১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও পরিবারের অন্য সদস্যরা শহিদ হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী খুনি চক্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে গণমাধ্যমে এই হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা প্রকাশ পেতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ করা হয়। সেখানে বঙ্গমাতার প্রসঙ্গ বলাবাহুল্য।
সময়টা ১৯৯৫ সাল। ঘোরতর দুঃসময়ে প্রকাশিত হলো একটি বই। নাম 'বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব'। লিখেছেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ-গবেষক-ঔপন্যাসিকা নীলিমা ইব্রাহিম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করতেন, এই বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন তিনি। প্রগতিশীল ভূমিকা রাখার কারণে পাকিস্তান আমলে বাঙালির সব প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সঙ্গে ছিলেন সব সময়। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বীরাঙ্গণা মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও যুদ্ধশিশুদের সুব্যবস্থার জন্য কাজ করেছেন। এসব কাজে তাঁর অনন্য অভিজ্ঞতার বয়ান খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর লেখা আমি বীরাঙ্গনা বলছি, ‘War Heroines Speak: the Rape of Bangladesh Women in 1971 War of Independence’ বইয়ে।
এ ছাড়াও তিনি লিখেছেন পাঠকনন্দিত ছোটগল্প-উপন্যাস। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যপাঠ নিয়ে লিখেছেন গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তাঁর লেখা ‘অগ্নিস্নাত বঙ্গবন্ধুর ভস্মাচ্ছাদিত কন্যা আমি’, ‘সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত: অতঃপর কৃষ্ণান্ধকার’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বই।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোদ্ধা ও সুযোগ্য সহধর্মিণী বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে নিয়ে ড. নীলিমা ইব্রাহিমের লেখা প্রথম বইটি প্রকাশ করে বীরোচিত সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফিন দীপন, যিনি মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে পরবর্তীতে নির্মমভাবে নিহত হন। কোথায় যেন এক বিষণ্ন যোগসূত্র গড়ে ওঠে এই দু’টি ঘটনার। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির হাতে জীবন দিতে হয়েছিল বঙ্গমাতাকে। তাঁকে নিয়ে লেখা প্রথম বইটি যিনি প্রকাশ করলেন, তাঁকে হত্যা যারা করেছিল তারাও কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের কেউ নয়। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী রাষ্ট্র বানানোর ইচ্ছেতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যা করা হলো, তাঁর রক্তের কেউ যাতে ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে না পারে, সেজন্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে থাকা বঙ্গবন্ধু পরিবারের সকলকে হত্যা করা হলো। কেবল এটুকুতেই থামেনি পাকিস্তানবাদে দীক্ষা নেওয়া বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি। বাংলাদেশের পক্ষে থাকা মুক্তমনা মানুষদের নিশ্চিহ্ন করতে খড়গহস্ত হয়েছে তারা বারবার। এর অন্যতম উদাহরণ বাংলা ভাই সৃষ্টি, সারা দেশে একযোগে বোমা হামলা করা, বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে বোমা হামলাসহ প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন এবং তাঁর মতো তরুণপ্রাণ লেখক-ব্লগারদের হত্যা ও হত্যাচেষ্টা করা।
বইটি কেন লিখতে হলো? ভূমিকাতে লেখক যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা গোটা বাঙালি জাতির সামনে বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মুজিব বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন তার সে পথ নিঃসঙ্গ যাত্রার ছিল না। তিন বছর বয়সের ননীর পুতুলী রেণু চিরকালের ছায়া সঙ্গী হয়ে মুজিবকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে সংসারের সমস্ত দুশ্চিন্তা নিজের মাথায় তুলে নিয়েছিলেন, তাঁর কথা কেউ বলে না কেন? তিনি কলমের আঁচড়ে বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যের 'কাছে উপেক্ষিতা' রেণু থেকে বঙ্গমাতা হয়ে ওঠা এক অসামান্য নারীকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁকে তিনি সম্বোধন করেছেন ‘আমার স্নেহময়ী প্রিয় ভগ্নি রেণু’ বলে।
ভূমিকাতে লিখেছেন, ‘আমি চিৎকার করে রেণুর নাম উচ্চারণ করছি, জোরে আরো জোরে, যেন প্রতিনিয়ত সে ধ্বনির অনুরণন বিশ্ববাসীর শ্রুতিগোচর হয় আর বাংলাদেশে তার সন্তানেরা জননীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পুতঃপবিত্র ধন্য হয়।‘ মহাকবি বাল্মিকীর লেখা ‘রামায়ন’ এ অনালোচিত কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রামভ্রাতা লক্ষ্মণের স্ত্রী ঊর্মিলার সাথে তুলনার মধ্য দিয়ে শুরু করে খুব সহজ ভাষায় নিজস্ব অভিজ্ঞতায় ধরা দেওয়া বঙ্গমাতার নিরাভরণ দর্শন ও জীবনাদর্শ তুলে ধরেছেন লেখক। স্বামীর সঙ্গে বনবাসে যাওয়া ঊর্মিলার কথা বাল্মিকী ভুলে গেলেন, সবাই রাম-লক্ষণের জয়ধ্বনি করছিল, সীতা প্রস্তুত হচ্ছিলেন অগ্নিপরীক্ষার জন্য। কিন্তু ত্যাগ স্বীকারকারিণী ঊর্মিলার কথা কেউ কিছু বলেনি। সন্তান সংসার সামলানো আটপৌরে বাঙালি নারী বিপ্লবী জঙ্গি মিছিলের নেতৃত্ব না দিয়েও একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। অথচ বঙ্গমাতার এই ত্যাগ ও কৃতিত্বের কথা আলোচনায় আসে না।
'বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব' বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত পেইন্টিংএ আটপৌরে শাড়িতে ঘোমটা দেওয়া চিরায়ত বাঙালি নারী বেগম মুজিব যেন সেই সত্যকে প্রকাশ করে। আর বঙ্গমাতা তো ঠিক তেমনটিই ছিলেন। বঙ্গমাতা সম্পর্কে, বঙ্গবন্ধুর মা ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অনেক অজানা কথা উঠে এসেছে বইতে। যেমন, বঙ্গবন্ধুর মা শেখ সায়েরা খাতুনের কাছে পুত্রের চেয়ে কাছের ছিলেন পুত্রবধূ রেণু। এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। স্টিমারে করে বরিশাল থেকে ঢাকা আসার পথে ‘মা খালার মতোই সহজ স্বাভাবিক’ দীর্ঘকায় ও কৃশ এক নারীর দেখা পেয়েছিলেন, যিনি তাঁর আসন্ন প্রসবা বৌমার কথা বারবার বলছেন, বলছেন তাঁর পাগল ছেলের কথা। পাগল ছেলের নাম কি? জানতে চাইলে ‘সসঙ্কোচে মৃদু হেসে মহিলা বললেন, ‘মুজিব, শেখ মুজিবুর রহমান।‘ মুজিব তখনই আপামর জনগণের বন্ধু। স্টিমারে স্থানাভাবে সারাটা রাত দাঁড়িয়ে ছিলেন মুজিবের মা, ডেপুটি নামীয় স্টিমারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে একবারও তাঁর পরিচয় দিয়ে সুবিধা নিতে চাননি।
স্মৃতিচারণের শুরুতে ‘রামায়ন'র ঊর্মিলা হয়ে বঙ্গবন্ধুর মায়ের কথার পর বৈঠকি ঢঙে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে লেখক ড. নীলিমা ইব্রাহিমের ফুলার রোডের বাড়িতে আসা ‘শ্যাখ মুজিবের বিবি’র সাথে আলাপের আবেগঘন বর্ণনার সাথে পাঠককে টেনে নিয়ে যান মাত্র ৮৮ পৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ জীবনী গ্রন্থটি পড়তে। এবং পড়তে পড়তে কখন যে বিনিময়ে কিছু না পাওয়া রেণুর জন্য চোখে পানি চলে আসে, বেদনায় ভরে যায় মন! বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে জানার পর বুঝতে কষ্ট হয় না নারীর সত্যিকারের ক্ষমতায়ন আসলে কাকে বলে। আজকের বাংলাদেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথে এগিয়ে যাচ্ছে, আর সেই পথে বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা বঙ্গমাতা কীভাবে সাহস জুগিয়েছেন, তা জানতে বইটি পড়তেই হবে প্রিয় পাঠক।
আসুন, এই শোকের মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোদ্ধা ও সুযোগ্য সহধর্মিণী বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে নিয়ে লেখা প্রথম বইটি পড়ে তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।