সোলার হোম সিস্টেম, মিনি-গ্রিড এবং সৌর সেচব্যবস্থার মতো বিতরণকৃত নবায়নযোগ্য প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ সাফল্য পেয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ খাতে গত ১৪ বছরে এক হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা অর্জন সফলতা নয়। সরকারের নীতি ব্যর্থ হয়েছে, এটি পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
তারা বলছেন, এ খাতের প্রসার আটকে আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সেবাপ্রাপ্তিতে ধীরগতির কারণে। অথচ এ খাতের বিকাশে নানামুখী পদক্ষেপের পাশাপাশি করছাড়ও দিয়ে রেখেছে সরকার।
বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০ শতাংশ ও ২০৪১ সাল নাগাদ ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে আগ্রহী। এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনাও রয়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ রয়েছে। গত ১৩ বছরে দেশের জ্বালানি খাতে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে। তবে বেশিরভাগ বিনিয়োগই হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানিকেন্দ্রিক।
এদিকে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে চারটি বড় বিতর্ক বা ভুল ধারণা চিহ্নিত করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। এগুলো হলো- সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলের ‘জীবনচক্র’ শেষ হওয়ার পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সবচেয়ে বড় বাধা জমির অপ্রতুলতা, সৌরপ্রযুক্তির সঙ্গে ব্যাটারির খরচ যুক্ত করলে এটি সাশ্রয়ী হবে না এবং ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কী সম্ভব!
সানেম বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে অর্জন করার মাধ্যমে বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সাফল্য অর্জনের বৈশ্বিক প্রবণতা ইতিবাচক হলেও বাংলাদেশ এখনও কোনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
তবে ভূমি, অর্থায়ন সংকট এবং বিশ্বব্যাপী সুদের হার বৃদ্ধি বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে বাধা তৈরি করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে পুরনো গ্রিড সঞ্চালন ও বিতরণ সিস্টেমকে ব্যয়বহুল করে তুলছে। পাওয়ার ট্রেডিং গতিশীল করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।
বলা হচ্ছে, ভবিষ্যতে সবচেয়ে সাশ্রয়ী হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। এমনকি, সাশ্রয়ী গ্যাসের চেয়েও কম দাম পড়বে। বাংলাদেশ ২০৪০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে তাদের কার্যক্রমের অগ্রগতি গড়ের চেয়ে অনেক নীচে অবস্থান করছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ১৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে কোনোটি নির্ধারিত সময়ে আসতে পারিনি। বিলম্বে কিংবা আংশিক উৎপাদনে আসে ৪টি, আর ৯টি এখনও উৎপাদনে যেতে পারি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে এলএনজি আমদানিনীতি সিদ্ধান্ত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কাতারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী এলএনজি আমদানির চুক্তি করা হয়েছে। আরও দুটি এফএসআরইউ (ফ্লোটিং গ্যাস রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) স্থাপনের চুক্তি করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য নতুন করে ২০টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আটটি প্রস্তাবের কথা বলছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি জানায়, বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে একটি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দক্ষ জনবল, বিনিয়োগবান্ধব প্রণোদনা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার এ খাতে নানা রকম করছাড় দিলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সেবাপ্রাপ্তিতে ধীরগতিসহ একাধিক জটিলতার সম্মুখীন হয়।
সংস্থাটি বলছে, সারা বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের দিকে আগ্রহ বাড়ছে। কারণ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় এটার কোনও বিকল্প নেই। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমাতে কার্বন নিঃসরণ কমাতেই হবে। না হলে সব দেশকেই জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ শঙ্কার মধ্যে পার হতে হবে। অনেকেই মনে করেন, নবায়নযোগ্য শক্তি একটি নতুন ধারণা। তবে, এটি সত্য নয়। প্রাচীনকাল থেকে সৌর ও বায়ুশক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার চলছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ম তামিম বলেন, সরকার ২০১০ সালে থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে তা মূলত বেসরকারি খাতে। এ খাতে গত ১৪ বছরে এক হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতা অর্জন সফলতা হতে পারে না, এটি পরিষ্কার ব্যর্থতা। এর জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারত্ব দরকার।