বিলেতই কি লন্ডন? দেশটির নাম ইংল্যান্ড বা ব্রিটেন বা ইউনাইটেড কিংডম, যা বাংলায় যুক্তরাজ্য। বাঙালিরা সেই শুরু থেকে ‘বিলেত’ বলে। রবীন্দ্রনাথও বিলেতেই গিয়েছিলেন! কেউ কেউ আবার লন্ডনও বলে, ইংল্যান্ড বা যুক্তরাজ্য তেমন কেউ বলে না। অনেকে ব্রিটেন বলে, কারণ ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ প্রায় দুইশ বছর শাসন করেছে। তবে লন্ডনকেই পুরনো বাঙালিরা বিলেত বলেই জানে। নতুন প্রজন্ম অবশ্য ‘ইউকে’ বা ইউনাইটেড কিংডম বলে। জিজ্ঞেস করলে জানায়- ইউকে যাচ্ছি। ইউকে মানে যুক্তরাজ্য।
এই যুক্তরাজ্য বা বিলেত নিয়ে অসংখ্য বাঙালি ভ্রমণগদ্য বা ভ্রমণ-লিপি লিখেছেন। যেমন ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ বা ‘বিলেতের পথে পথে’ ইত্যাদি। আমি নিজেও একটি গদ্য লিখেছি ‘জোয়ারে ফুলে ওঠে টেমসের বুক’। এই টেমস নদীই বিলেতের আনন্দ-বেদনা, নিত্য সৌন্দর্য। এই টেমসের পাড় ধরেই গড়ে উঠেছে পর্যটনের অধিকাংশ আয়োজন। বাঙালি ভ্রমণপিয়াসীরা অবশ্য শেক্সপিয়রের বাড়ি এবং লন্ডন থেকে প্যারিস যাওয়ার টানেল দেখতে চান। তবে প্রথম আমি টেমসের পাড় ঘুরে ঘুরে দেখেছি, দেখেছি লন্ডন আই, দেখেছি সেই টাওয়ারব্রিজ, অক্সফোর্ড স্ট্রীট, বার্কিংহাম প্যালেস, বিগ বেন, দেখেছি রানীর প্রাসাদ— এসব সাধারণ কৌতূহলী দেখা। কিন্তু শেক্সপিয়রের বাড়ি যেবার প্রথম লন্ডন গেলাম সেবার যেতে পারিনি।
আগের বার যা দেখা হয়নি, মনে মনে এবার দেখার ইচ্ছে নিয়েই— দ্বিতীয়বার বিলেত এলাম। আসার আগে ঢাকা থেকেই লন্ডনে তিন দিনের ভ্রমণ-সূচি করে এসেছি। এই ভ্রমণসূচি যার মাধ্যমে ঠিক করেছি তিনি জনাব গোলাম মোস্তফা। ঢাকার কেরানিগঞ্জের মানুষ, যিনি ঢাকা কলেজে পড়াশোনা করে পাড়ি জমিয়েছিলেন রাশিয়া। সেখান থেকে জার্মানি এবং এখানে পড়াশোনা শেষ করে লন্ডনে এসে স্থিত হন। এক সময় ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন এবং উদীচী করতেন।
বাংলাদেশের সেই ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর কাণ্ডারী হলেন লন্ডনে এসে। এই সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে, বাঙালিকে, বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ ধরে। গড়ে তুলেছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিষদ আর বিগত কয়েক বছর ধরে আয়োজন করে চলেছেন বাংলা বইমেলা। ২০০৬ সালে কবি শামসুর রাহমানের স্মরণ সভায় এসে তাঁর সংগঠনের পরিবেশনা উপভোগ করেছিলাম।
সেদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, মঙ্গলবার। তখন স্থানীয় সময় বিকাল ৫ টায় হিথ্রো বিমান বন্দরে অবতরণ করি। ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার পর জনাব গোলাম মোস্তফা ও লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানালেন। বিকাল ৫.৩০ মিনিটে বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে আসি। যেতে যেতে পূর্ব ভ্রমণে সেই স্মৃতি চোখে ভেসে উঠল। আমাদের দলনেতা ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বেশ কয়েকবার এসেছেন লন্ডনে। কিন্তু দলের অন্যান্য সদস্যরা প্রথমবারের মতো এসেছেন বলে, তাদের কৌতূহলী চোখ লন্ডনের সৌন্দর্য দেখায় ব্যস্ত। গাড়ি থেকে স্মার্ট ফোনে ছবি তুলছে আর জিজ্ঞাসার বাণ ছুঁড়ে দিচ্ছে।
ঘণ্টা দুয়েক পর আমরা উত্তর লন্ডনের আপটন পার্কের নিউহেমরে যাই। আমাদের জন্য ভাড়াকৃত নির্ধারিত রেস্টহাউজে লাগেজ রেখে ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যায় যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট ভবন ‘হাউজ অব কমন্স’ যাই। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে ব্যক্তিগত সফরে এসে আমি সেখানে যেতে পারিনি। এবার সেই সুযোগ করেছেন জনাব গোলাম মোস্তফা। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা; সম্ভবত মাইনাস ২ ডিগ্রি। বাতাস আমাদের পোশাক ভেদ করে শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। রীতিমত কাঁপন ধরে যাচ্ছে। কারণ এই তাপমাত্রা এই প্রথম অনুভব করছি।
২০০৬ সালে সামারে বা ইউরোপিয়ান গ্রীষ্মকালে এসেছিলাম। তখন ঠাণ্ডা টের পাইনি। এর মধ্যেই সিকিউরিটি দুর্গ অতিক্রম করে হাউজ অব কমন্সের ভেতরে প্রবেশ করলাম। সেখানে ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপন উপলক্ষ্যে একটি অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত দুই নারী সদস্য জনাব রওশনারা আলী ও জনাব রূপা হক উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে আমাদের দলনেতা সংস্কৃতি সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও আমাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। আমরা মঞ্চে উঠে মাতৃভাষা ও বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করি। এটি ছিল অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ অংশগ্রহণ।
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০। সকাল ১০ টায় Imperial War Museum-এ যাই। এটি পৃথিবীর উন্নত ও অত্যাধুনিক জাদুঘর। আমরা ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক গ্যালারি দেখি। ব্রিটিশদের বিভিন্ন যুদ্ধের নানামাত্রিক পর্বের ইতিহাস ও উপাদান তুলে ধরা হয়েছে নান্দনিকভাবে। এক একটি গ্যালারির সাজসজ্জা, নিদর্শনের প্রদর্শনী, আলোকসজ্জা ও সঠিক তাপমাত্রার পরিমাণসহ চমৎকার আয়োজন। গ্যালারি ও জাদুঘরের কিছু আলোকচিত্র নিয়ে আমরা চলে গেলাম যুক্তরাজ্যের অন্যতম বৃহত্তর মিউজিয়াম Victoria and Albert Museum-এ। পরিদর্শন শেষে আমরা আলোচনার টেবিলে বসলাম।
এক পর্যায়ে আমি তাদের কাছে জানতে চাই— এ রকম উন্নত জাদুঘার গড়ে তুলতে হলে কী কী বিষয়ের উপর গভীর দৃষ্টি দেওয়া দরকার? উত্তরে Nick Marchard তাদের বিশাল ও উন্নত জাদুঘর গড়ে ওঠার বিষয়ে চমৎকার তথ্য তুলে ধরেন। তিনি আরো বলেন, এজন্য জাদুঘর কর্মী, বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্টদেরকে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ, সেমিনার, সিম্পজিয়াম এবং গবেষণায় নিয়োজিত রাখতে হবে। ভিক্টোরিয়া এবং আলবার্ট মিউজিয়াম এরকম কর্মশালা ও গবেষণার আন্তর্জাতিক আয়োজন করে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তারা এসব আয়োজনে অংশগ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও বিশেষজ্ঞ পরামর্শের জন্য বিনিময় কার্যক্রম হতে পারে।
এরপর আমরা জাদুঘরের গ্যালারি পরিদর্শন করি। সত্যি অভিভূত হলাম এরকম বিশাল একটি জাদুঘর পরিদর্শন করে। তাদের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন, নিরাপত্তা ব্যববস্থা, দর্শক সেবা ইত্যাদি সবই অসাধারণ। আমাদের দলনেতা ড. মোস্তফা কামালের অনুরোধে এবং জনাব গোলাম মোস্তফার ব্যবস্থাপনায় মিউজিয়ামের ‘মসলিন’ স্টোরে ঢুকবার সুযোগ হয়। ভেতরে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম বড় একটি টেবিলে রাখা বেশ কয়েকটি ঢাকাই মসলিন। স্টোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানালেন, তাদের সংগ্রহে প্রায় ১৫০টি দুর্লভ মসলিন রয়েছে। মনে মনে বললাম, হায় দুর্ভাগা বাংলাদেশ তোমারই মসলিন, তোমার কাছে একটাও নেই!
বের হয়েই দেখলাম বাইরে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। এই তাপমাত্রায় আমরা অভ্যস্ত না হলেও ব্রিটেনবাসীরা মোটামুটি স্বাভাবিক চলাফেরা করছে। পরদিন মাইনাস দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও বরফ কুচি পতন ভেদ করে প্রচন্ড ঠান্ডার ভেতর আমরা সকাল ১০ টায় ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যাই। ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে ব্রিটিশ জাতির জন্য আস্থা, বিশ্বের প্রাচীন ও জীবন্ত সংস্কৃতি থেকে শিল্প এবং পুরাকীর্তির একটি সংগ্রহ ঝুলি বলা হয়। যেখানে সংগ্রহ করা আছে মানব ইতিহাসের দুই মিলিয়ন বছরের অস্তিত্ব।
বৃহৎ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে তারা মানুষদের বিশ্ব সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। জাদুঘরে সংগৃহীত আছে গ্রেট ব্রিটেন ও সারা বিশ্বের পোড়া কীর্তি ও ইতিহাস। পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে ৭০ লাখ দর্শনীয় প্রত্ননির্দশন সমৃদ্ধ এই জাদুঘর। ১৭৫৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাদুঘরটি। মোগল সভ্যতা থেকে শুরু করে ভারতীয় সভ্যতার অনেক নির্দশন পাওয়া যাবে এই জাদুঘরে। বিশেষ করে মিশরীয় সভ্যতার চমকপ্রদ মমিসহ মমি সংরক্ষণ স্থান মমি ফিকেশনের সকল নির্দশন রয়েছে এই জাদুঘরে। ব্যক্তিগতভাবে ২০০৬ সালে এই জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছিলাম। এবার আরো গভীরভাবে দেখার সুযোগ হলো।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০। ৩ দিনের যুক্তরাজ্য ভ্রমণ শেষ করে আমরা আর্জেন্টিনা যাওয়ার জন্য সন্ধ্যা ৬ টায় লন্ডনের গেটওয়ে বিমান বন্দরে যাই। জনাব গোলাম মোস্তাফা আমাদেরকে বিদায় জানান। উড়াল দেওয়ার আগে চোখ বন্ধ করে আবার দেখতে চেষ্টা করলাম— দেখা হলো কি শেক্সপিয়রের বাড়ি? হলো না ব্রিস্টল, বেলফাস্ট, লিভারপুল, ম্যানচেস্টার, কার্ডিফ কিম্বা এডেনবরা যাওয়া। দেখা হলো না সৌন্দর্যের লীলা কয়েকটি দ্বীপ— জায়ান্ট কজওয়ে, গওয়ার উপদ্বীপ কিংবা পিকজেলা। লন্ডন শহরের অলিগলিও দেখা হলো না ভালো করে। বাংলাদেশের একজন ক্ষুদ্র লেখক হিসেবে ব্রিটিশ কোনো কবি বা লেখকের সঙ্গে কি দেখা হলো? কথা হলো? মতবিনিময় হলো? জানা হলো কি অভিজাত জাতির খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক, জীবন-যাপনের চোরাগলি? ভাবতে ভাবতেই চোখ খুলে দেখলাম— গেটওয়ে বিমান বন্দরের অভ্যন্তরীণ আধুনিক রূপ। মন্দ কী! এক জনমে সব কী আর দেখা হয়?