ফেনী-নোয়াখালীর বন্যার পানি গত তিন দিন থেকে ঢুকছে লক্ষ্মীপুরে। এ ছাড়াও, টানা ভারী বর্ষণে লক্ষ্মীপুরের সর্বত্র জলাবদ্ধতায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ইউনিয়নগুলোতে পানি নামতে শুরু করার পর গত শুক্রবার থেকে নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালীসহ খালসহ বিভিন্নভাবে ঢুকছে লক্ষ্মীপুরে। এতে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড ও পূর্বাঞ্চলের প্রায় সব কটি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সরেজমিন লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এলাকাবাসী, ত্রাণ বিতরণকারী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সোমবার (২৬ আগস্ট) রাতে বৃষ্টি হবার কারণে বন্যার পানির চাপ বেড়ে গেছে। নতুন করে আরও কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- জাদৈয়া, চাঁনখালি, আটিয়াতলী, লাহারকান্দি, মজুপুর, বাঙ্গা খাঁ।
পানিবন্দি এলাকা ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের ১টি পৌরসভা ও ৪৫টি ইউনিয়ন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি। এতদিন বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে ছিল। গত দুইদিন ধরে নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালী খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরে ঢুকে পড়ছে। এতে সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, মান্দারী, বাঙ্গাখাঁ, উত্তর জয়পুর ইউনিয়নসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রায় ৪ ফুট পানিতে ডুবে আছে জনপদ। বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
রামগতি ও কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা-হাজীগঞ্জ বেড়ির পশ্চিম পাশে ভুলুয়া নদীতে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পানিতে ডুবে আছে বিস্তীর্ণ জনপদ। রামগতি-কমলনগর, নোয়াখালীর আন্ডারচর ও চরমটুয়া গ্রামের ৩ লক্ষাধিক মানুষ চরম দুর্ভোগে জীবন কাটাচ্ছেন। জলাবদ্ধতার কারণে এ পানি কোথাও সরছে না।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ভারি বর্ষণ ও জোয়ারের কারণে এখন পর্যন্ত লক্ষ্মীপুর জেলায় ৬ লাখ ৫৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৯৫ ম্যাট্রিক টন চাল ও ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে পানিবন্দি মানুষের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য স্থায়ী ও অস্থায়ী ১৮৯টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত করা হয়। এরমধ্যে কয়েকটি সাইক্লোন শেল্টারে মানুষজন আশ্রয় নিয়েছে। সবাইকে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, নোয়াখালীর পানির চাপে চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, হাজীরপাড়া, দত্তপাড়া, মান্দারী, কুশাখালী, লাহারকান্দি, তেওয়ারীগঞ্জসহ কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। অনেক এলাকায় কোমর সমান পানি রয়েছে। ঘর-বাড়ির ভেতরেও পানি। অনেক এলাকায় নদী-খাল দখল করে মাছ চাষ, সেতু-কালভার্ট-রাস্তা, দোকানপাটসহ স্থাপনা নির্মাণ করার কারণে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোশারফ হোসেন বলেন, আমরা বিভিন্নস্থানে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের শুকনো খাবার বিতরণ করছি। পানির কারণে কিছু এলাকায় যাওয়া যাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে। তারা চালসহ সরকারি সহায়তা পাবেন।
লক্ষ্মীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জেপি দেওয়ান বলেন, নোয়াখালীর পানির চাপ লক্ষ্মীপুরে আসছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে আগামী দুইদিনের মধ্যে পানি নেমে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে।
সদর উপজেলার জকসিন আটিয়াতলী গ্রামের সাহেদ শরীফ নিজে পানিবন্দি হয়েও এলাকার মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ঢাকা থেকে তার চাচা ও চাচার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি প্রায় ৫০০ পরিবারের জন্য চাল-ডাল-আলু-দুধ ইত্যাদি শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করে তা এলাকার মানুষের মধ্যে বিতরণ করেছেন বলে জানান।
মালেকা আক্তারের বাড়ি চাঁনখালি গ্রামে। তিনি জানান, স্বামী-সন্তানসহ এখনো নিজ ঘরে অবস্থান করছেন। ঘর ছেড়ে গেলে গৃহস্থালির মূল্যবান আসবাবপত্র চুরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তার। তিনি বলেন, আমার ঘরসহ চারপাশ পানিতে ডুবে আছে। চুরির আতঙ্কে আমরা ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছি না। যাতায়াতব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে আমরা তেমন কোনও সহায়তাও পাচ্ছি না।
মালেকা আক্তারের পরিবারের মতো জেলার বিভিন্ন এলাকায় এরকম আরও অনেক পরিবার পানিবন্দি হয়েও নিজেদের ঘর আঁকড়ে পড়ে আছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে না পারার কারণে দৈনন্দিন ক্ষুধা নিবারণে সীমাহীন সংকটেও আছেন তারা। কারও কাছে লজ্জায় হাতও পাততে পারছেন না। এদের সংখ্যাও কম নয়।
স্থানীয়রা জানান, যুগীরহাটসহ ভেতরের গ্রামগুলোতে যারা বাড়িতে অবস্থান করছেন, তাদের অনেকের কাছেই ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিদিন হাজার হাজার প্যাকেট খাদ্য সহায়তা (ত্রাণ) বিতরণ করা হলেও যাতায়াতের দুর্ভোগসহ সমন্বয়হীনতার কারণে ওই সব এলাকায় অবস্থানকারীরা এর সুফল পাচ্ছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিঘলী, চরশাহী, বাঙ্গাখাঁ, মান্দারী ও লাহারকান্দি ইউনিয়নের ভেতরের দিকের এলাকায় পানিবন্দি হয়ে আছেন কয়েক হাজার পরিবার। অধিক পানি ও যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে এদের কাছে গিয়ে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া যাচ্ছে না। অতিরিক্ত পানির কারণে গ্রামীণ অভ্যন্তরীণ পাকা রাস্তাগুলোতেও চলাচল করা যাচ্ছে না। এতে সেখানকার পানিবন্দি মানুষগুলোর মাঝে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। এসব এলাকায় ত্রাণ বিতরণে নৌকার কোনও বিকল্প নেই। মান্দারী-দিঘলী সড়ক পানিতে ডুবে থাকায় যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে আছে।
ঢাকা থেকে বেসরকারি সংস্থা ‘ক্ষুধা নিবারণ’র তরফ থেকে ৫০০ পরিবারের জন্য শুকনো খাবার নিয়ে আসা প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলাম জানান, বুক সমান পানি পার হয়ে লাহারকান্দি ইউনিয়নের আটিয়াতলি গ্রামে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছি। এত পানির পরও ওই এলাকার অনেকেই আশ্রয়ণ কেন্দ্রে যায়নি। সরাসরি বন্যাদুর্গত মানুষদের হাতে সহযোগিতার উপহার তুলে দিতে পেরেছি, এটাই বড় প্রশান্তি।
ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে ত্রাণ দিতে আসা উত্তম ও আশিক জানান, তারা আজ (মঙ্গলবার) একটি আশ্রয়কেন্দ্রের ৩৬টি পরিবারকে তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওই সকল পরিবারের প্রায় ৫০টি শিশুর জন্য ২ প্যাকেট করে গুড়ো দুধও বিতরণ করেছেন। মনে প্রশান্তি নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন এই তরুণরা।
এদিকে, সরকারিভাবে যে পরিমাণ চাল ও অর্থ বরাদ্দ রয়েছে তাও অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান। মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) সকালে নিজ কার্যালয়ে তিনি বলেন, জেলায় ৭ লাখ ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এ পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য ৭০০ টন চাল এবং নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, শিশু খাদ্যের জন্য ৫ লাখ ও গো-খাদ্যের জন্য ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫০৯ টন চাল ও ১৬ লাখ টাকা ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় এ বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আরও ৩০ লাখ টাকার চাহিদা পাঠানো হয়েছে।