শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে ২৬ বছর আগে। তখন বলা হতো ‘প্যাকেজ নাটক’। অর্থাৎ টিভি চ্যানেলের ব্যবস্থাপনার বাইরে গিয়ে নির্মিত নাটককে বলা হতো প্যাকেজ নাটক। তখন এই নাটককে দেখা হতো পরিচালকের স্বাধীনতা হিসেবে। অর্থাৎ চ্যানেলের খবরদারির বাইরে গিয়ে ভিন্ন কিছু করে দেখানো।
১৯৯৪ সালে শুরু, তারপর পেরিয়ে গিয়েছে ২৬ বছর। এই সময়ে প্যাকেজ শুধু নাটকে থেমে থাকেনি, ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে প্রায় সব রকমের অনুষ্ঠান এখন প্যাকেজেই হচ্ছে। তবে সময়ের সাথে সাথে সব কিছু যেমন বদলেছে, তেমনি বদলেছে প্যাকেজের ধরন। এখন সেরকমই একটি ধরন হচ্ছে ‘ওয়েব সিরিজ’ যা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য নির্মাণ করা হয়। ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে যদি প্যাকেজ নাটকের সময়ের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে বলা যায়, এখানেও নির্মাতা বা পরিচালক বেশ ‘স্বাধীনতা’ উপভোগ করেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই স্বাধীনতা উপভোগ করা হচ্ছে যতটা না সৃষ্টির জন্য তারচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্য।
ওয়েব সিরিজগুলো প্রথম থেকেই অশ্লীলতা বা ন্যুড কন্টেন্টের দোষে দুষ্ট ছিল। সেটা দেশেই হোক কিংবা বিদেশে। অন্যান্য দেশের বা পাশের দেশের নির্মাতাদের ভাবনা এমন, যেহেতু এখানে সেন্সরের ঝামেলা নেই, সুতরাং ‘বাজার’ ধরতে যা ইচ্ছা করা যায়। ফলে সেখানকার বেশিরভাগ ওয়েব সিরিজে যৌনতাকে উপজীব্য হিসেবে নেওয়া হয়েছে। কাহিনির প্রয়োজন হোক কিংবা না-হোক যৌনতা চলে আসছে বেশিরভাগ ওয়েব সিরিজে। যদিও এই ধারার বাইরেও বেশ ভালো কিছু কাজ দেশে বিদেশে হচ্ছে। তার সংখ্যাও নিতান্ত কম না। এখন বলিউডের অনেক তারকাকেও ওয়েব সিরিজে দেখা যায়। বাণিজ্যিক দিক থেকে ওয়েব সিরিজগুলো বেশ সফল। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও ভালো কিছু কাজের জন্য কিছু ওয়েব সিরিজ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। সম্প্রতি সৈয়দ আহমেদ শাওকীর পরিচালনায় ‘তকদীর’ ওয়েব সিরিজ ভারতের হইচই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়ার পর বেশ হইচই পড়ে যায়। প্রশংসায় ভাসছেন চঞ্চল চৌধুরী এবং নির্মাতা। কিন্তু তারপরেও ওই ‘কিন্তু’ থেকেই গেল...।
ভালো একটি কাজ শুধু অবাধ স্বাধীনতার ছোঁয়ায় থেকে গেল ‘পরিবারে নিয়ে’ দেখার বাইরে! জানি না এখনকার ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নির্মাতারা সিরিজ এবং ওয়েব সিরিজের পার্থক্য করতে কি অশ্লীলতাকে মানদণ্ড হিসেবে দেখাতে চান? ওয়েব সিরিজে হয় অশ্লীল দৃশ্য থাকবে অথবা অশ্লীল শব্দ। চঞ্চল চৌধুরীর সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করা সোহেল মণ্ডলকে (তকদীর সিরিজে মন্টু চরিত্র) দিয়ে বলানো হলো বেশ কিছু অশ্লীল শব্দ, যা সেই দৃশ্যের সাথে গেলেও পরিবার নিয়ে দেখার মতো বা শোনার মতো নয়। তকদীরের মন্টুর অশ্লীল বকাগুলো বাদ দেওয়া গেলে নিঃসন্দেহে এটি পরিবার নিয়ে দেখার মতো একটি সিরিজ ছিল। কিন্তু যে সিরিজ দেখলে একজন সাধারণ ছাত্র বা গৃহিণী এমন কিছু শব্দ শুনতে পাবেন যা হয়তো ড্রয়িং রুমে বসে শোনার কথা নয়।
‘তকদীর’ দেখার পর আলোচনার কথা ছিল- কেন চঞ্চল চৌধুরীর আড়ালে সোহেল মন্ডল চলে যাবেন? এমন দুর্দান্ত প্রাণবন্ত অভিনয় দেখা যায়নি দীর্ঘদিন। আলোচনা হতে পারতো- কেন শুধু তারকাখ্যাতির জন্যই সকল ক্রেডিট নিয়ে যাবেন চঞ্চল চৌধুরী? যেখানে পুরো গল্পটাকে নিজের কাঁধে টেনেছেন সোহেল চৌধুরী। এমনকি পার্থ বড়ুয়াও যে কোনো পেশাদার অভিনেতার চেয়ে কম নন, সেটাও প্রমাণ করেছেন। কিন্তু আলোচনা করতে হচ্ছে কেন এড়ানো গেল না অশ্লীল গালিগালাজ? এ ধরনের সংলাপ কি এ কারণেই যুক্ত করা হয়েছে যাতে মানুষ দেখেই বুঝতে পারে এটা টিভি বা সিনেমা প্ল্যাটফর্মের নয়, এটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের? অবাধ স্বাধীনতা কি শুধু অশ্লীলতাকেই উৎসাহ দেয়? সৃষ্টিশীলতার জন্য স্বাধীনতা নয়? হয়তো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এমনটাই শিখিয়েছে বা দাবি করে। তা না হলে নাটকের চেনা জানা অভিনেতারা কেন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে গেলে নিজের রুচি ও সংলাপের মাত্রা হারিয়ে ফেলবেন। নাজিয়া হক অর্ষা এবং আদনান ফারুক হিল্লোলরাই বা কেন ওয়েব সিরিজে গেলে শ্লীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে যান? এখন সময় এসেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নির্মাতাদের নতুন করে ভাবার, তারা কি নিজেদের কাজের কোয়ালিটি দিয়ে সিরিজ চেনাবেন, নাকি অশ্লীলতা দিয়ে বোঝাবেন এটা ওয়েব সিরিজ!