দখল-দূষণের কবলে মৃতপ্রায় খুলনা শহরের ময়ূর নদ পাচ্ছে ‘মডেল’র মর্যাদা। খুলনা বিভাগের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব বিবেচনায় এ নদকে ‘মডেল’ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত বুধবার (৯ অক্টোবর) পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয়ে কর্মপরিকল্পনা সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আলোচনায় উঠে আসে মৃতপ্রায় ময়ূর নদকে দখল-দূষণমুক্ত করতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রস্তাবনার বিভিন্ন দিক।
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মো. সাদিকুল ইসলাম ময়ূর নদকে ‘মডেল’ হিসেবে নির্বাচনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি কার্যকরি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছি। এ কর্মপরিকল্পনা প্রস্তাবনা আকারে নির্দেশনা অনুযায়ী পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে।’
এর আগে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় দেশের আটটি বিভাগের আটটি নদীকে অবৈধ দখল ও সার্বিকভাবে দূষণমুক্ত করে একটি অনুসরণীয় ‘মডেল’ হিসেবে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই অংশ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের পরিচালক সৈয়দা মাছুমা খানম স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত পত্র পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় দপ্তরেও প্রেরণ করা হয়।
যাতে উল্লেখ করা হয়, দূষিত নদী নির্বাচন এবং তা দূষণমুক্তকরণের লক্ষ্যে বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর পরিপ্রেক্ষিতে খুলনা বিভাগের সবচেয়ে দূষিত একটি নদী নির্বাচনপূর্বক মধ্যে প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে নদী দূষণ রোধে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, সরকারি অংশীজন/সংস্থার নাম, দূষণমুক্ত করার সময়কাল উল্লেখ পূর্বক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে বলা হয়।
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী গত বুধবার পরিবেশ অধিদপ্তর, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের সভাকক্ষে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় খুলনার রূপসা, ভৈরব ও ময়ূর নদের নাম উঠে আসে। সর্বাধিক দখল-দূষণ বিবেচনায় ময়ূর নদকেই ‘মডেল’ হিসেবে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।
আলোচকরা ময়ূরের সঙ্গে সঙ্গে এর শাখা-প্রশাখাগুলো পুনউদ্ধার, গল্লামারি কসাইখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে না ফেলে ইটিপি প্লান্টের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য নদীতে না ফেলাসহ ময়ূরকে প্রবাহমান করার বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), জেলা প্রশাসন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা প্রশাসন এবং রোডস এন্ড হাইওয়ের সমন্বয়ে বড় আকারের উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সভায় শিক্ষক, সাংবাদিক, খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) ও খুলনা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) প্রতিনিধি, পরিবেশ ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি এবং শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
ময়ূরের আদ্যোপান্ত: খুলনা মহানগরীর পশ্চিম কোল ঘেঁষে প্রবাহিত ময়ূর নদী। বটিয়াঘাটা থানার রূপসা নদী থেকে হাতিয়া নদী নামে উৎপত্তি হয়ে পুটিমারী ও তেঁতুলতলা গ্রামের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গল্লামারী ব্রিজ থেকে মূলত ময়ূর নদী নামে শুরু হয়েছে। এটি সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিম পাশ দিয়ে রায়ের মহল হয়ে বয়রা জেলেপাড়া বাজারের পাশ ঘেঁষে লতা পাহাড়পুর (দেয়ানার শেষ সীমানা) গিয়ে খুদিয়ার খাল নামে বিল ডাকাতিয়ায় মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য ১১.৪২ কিলোমিটার, প্রস্থ স্থান ভেদে ৩০ থেকে ১১০ ফুট এবং গভীরতা স্থান ভেদে ১০ থেকে ২৪ ফুট।
ময়ূর নদী একসময় মানুষের জীবন প্রবাহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরাট ভূমিকা পালনকারী এই নদী ছিল এ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। নৌকা, ট্রলারযোগে সুন্দরবন থেকে আনা গোলপাতা, গরানসহ অন্যান্য দ্রব্যাদি এই নদীপথে শহরে সরবরাহ করা হতো। নদীর আশপাশে বসবাসকারী মানুষ এই নদীর দ্বারা উপকৃত হতো। চাষাবাদের কাজে এই নদীর পানি ব্যবহৃত হতো। ফলে অধিকহারে ধানের ফলন এবং রবিশস্যের চাষ হতো।
শ্রমজীবী মানুষ ময়ূর নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করতের। ময়ূর নদীর আশীর্বাদপুষ্ট মানুষই এখন নদীটিকে অভিশপ্ত করে তুলেছেন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী এ জলাধারের দু’পাশে অবৈধ দখলদাররা নদীর অংশবিশেষ ভরাট করে বসতবাড়ি পর্যন্ত গড়ে তুলেছে। নদী আটকে করা হচ্ছে মাছের চাষ। নদীর দু’পাশে অসংখ্য ঝুলন্ত খোলা টয়লেট রয়েছে। মানবববর্জ্যের কারণে নদীটির পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মিত স্লুুইচগেটটি প্রায় অকার্যকর। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, তদারকির অভাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না স্লুইচগেটগুলো। নদীর দুপারের ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে নদীর গভীরতা আগের তুলনায় অর্ধেকে এসে পৌঁছেছে। স্রোত না থাকায় পানি পচে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। প্রভাবশালীরা মাছ ধরার জন্য সরকারি গাছের ডালপালা কেটে নদীতে ফেলে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করেন।
এ অবস্থায় খুলনা নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের প্রকল্পে আবারও চলছে ময়ূর নদ খনন কাজ। দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে খনন কাজ শেষ হলেও নানা অনিয়মে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। কেসিসির পরিকল্পনাহীন উদ্যোগ ও ঠিকাদারের গাফিলতিতে এবারও খননের বিপুল অর্থ অপচয় হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ, পরিবেশবাদী নেতা ও স্থানীয়রা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৪ সালে প্রথম ময়ূর নদ খনন করে খুলনা সিটি করপোরেশন। বছর ঘুরতেই নদ পুরোনো চেহারায় ফিরলে জলে যায় প্রকল্পের প্রায় ৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে আবারও প্রকল্প নেয় কেসিসি। চুক্তিমূল্য ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এবার নগরীর বয়রা শ্মশান ঘাট থেকে সাচিবুনিয়া ব্রিজ পর্যন্ত গড়ে ২ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার খনন হবে।
কেসিসি’র সূত্র জানায়, ৮২৩ কোটি টাকার ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় ময়ূর খনন হচ্ছে। এ জন্য ২০২২ সালের ৭ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আমিন অ্যান্ড কোং অ্যান্ড শহীদ এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেয় কেসিসি। ২০২৩ সালের ৩০ জুন তাদের কাজ শেষ করার কথা ছিল। এরপর দুই দফা সময় বাড়ানো হয়েছে। তবে কাজ শেষ হয়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, পানির মধ্যে খনন যন্ত্র দিয়েই কাটা হয়েছে মাটি। আবার মাটি কেটে নদের পাড়েই রাখা হয়। বর্ষায় এসব মাটি ধুয়ে আবার নদে পড়ছে। দখলে নদের যেসব জায়গা সরু হয়ে গেছে, সেখানে খনন করাই হয়নি। বিভিন্ন খাল ও সংযোগ ড্রেন দিয়ে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদে পড়ছে। এর আগে খননে অনিয়ম ছাড়াও নদ ভরাটের অন্যতম কারণ ছিল এ বর্জ্য ঠেকাতে না পারা। কিন্তু নতুন প্রকল্পে বর্জ্য ফেলা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ রাখা হয়নি।
এদিকে, নদের খনন কাজ সঠিকভাবে করার দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনসহ স্থানীয়রা। তবে পানি রেখে খনন কাজ চলমান রাখার কারণ হিসেবে শহরবাসীর অসহযোগিতা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থায় কেসিসির পরিকল্পনাহীনতাকে দায়ী করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।