সারা বাংলা

প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন ব্যয় ৫৪২ টাকা!

দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতি কেজি চিনিতে ৪১৭ টাকা লোকসান দিয়েছে। গত মাড়াই মৌসুমে সরকারি ভ্যাট ও ব্যাংকের সুদ মিলে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন ব্যয় ছিল ৫৪২ টাকা। গত মৌসুমে চিনি আহরণের হার ছিল সবচেয়ে কম। ওই বছরে ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্য থাকলেও আহরিত হয় ১ হাজার ৮৭১ মেট্রিক টন।

মোবারকগঞ্জ চিনিকলের হিসাব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে এ চিনিকলে অপারেশনাল লস হয়েছে ৩৪ কোটি টাকা এবং ব্যাংক ঋণের সুদ দিতে হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৭০ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা এবং ৩৫০ কোটি টাকা ব্যাংকের দেনা মাথায় নিয়ে শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) বিকেলে ৫৮তম মাড়াই মৌসুম শুরু করেছে চিনিকলটি। 

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরসংলগ্ন এলাকায় ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭ দশমিক ৯৩ একর নিজস্ব জমির ওপর নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় মোবারকগঞ্জ চিনিকল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মধ্যে ২০ দশমিক ৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮ দশমিক ২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনি, ২৩ দশমিক ৯৮ একর পুকুর, ১০৭ একর জমিতে ইক্ষু খামার ও ১৮ দশমিক ১২ একর জমিতে রয়েছে সাব-জোন অফিস ও আখ ক্রয়কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠাকালীন মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ কর্মদিবস আখ মাড়াই করে লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় ১৯৬৭-৬৮ মাড়াই মৌসুম থেকে বাণিজ্যিকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু করা হয়।

ঝিনাইদহের ছয় উপজেলা ছাড়াও যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত আটটি জোন ও ১৮ দশমিক ১২ একর জমিজুড়ে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয়কেন্দ্র। আট জোনের আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ সাড়ে ৩ লাখ একর। ৪৮টি আখ ক্রয়কেন্দ্রের আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৩ লাখ একর।

মোবারকগঞ্জ চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (ফাইন্যান্স) হিরন্ময় বিশ্বাস জানিয়েছেন, চলতি মাড়াই মৌসুমে ৭০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনি আহরণের হার ৫.৬ শতাংশ।

তিনি বলেন, “২০২৩-২০২৪ মাড়াই মৌসুমে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন ব্যয় হয়েছে ৩৪৯ টাকা ৫০ পয়সা। তবে, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ভ্যাট ও ব্যাংকের সুদ যোগ করলে উৎপাদন ব্যয় আরো বেশি হবে।”

চিনিকলে ধারাবাহিক লোকসানের কারণ ব্যাখ্যা করে হিরন্ময় বিশ্বাস জানান, ১৯৬৫ সালে স্থাপিত সেই পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে চিনি উৎপাদন করা হচ্ছে। মিলে আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগেনি। ব্রিটিশ আমলের যন্ত্রাংশ মেরামত, ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি ও অন্যান্য খাতে বাড়ছে খরচ। এ কারণে প্রতি বছর লোকসানের বোঝা বাড়ছে। তাছাড়া, আখ চাষের জমিতে কৃষকরা কলা, ড্রাগন, পেয়ারা ও কুলসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করছেন। এতে আখ উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না।

চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার জানান, নিচু জমিতে উৎপাদিত আখে চিনির উৎপাদন হার কম হয়। তাছাড়া, মাড়াই মৌসুম শুরু হলে কিছু চাষি আখের ওজন বাড়ানোর জন্য জমিতে সেচ ও সার প্রয়োগ করেন। ফলে, চিনি উৎপাদনের হার কমে যায়।

চিনিকল এলাকার কৃষকদের অভিযোগ, মিলের কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতাদের লাগামহীন দুর্নীতি, কর্তব্যে অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে মিলটি ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এছাড়া, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অতিরিক্ত অদক্ষ জনবল নিয়োগের ফলে মিলকে প্রতি বছর বেতন-ভাতা বাবদ অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়।

কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, “দাম কম হওয়ায় আখ চাষে অনীহা বাড়ছে। এতে ঝিনাইদহের পশ্চিমাঞ্চলের বোড়াই, নারায়নপুর, কাশিমনগর, হলিধানী ও ঝিনাইদহ শহরের গোপীনাথপুর এলাকার আখ ক্রয়কেন্দ্র বছরের পর বছর বন্ধ আছে। সেখানে এখন পালংশাক ও সবজি আবাদ হচ্ছে।”

মোবারকগঞ্জ চিনিকল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মিল বন্ধ থাকলে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বছরে ৮ কোটি টাকা এবং চালু থাকলে ৫০ থেকে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান হয়।

এ বিষয়ে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল আলম বলেছেন, “মিলের লোকসান কমাতে এবং আখের উৎপাদন বাড়াতে চাষিদের নিয়মিত সার, বীজ ও কীটনাশক সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতি বছর যে লোকসান হয়, তার বেশিরভাগ ব্যাংক ঋণের সুদ ও ভ্যাটের কারণে হয়। গত বছর মিলের অপারেশনাল লোকসান হয়েছে ৩৪ কোটি টাকা।”