একজন নারী যখন প্রকাশ্যে রাস্তায় ফুঁ দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দেয়, তখন আমারও এই ভেবে ভালো লাগে যে- মেয়েটি সমস্ত পুরুষতন্ত্রকে যেনো ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই রকম খুঁটিহীন স্বাধীনতার কোনো অর্থ আছে কি? বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর এত বছর হলো, আমরা এখনো প্রায় ওই এক জায়গাতেই আটকে আছি! ক্ষেত্রবিশেষে আমরা সেই সময় থেকে কয়েক পা পিছিয়েছি। এই সময়ে এসেও আমাদের শুনতে হচ্ছে- ‘গার্মেন্টসে কেন দিছেন আপনার মেয়েকে? ফজরে ৭/৮ টা বাজে চলে যায়, রাত ৮টা, ১০টা, ১২টায়ও আসে না। কোন পুরুষের সাথে ঘোরাফেরা করতেসে তুমি তো জানো না। কতোজনের মধ্যে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে, আপনে তো জানেন না। জেনা কইরা কইরা টাকা রোজগার করতেছে, কী বরকত হবে?’
যেখানে নারীসমাজের প্রতি সমাজের একটি বড় অংশের এমন ধারণা, সেখানে সিগারেটকে ইস্যু করে নারীবাদকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে কতটুকু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আছে? আর এসব খুঁটিহীন স্বাধীনতা যে মূলত পুরুষতন্ত্রের আরেকটি অস্ত্র এটা পশ্চিমের সচেতন নারীসমাজ এখন বুঝে গেছেন। এই সমাজের পুরুষদের এখনো এই পরিমাণ বিশ্বাস করা যাচ্ছে না যে, তারা কোনো প্রকার স্বার্থ ছাড়া নারীকে জায়গা করে দেবে। এ দেশের নারীকে আজ যতটুকু শিক্ষিত করা হয়েছে তা স্রেফ ভোট দেওয়ার জন্য, পুরুষতন্ত্রের দাসত্ব করার জন্য। এদেশে নারীদের পেশাগত যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তার ভাগিদার পুঁজিবাদ। কিন্তু পুঁজিবাদ যে তার স্রেফ প্রয়োজনেই নারীকে সামনে আনছে তা তাদের বিজ্ঞাপনগুলো থেকেই বোঝা যায়। তারা ভেবে দেখেছে এমন কিছু কাজ আছে যা পুরুষদের উত্তেজিত মাথা দিয়ে সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে তারা নারীর দ্বারস্থ হয়েছে। পুঁজিবাদের কাছে শুধু নারীই যে নারীর হাসিমুখ, সুললিত কণ্ঠ বিক্রি হয়েছে তা নয়, পুরুষকেও বিক্রি করতে হয়েছে তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবন। এদের কাছে পুরুষ এবং নারী দু’জনই আধুনিক দাস। প্রথমত এই দাসত্ব থেকে দু’জনকে একযোগে মুক্তি পেতে হবে। পুরুষ থেকে মুক্তি পেতে হবে এ কারণে যে, নারীর কোনো যোগ্যতাকে এখনো পুরুষ স্বীকৃতি দিতে পারেনি। অবশ্য পুরুষতন্ত্রের হস্তক্ষেপে নারীদের যোগ্যতাগুলো এখনো অবরুদ্ধ। কোনো কোনো শহুরে শিক্ষিত আধুনিক নারী পঞ্চাশ বছরে এসে জানতেও পারেন না যে তার যোগ্যতাগুলো এখনো অদৃশ্য শেকলে আবদ্ধ। পুরুষের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই সে তাকে স্পেস দিয়েছে।
এই সময়টা প্রযুক্তির, মস্তিষ্কের শক্তির চর্চা চলছে চারদিকে, পেশিশক্তির চর্চা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে নারীদের স্থান দখলের আরেকবার সুযোগ এসেছে, এমনটি ভাবলেও বোধ হয় ভুল হবে। কারণ পুরুষতন্ত্রের বাবা হচ্ছে পুঁজিতন্ত্র। যতদিন পর্যন্ত পুঁজিতন্ত্র ধ্বংস না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পুরুষতন্ত্র বিনাশ হচ্ছে না। হ্যাঁ, আমি নারীবাদীদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেই উৎসাহিত করব। তবে চোখ-কান খোলা রাখা উচিত যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আসা পুরুষ বিপ্লবীদেরও অনেকে এখনো জিন থেকে পুরুষতন্ত্র তাড়াতে পারেননি। সোভিয়েত ইউনিয়নেও সম্ভব হয়নি।
আশাহতের এই দিকটি শুধু আমাদের দেশের নারীবাদ নিয়ে নয়। পশ্চিমেরও প্রায় একই অবস্থা। পুরুষতন্ত্র ভয়ানকভাবে তাদের ব্যবহার করছে। শুধু নারীরা নারীদের দায়িত্ব নেবে, এই অবস্থাও দেশে এখন নেই। কারণ, অধিকাংশ নারীবাদীদের একটা বড় অংশই হলো পুরুষবিদ্বেষী অথবা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দ্বারা আক্রান্ত। যার কারণে নারীবাদ আরো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। নারীমুক্তির জন্য প্রয়োজন পুরুষ ও নারীর সমান অংশগ্রহণ। ব্যাপক অধ্যয়ন ছাড়া নারীবাদ নিয়ে এদেশে প্রচলিত ভ্রান্তিগুলো বোঝা অসম্ভব। প্রকৃত নারীবাদ যে আমাদের মধ্যে কখনোই দেখা যায়নি তা নয়, আমরা হয়তো সেসব সংগ্রামী নারীদের ভুলবশত মেরে ফেলছি।
লেখক: চলচ্চিত্রকার, প্রাবন্ধিক