দেশের উত্তর-পশ্চিম ও সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। রাজশাহী বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। দেশ বিভাগের আগে এটি মালদহ জেলার অংশ ছিল। ১৯৮৪ সালে এ অঞ্চলটি একক জেলা হিসেবে গণ্য হয়। তখন জেলার নাম ছিল নবাবগঞ্জ। চম্পক থেকেই চাঁপাই। একসময় নবাবরা এ অঞ্চলে শিকারে আসতেন, সে সূত্রে নবাবগঞ্জ। এই দু’শব্দের সমন্বয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। পরে জেলাবাসীর দাবিতে সরকারিভাবে ২০০১ সালের পহেলা আগস্টে চাঁপাইনবাবগঞ্জ নামকরণ করা হয়।
কৃষিনির্ভর জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। আম প্রধান ফসল। একে আমের রাজধানীও বলা হয়। ছোট সোনামসজিদ, একটি স্থলবন্দর ও রেল স্টেশন দেশজুড়ে বেশ পরিচিত এনে দিয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সমাধিও রয়েছে এখানে। পাঁচটি উপজেলা, চারটি পৌরসভা নিয়ে এ জেলা। বেশিরভাগ এলাকা দুর্গম চরাঞ্চল।
শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়ন
জেলায় গত একযুগে শিক্ষা ব্যবস্থায় নজিরবিহীন সাফল্য এসেছে। বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজের একাডেমিক ভবন, শাহ-নেয়ামতুল্লাহ কলেজের প্রশাসনিক ভবন, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের ভবন, আব্দুস সামাদ কলেজের বহুতল ভবন, শংকরবাটি কামিল মাদ্রাসার বহুতল ভবনসহ ৬টি কলেজে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া স্কুল-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নয়ন করা হয়েছে।
বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে জেলার প্রাণকেন্দ্র পিটিআই এলাকায় নির্মিত হয়েছে যুব উন্নয়ন ভবন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে এ প্রকল্পটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এতে সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান, গড়ে উঠবে দক্ষ জনশক্তি।
যোগাযোগ খাতে উন্নয়ন
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ৫৪৭ মিটার দীর্ঘ ‘শেখ হাসিনা সেতু’। এটি চরাঞ্চলের মানুষের বহু দিনের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ছিল। সংযোগ সড়ক, ব্রিজ, কালভার্টসহ অসংখ্য অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সরাসরি ঢাকা আন্তনগর ট্রেন চালু করার লক্ষ্যে ২১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে আমনুরা বাইপাস রেলপথটির নির্মাণ কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত কমিউটার ট্রেন দিয়ে আন্তনগর ট্রেনের সঙ্গে সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে আন্তনগর ট্রেনের চাহিদা কিছুটা পূরণ হয়েছে। এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সরাসরি বিরতিহীন রাজশাহী হয়ে ঢাকা চলাচল করে বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেন।
সদর উপজেলার আতাহার এলাকায় রয়েছে অর্ধশতাধিক বড় রাইস মিল, স-মিল, আটা মিল। ওই এলাকায় যাতায়াতে খুব ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল যাত্রীসহ মিল মালিকদের। পরে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কোটি টাকা ব্যয়ে কনক্রিটের ঢালাই দিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটরের রাস্তাটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরেই কাজ শেষ হবে।
জেলায় বাস্তবায়ন হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনামসজিদ স্থলবন্দর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের কাজ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে আসবে নতুন গতি। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুরয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলস্টেশন ও প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন জরিপ কাজে নিয়োজিত ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মোডেলিং অব বাংলাদেশ-আইবিএমের প্রতিনিধি দল। রেলস্টেশন থেকে সোনামসজিদ স্থলবন্দর পর্যন্ত ৩১ কিলোমিটার পথে যে তিনটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে, তার জায়গা নির্ধারণ করা হবে। তাছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্য কম খরচে আনতে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এই রেল যোগাযোগ।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নয়ন
সদর হাসপাতাল ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের লক্ষ্যে নতুন ভবন নির্মাণের কাজ চলমান। গণপূর্ত বিভাগের অর্থায়নে ৮ তলাবিশিষ্ঠ হাসপাতালের এ নতুন ভবন নির্মাণে ব্যয় হবে ২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিশেষায়িত চিকিৎসায় এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতির চাঁপাইনবাবগঞ্জ চক্ষু হাসপাতাল। এর নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি টাকা দিয়েছে সরকার।
পর্যটন খাতে উন্নয়ন
শিবগঞ্জের কানসাটে অবস্থিত শতাধিক বছরের পুরাতন ৩১ দশমিক ৯৯ একর জমির ওপর ময়মনসিংহের জমিদার রাজা শসিকান্ত আচার্য বাহাদুর (কুজা রাজা পরিচিত) আম বাগান রয়েছে। এখানে ১৬ প্রজাতির প্রায় ২১০০ আম গাছ রয়েছে। আমের মৌসুমে দর্শনার্থী ও ক্রেতারা সুযোগ-সুবিধার অভাবে এখানে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতেন। ফলে কুজা রাজার আম বাগানকে সংস্কার করে দর্শনার্থীদের জন্য বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম ও ট্যুরিজম স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা সেতু সংলগ্ন ৪৪ একর জমির ওপর গড়ে উঠতে যাচ্ছে পর্যটন কেন্দ্র। সদর উপজেলার চুনাখালি ও নিমগাছি মৌজার ৪৪ দশমিক ৫১ একর খাস জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে এটি। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের বাস্তবায়নে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ হচ্ছে।
জেলার পৌর এলাকার শান্তি মোড়ে আজইপুর বিল দীর্ঘদিন কচুরিপানা দিয়ে ঢাকা ছিল। ফলে আশেপাশের এলাকাগুলো দূষণ হতো। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জমে থাকা বর্জ্যগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। জলাশয়টি পুনরায় খনন ও অধিকতর সংস্কার করে ওয়াটার কিংডম, ওয়াটার স্লাইড ও শিশুদের জন্য বিভিন্ন রকমের রাইডসহ আধুনিক মানের বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সোনামসজিদ, তোহাখানা, দারশবাড়ি ও চামচিকা মসজিদগুলো জেলার অন্যতম স্থাপনা। দর্শনার্থীদের জন্য বানানো হয়েছে কোটি টাকা ব্যয়ে পর্যটন মোটেল।
জেলায় বিদ্যুতায়ন
‘প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদুৎ’ এই স্লোগান বাস্তবায়নে ১ হাজার ১১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলার ২৮টি সীমান্তবর্তী গ্রামের ৮ হাজার পরিবার প্রাথমিকভাবে বিদুৎ পাবে। ইতোমধ্যে বিদ্যুতের খুঁটি ও তার সংযোগ দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। ১০৭ কিলোমিটারের মধ্যে দীর্ঘ ৯০ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ সম্পন্ন করা হয়েছে। বর্তমানে অফগ্রিডের কাজ চলমান রয়েছে। সদর উপজেলার মিরের চর এলাকায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন রাখা হয়েছে।
কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন
১ কোটি ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচারের (বিনা) উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন
ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে জেলার বরেন্দ্র অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। বছরজুড়ে নদীতে প্রবাহ রাখা ও সেচ কাজে পানি ব্যবহার নিশ্চিত করতে মহানন্দার ওপর রাবার ড্যাম নির্মাণের দাবি করেন জেলাবাসী। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডাবলিউএম) নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। আড়াই বছর সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে ১৫১ কোটি টাকার একটি খসড়া নকশা প্রণয়ন করে প্রতিষ্ঠানটি।
৩৫৩ মিটার দৈর্ঘ্য এ রাবার ড্যামের উজান ও ভাটিতে ৩৬ কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং করে নদী খনন করার কথা আছে। এর মধ্যে উজানে ১০ কিলোমিটার এবং ভাটি এলাকায় ২৬ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এটাই হবে দেশের সবচেয়ে বড় রাবার ড্যাম। ফলে নদীর তীরবর্তী ৮ হাজার হেক্টর জমি সব মৌসুমেই সেচের আওতায় আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর।
বিবিধ উন্নয়ন
২১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন। এছাড়াও প্রায় ১০টি ইউনিয়নে অত্যাধুনিক ইউনিয়ন কমপ্লেক্স, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও জেলায় ৬টি মডেল মসজিদ নির্মাধীন রয়েছে।
এক নজরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ
জেলার আয়াতন ১৭ হাজার ৩ বর্গকিলোমিটার। নির্বাচনী এলাকা আছে ৩টি। জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৪৭ হাজার ৫২১ জন। মোট ভোটার ১০ হাজার লাখ ৬৯ হাজার ১৩৬ জন। শিক্ষার হার ৬৬ শতাংশ। পৌরসভা আছে ৪টি। ইউনিয়ন ৪৫টি। গ্রাম ১ হাজার ২৯৪টি। নদী ৩টি। বিল ৪১ টি। মসজিদ আছে ৪ হাজার ৬৮০টি। বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১টি। মহাবিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৪৯টি, স্কুল অ্যান্ড কলেজ ৯টি।
এছাড়াও মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ২২৫টি, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৬টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩৭০টি, জাতীয়করণ মহাবিদ্যালয় ৩৩৫টি, মাদ্রাসা আছে ২৭৮টি, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ৬ এবং পিটিআই আছে ২টি। জেলায় মোট জমির পরিমাণ ১৭ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ হেক্টর। আবাদ হয় ১২ লাখ, ৯৭ হাজার ৫১ হেক্টর। জেলায় মৎস খামার আছে ৫৯৫টি। মৎস পোনা উৎপাদন খামার আছে ৯২টি। কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি আছে ১৫টি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সাবেক সাংসদ আব্দুল ওদুদ বলেন, জেলাবাসীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আধুনিক হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতসহ আধুনিক মানের হাসপাতালের প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান সরকারের আমলে হাসপাতালের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন পরিবর্তন হয়েছে। ফলে এ হাসপাতাল নির্মাণের পর জেলার মানুষের কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত হচ্ছে। এছাড়াও এ সরকারের আমলে সদর উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের জন্য একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে ওই ৭ ইউনিয়নের বাসিন্দারা নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারছেন।
আরও পড়ুন-‘দেশে মডেল জেলা হবে কুড়িগ্রাম’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে কানসাটে নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামে দেশের সব প্রজাতির আম গাছ রয়েছে। মিউজিয়ামটি নির্মাণের পর এখানকার জনগণের জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, সোনামসজিদের সঙ্গে যাতায়াত সহজ করতে ফোরলেন সড়কের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জেলা শহর থেকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনামসজিদ স্থলবন্দর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ কাজ শুরু হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জেলার অর্থনীতি উন্নয়নে ব্যাপক সাড়া ফেলবে। এছাড়া, মহানন্দা নদীতে দেশের সর্ববৃহৎ রাবার ড্যাম নির্মাণের কাজ অতিদ্রুত শুরু হতে যাচ্ছে। এটি হলে বছরজুড়ে নদীতে প্রবাহ রাখা ও সেচকাজে পানি ব্যবহার নিশ্চিত সম্ভব হবে। ফলে পাল্টে যাবে এলাকার দৃশ্যপট।