বিজ্ঞানীরা মহাকাশে শুক্রাণু নিয়ে সবচেয়ে বড় গবেষণার কাজ শুরু করেন ২০১৩ সালে। পৃথিবী থেকে ইঁদুরের হিমায়িত-শুষ্ক শুক্রাণু আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) পাঠিয়ে সেখানে তা সংরক্ষণ করা হয়। হিমায়িত-শুষ্ক শুক্রাণুগুলো প্রায় ৬ বছর পর ২০১৯ সালে স্পেসএক্সের একটি কার্গো ক্যাপসুলে করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয় এবং এসব শুক্রাণুর মাধ্যমে স্বাস্থ্যবান ইঁদুরের জন্ম নিতে দেখা যায়। বেশ কয়েক বছর ধরে মহাশূন্যে সংরক্ষিত থাকার পরও শুক্রাণুগুলো কার্যকর ছিল।
মহাকাশে রাখা শুক্রাণু নিয়ে এই গবেষণার বিস্তারিত তথ্য শনিবার (১১ জুন) সায়েন্স অ্যাডভান্স জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীর শুক্রাণুতে মহাকাশের বিকিরণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য এই গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন জাপানের ইউনিভার্সিটি অব ইয়ামানাশি’র গবেষকরা। ইঁদুরের শুক্রাণু হিমায়িত ও শুষ্ক করে তা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পাঠানো হয়। ঘূর্ণায়মান এই গবেষণারে প্রায় ৬ বছর ছিল এসব শুক্রাণু। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৫০ মাইল উপরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন, ঘূর্ণায়মান এই গবেষণাগার প্রতিদিন ১৫.৭ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে থাকে।
গবেষকরা যা করেছেন
গবেষকরা প্রথমে পুরুষ ইঁদুর থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ করেন। এরপর তা ইনজেকশনের ছোট্ট শিশিতে ভরা হয়, হিমায়িত ও শুষ্ক করার জন্য শুক্রাণু থেকে পানি অপসারণ করে ফেলা হয়। এরপর এসব হিমায়িত-শুষ্ক শুক্রাণু আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) পাঠিয়ে সেখানে সংরক্ষণ করা হয়, একইসঙ্গে পৃথিবীর গবেষণাগারেও সংরক্ষণ করা হয়। আইএসএস-এ হিমায়িত রাখা কিছু শুক্রাণু ৯ মাস পর পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে স্বাস্থ্যবান ইঁদুরের প্রজনন করতে সক্ষম হোন গবেষকরা। বাকিগুলো শুক্রাণুগুলো ১,০১০ দিন এবং ২,১২৯ দিন পর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয়।
মহাশূন্যে সংরক্ষণ করা শুক্রাণু এবং পৃথিবীতে সংরক্ষণ করা শুক্রাণু- উভয় ধরনের শুক্রাণু রিহাইড্রেড করেন গবেষকরা এবং আইভিএফ পদ্ধতির সাহায্যে ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষিক্ত করে নারী ইঁদুরের গর্ভধারণ করান। প্রজননের পর মহাকাশ ফেরত শুক্রাণু থেকে জন্ম নেওয়া ইঁদুর ছানাগুলোর সঙ্গে পৃথিবীতে সংরক্ষিত শুক্রাণু থেকে জন্ম নেওয়া ইঁদুর ছানাগুলো তুলনা করা হয়।
গবেষণাপত্রে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, ‘উভয় স্থানের শুক্রাণু থেকে জন্ম নেওয়া ইঁদুর ছানাগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি এবং কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতাও ছিল না।’
এমনকি মহাকাশ ফেরত শুক্রাণুর ডিএনএ বিকিরণের প্রভাবে অতিরিক্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। পৃথিবীর গবেষণারে সংরক্ষিত থাকা শুক্রাণুর মতো তা একই মানের দেখা গেছে।
যে কারণে এই গবেষণার ফল বড় একটি সাফল্য
মহাশূন্যে অবস্থিত প্রায় সব কিছুতেই মহাজাগতিক বিকিরণ হানা দেয়। পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকলে মহাজাগতিক বিকিরণ ডিএনএ’র উপর প্রভাব ফেলে। যার ফলে ডিএনএ’র ভাঙন এবং পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু গবেষকরা মহাশূন্যে সংরক্ষিত শুক্রাণুর ডিএনএ’র ক্ষতিগ্রস্ততা দেখতে পাননি, যা একটি বিশাল সাফল্য। গবেষকদের মতে, শুষ্ক-হিমায়িত পদ্ধতিতে শুক্রাণুর নমুনা থেকে পানি অপসারণ করলে তা ডিএনএ ক্ষতির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক সুবিধা দেয়। শুক্রাণুর কোষে পানি থাকলে ডিএনএ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
যা হোক, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন পৃথিবীর খুব কাছে অবস্থিত। ফলে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মাধ্যমে বিপজ্জনক মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে রক্ষা পেয়ে থাকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। ফলে মহাকাশের আরো গভীরে হিমায়িত-শুষ্ক শুক্রাণু ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা তা একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে রয়ে গেছে।
তবে বিজ্ঞানীরা নিকট ভবিষ্যতে চাঁদের বুকে শুক্রাণু ব্যাংক বা স্পার্ম ব্যাংক গড়ে তোলার পরিকল্পনা শুরু করেছেন।ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার বিজ্ঞানীরা মানব প্রজননে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু কোষের একটি সংরক্ষণাগার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন। এই সংরক্ষণাগার থাকবে চাঁদের পৃষ্ঠের নিচে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতি খরা, গ্রহাণুর আঘাত, পারমাণবিক যুদ্ধ- এমন সব ঝুঁকি ক্রমশই বাড়ছে পৃথিবীতে। এর ফলে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বাইরে মানুষের জীবন সংরক্ষণ করার বিষয় নিয়ে এ ধরনের চিন্তাভাবনা করছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, অবশ্যই জীবনকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানবজাতিকে তার দৃষ্টি দিতে হবে মহাকাশ ভ্রমণের দিকে।
নাসা এবং বিশ্বজুড়ে অন্যান্য মহাকাশ সংস্থাগুলো একটি ‘গেটওয়ে’ মহাকাশ স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা করছে, যা চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে এবং সৌরজগতের গভীরে মানুষের ভ্রমণের জন্য একটি স্টেশন হিসেবে কাজ করবে। মহাকাশ বিকিরণের প্রভাব পরীক্ষার জন্য এই গেটওয়ে স্টেশনে হিমায়িত-শুষ্ক শুক্রাণু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে বলে গবেষণাপত্রে মতামত ব্যক্ত করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ইয়ামানাশি’র গবেষকরা।