সাদিয়া সুলতানা ঔপন্যাসিক। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে বই-চক্র (২০১৪), ন আকারে না (২০১৭), আমি আঁধারে থাকি (২০১৮), ঘুমঘরের সুখ-অসুখ (২০১৯), মেনকি ফান্দার অপরাধ কিংবা পাপ (২০২০)। চলতি বছর ‘বিয়োগরেখা’ উপন্যাসের জন্য অর্জন করেছেন রাবেয়া খাতুন কথাসাহিত্য পুরস্কার। সম্প্রতি কথা হলো এই কথাশিল্পীর সঙ্গে।
স্বরলিপি : রাবেয়া খাতুন কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ প্রাপ্তিতে আপনাকে অভিনন্দন। পুরস্কার লেখককে অভিনন্দিত করা, না কি পাঠকের সঙ্গে লেখককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যম?
সাদিয়া সুলতানা : ধন্যবাদ। এটা ঠিক যে পুরস্কার প্রাপ্তির পর 'অভিনন্দন' শব্দটা শোনার সুযোগ ঘটে। কিন্তু লেখালেখি চলছে বা প্রকাশ হচ্ছে সেই সময় অভিনন্দন বিষয়টি অপাংক্তেয়। তবে আমার মনে হয়, পুরস্কার পাঠককে লেখকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একটা মাধ্যম। পাঠক যখন আলাদাভাবে কারও নাম শোনেন হয়তো তিনি সামান্য হলেও তার লেখার প্রতি আগ্রহবোধ করেন।
স্বরলিপি : ‘বিয়োগরেখা’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট জানতে চাচ্ছি।
সাদিয়া সুলতানা: ‘বিয়োগরেখা’ একজন নারীর গল্প, একাধিক নারীর গল্প। একজন নারী যখন বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসে তখন আমরা নানাভাবে তাকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করি। সামাজিক প্রতিকূলতা, মানুষের কটাক্ষ, ভ্রুকুটি সব উপেক্ষা করে সেই নারী এগিয়ে যেতে চাইলে আমরা আমাদের মজ্জাগত অভ্যাসের কারণে তার পথ বন্ধুর করে তুলি। এমন বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে ইলোরার মতো নারীরা কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়, কতটা রক্তাক্ত হয়, কতটা শক্তি নিয়ে বারবার উঠে দাঁড়ায়- বিয়োগরেখা তারই গল্প।
স্বরলিপি : আপনার উপন্যাসের চরিত্ররা একে অন্যের সঙ্গে হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতির সংলাপ আদান প্রদান করে। সংলাপ নির্মাণে কোন দিকটা বেশি প্রাধান্য দেন?চারপাশের মানুষের জীবনাচরণের কোনটুকু কথাসাহিত্যে নিয়ে আসতে চান?
সাদিয়া সুলতানা : আমরা দৈনন্দিন জীবনে যেভাবে কথা বলি, যেভাবে সংলাপ আদান-প্রদান করি সেভাবেই আমার লেখার চরিত্ররা কথা বলে। তাই তারা সাধারণত পরিশীলিতভাবে কথা বলে না, তারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, তারা সংলাপ আদান-প্রদানে পরস্পরকে শ্রবণঅযোগ্য গালিগালাজও দেয়। কেন যেন মনে হয় এসবের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে সংলাপ তৈরির চেষ্টা করা হলে সেসব আরোপিত বলে মনে হবে। আর আমার চারপাশ, আমার অভিজ্ঞতা- এসবই তো আমাকে লেখায়, তাই সেসব অনিবার্যভাবে লেখাতে আসবেই।
স্বরলিপি : কথাসাহিত্যে প্রচুর সময় দিতে হয়। এদিকে আলাদা পেশার সঙ্গেও জড়িত আছেন। সবমিলিয়ে লেখার সময়টা কীভাবে বের করেন?
সাদিয়া সুলতানা : প্রতিদিন সময় তো বের করতেই হয়। না হলে পুরো দিনটাই ব্যর্থ মনে হয় আমার। জগৎ সংসারে যত অনর্থই ঘটুক না কেন দিনে অন্তত একবার লিখতে বা পড়তে বসি আমি। এর জন্য দিনের চব্বিশ ঘণ্টা নিঙড়ে সময় বের করতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় বলতে পারেন। এই যুদ্ধটা যেমন সময়ের সাথে তেমনি অসংখ্য সামাজিক প্রতিকূলতার সাথেও।
স্বরলিপি : শৈশবে দেখা মানুষ আর চারপাশের পরিবেশ আপনাকে কতটুকু প্রভাবিত করে?
সাদিয়া সুলতানা : শৈশব স্মৃতি ধীরে ধীরে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আবার কারণে-অকারণে অনেক স্মৃতি আঁকড়েও ধরছে। আসলে আমার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যে যেসব মানুষের সংস্পর্শে এসেছি, যেই পরিবেশের ভেতর দিয়ে কাটিয়েছি সবই আমাকে প্রভাবিত করে। এসব থেকে প্রভাবমুক্ত থেকে তো লেখা যায় না।
স্বরলিপি : ঈশ্বরকোলের যে দাদি- এই চরিত্রটির নারী জন্মের কত গ্লানি তুলে ধরে। চরিত্রকে বড় আকারে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরার জন্য কোন কোন দিক খেয়াল রাখেন?
সাদিয়া সুলতানা : আসলে পরিবারের দাদি-নানি, দাদা-নানারা একেকজন একেকটা সিন্দুকের মতো। সেই সিন্দুকে একটা পরিবারের গোপন, আপন সবকিছু যেমন গচ্ছিত থাকে তেমনি গুপ্ত থাকে অনেক অজানা ইতিহাস। ঠিক নারী জন্মের গ্লানি না, ঈশ্বরকোলের দীপার দাদি চরিত্র তেমনই অনেক কিছু বুকসিন্দুকে ধারণ করে। আগে কোথাও কখনো বলিনি, আজ বলছি। আমার উপন্যাসের কোনো মুখ্য চরিত্রকে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরার জন্য আমি সঙ্গোপনে একটা নির্দিষ্ট মানুষকে দেখার চেষ্টা করি। ঐ মানুষটা দেখতে কেমন, সে কী করে কথা বলে, কী করে ভাবে, ভাবনার কত গভীরে যাওয়ার সক্ষমতা রাখে সেসবই খুঁটে খুঁটে দেখার চেষ্টা করি।
স্বরলিপি : আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কে?
সাদিয়া সুলতানা : কেউ যখন আমার লেখা পড়ে ভালো বা মন্দ বলে তখন ইচ্ছে করে আবার নতুন কিছু লিখতে বসি। বলা যায়, পাঠকই অনুপ্রেরণা।