক পদে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছি।
রাইজিংবিডি: নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কিভাবে সফল হলেন?
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এসেছি। সেখানে পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেছি। আমি নারী- এ শব্দ আমার অভিধানে নেই। সব সময় নিজেকে মানুষ মনে করেছি। আমার মেধা আছে, শ্রম দিতে পারি, আমি টিকে যাবো-এই ছিল আত্মবিশ্বাস। কে কি বললো তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। এভাবেই সামনের দিকে এগিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ আমি টিকে গেছি।
রাইজিংবিডি: নারী-পুরুষের বৈষম্য এবং শেয়ারবাজারে নারীর কাজের পরিবেশ সম্পর্কে বলুন।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): নারী-পুরুষ বৈষম্যে আমি বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি না যে, পুরুষ এটা পারে, আমি এটা পারবো না। নারীর কাজ করার জন্য যে পরিবেশ দরকার, তা শেয়ারবাজারে আছে। আগে বিনিয়োগকারীরা মনে করতো, শেয়ারবাজার নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। এই ধারণা আমরা ভেঙে দিতে পেরেছি। এতো বছর ধরে আছি, নারীদের কোনো ধরনের অসুবিধা হতে দেখিনি। আমাদের অফিসে নারীদের জন্য আলাদা বুথের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু নারীরা পুরুষদের সঙ্গে কাজ করতে সাচ্ছন্দবোধ করে।
রাইজিংবিডি: ব্যবসা বাণিজ্যে বিশেষ করে শেয়ার ব্যবসায় নারীদের প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ কি?
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): দেশে নারীরা যতই পড়াশোনা করুক, পুরুষ শাসিত সমাজ নারীর ওপর ভরসা করতে পারে না— এটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। শেয়ারবাজারে আসতে হলে মেধা ও মূলধন প্রয়োজন। মেধা নারীর আছে কিন্তু সহজে মূলধন পায় না। নারীকে মূলধন তার বাবার নিকট বা স্বামীর নিকট থেকে নিতে হয়। নারীর ওপর ভরসা কম থাকায় সেই ধরনের সহযোগিতা কম পাওয়া যায়। বাবা মনে করে মেয়েকে না দিয়ে ছেলেকে দেই। স্বামী মনে করে স্ত্রীকে মূলধন দেবো? সে কতটুকু বুঝবে, তার চেয়ে আমিই শুরু করি। এই বৈষম্যটা এখনো রয়ে গেছে। তবে বৈষম্য কাটিয়ে শেয়ার ব্যবসায় বেশিরভাগই উত্তরাধিকার সূত্রে আসছে। সরাসরি নারীরা আসছে কম।
রাইজিংবিডি: শেয়ারবাজারে নারীর অংশগ্রহণ সম্পর্কে বলুন।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): আসলে শেয়ারবাজারে নারীর অংশগ্রহণ সেভাবে নেই। কাগজে কলমে হয়ত অনেক আছে কিন্তু খোঁজ করলে শুধুমাত্র প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিওতে) তাদের অংশগ্রহণ বা উপস্থিতি সীমাবন্ধ দেখা যাবে। সেকেন্ডারি মার্কেটে যে পরিমাণ নারী অংশগ্রহণ করার কথা ছিল সেটা হচ্ছে না।
রাইজিংবিডি: কি উদ্যোগ নিলে নারী বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে আসবে?
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): নারীরা একটু কনজারভেটিভ। উনারা বেশি ঝুঁকি নিতে চায় না। নারীরা মূলত চায় না, তাদের বাবার টাকা, স্বামীর টাকা বা নিজের জমানো টাকা নষ্ট হোক। এদিকে, ২০১০ সালের পর থেকে মার্কেট খারাপ যাচ্ছে। ওই সময় শেয়ারবাজারে অনেক নারীর উপস্থিতি ছিল। ২০১০ থেকে দেশ পিছিয়ে গেছে, নারী পিছিয়ে গেছে— সেটা মনে করি না। যেটা পিছিয়েছে তা হলো— আমাদের শেয়ারবাজারটা একটা অভিভাবকহীন ছিল, বাজার অবহেলায় পড়েছিল। এছাড়া, দুঃখজনক হলেও সত্য— নতুন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য যে স্থিতিশীল বাজার দরকার সেটা দেখতে পাচ্ছি না। এ কারণে শুধু নারী নয়, শেয়ারবাজার নতুন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না। সার্বিকভাবে শেয়ারবাজারের ওপর মানুষের আস্থা ফিরলে নারীর অংশগ্রহণ স্বত:স্ফূর্তভাবে বাড়বে।
রাইজিংবিডি: শেয়ারবাজার সম্পর্কে নারীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি): আসলে যে সময় ক্যারিয়ার গড়ার কথা তখন নারী বা পুরুষের বিয়ে ও সংসার করতে হয়। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে সমস্যা হয় যখন সে মা হয়ে যায়। তখন তার ওপর অনেক দায়িত্ব পড়ে। এ কারণে পড়াশোনায় তারা যত ভালো করুক ক্যারিয়ারে বা কর্মক্ষেত্রে তারা ততটা ভালো করতে পারে না। সেক্ষেত্রে আমি বলব, অনেক মেধাবী নারী আছে যারা ক্যারিয়ার গড়তে পারেনি, একটা সময় তারা বুটিক্স করতে চায়। আমি বলবো, শিক্ষিত মেধাবী নারীদের শেয়ারবাজারে আসা উচিত। মেধাবী অনেক নারীরা জানেন না, তারা শেয়ারবাজারে কিছু একটা করতে পারবে। এটা একদিকে তাদের অজ্ঞতা, অক্ষমতা এবং বিপরীত দিকে নারীদের আকৃষ্ট করতে পারছি না শেয়ারবাজারে সেটা আমাদের অপারগতা।
খুজিস্তা নূর-ই-নাহারিন (মুন্নি) আরও জানান, প্রত্যেক কাজে সাহস থাকতে হয়। নারীদের অনেক বেশি সক্ষমতা আছে। কারণ নারী একজন মা, একজন গৃহিনী। সে সৃষ্টিশীল। এছাড়া, নারীদের ধৈর্য্য এবং সহনশীলতা বেশি। শেয়ারবাজারে যে জিনিস প্রয়োজন তার মধ্যে অন্যতম ধৈর্য্য। আর মেধা, ধৈর্য্য, মূলধন, সাহস থাকলে ব্যবসা করা কোনো ব্যাপার না। নারীর ক্ষমতা অনেক বেশি সে সেটা ব্যবহার করতে পারে না।