ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে এক দুরন্ত কিশোরের গল্প

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪০, ২৬ মার্চ ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধে এক দুরন্ত কিশোরের গল্প

সংগৃহীত

ফজলে আজিম : সাত্তারকে গ্রামের ছেলেরা সত্তর বলে ডাকতো। দেশে যখন যুদ্ধ বাঁধল তখন মেট্রিক পরীক্ষার্থী ছিল সে। গ্রাম থেকে ছেলে বুড়ো অনেকেই ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। কারও লক্ষ্য ছিল ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া, কারও লক্ষ্য ছিল দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া। বাবা-মাকে না জানিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতের পথে রওয়ানা হল সত্তর।

 

সত্তরের বাবা স্কুল শিক্ষক। ছোটবেলা থেকে নৈতিক শিক্ষা নিয়েই বেড়ে ওঠেছিল সে। ১৯৭১ সালে যখন দেশে যুদ্ধ বাঁধল তখন একদিন কয়েকজন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিল-‘আমরা যুদ্ধে যাব’। ভারতে তখন এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। প্রশিক্ষণ নিতে হাঁটাপথে ভারতে পাড়ি জমাল তারা। সত্তর তার বাবার পকেট থেকে ১০টাকা নিয়ে এক টুকরো কাগজে লিখে জানাল বাবা যুদ্ধে যাচ্ছি। চিন্তা করো না, তোমার পকেট থেকে ১০ টাকা নিয়ে গেলাম।

 

কয়েক দিনের হাঁটা পথে রওয়ানা হল তারা। যেতে যেতে সন্ধ্যা নেমে এল, তারা আশ্রয় নিল পথিমধ্যে অপরিচিত একটি বাড়িতে। যুদ্ধে যাবার কথা শুনে সাদরে তাদেরকে গ্রহণ করা হল।

 

রাতের অন্ধকার নেমে আসার আগেই তাদেরকে কিছু খাবার দেওয়া হল। সকালে রান্না করা খাবার, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও খেতে হল। অথচ এ ধরনের খাবার বাড়িতে হলে দুরন্ত কিশোরের দল সে খাবার মুখেই তুলতো না! রাতটি ওই বাড়িতেই কাটলো।

 

সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির কুপি নিভিয়ে ফেলা হল। কারণ দূর থেকে যদি কোনো ঘরে প্রদীপের আলো দেখা যায়, তাহলে কেউ মনে করবে এখানে মুক্তিযোদ্ধারা আছে। সন্ধ্যার পর তাই কুপি নিভিয়ে ফেলা হলো। তখন এখনকার মতো এত জনবসতি ছিল না। সন্ধার পর কোনো ঘরে বাতি জ্বললে অনেক দূর থেকে তা দেখা যেত।

 

রাতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাদের দেখা হল। দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত বিষয়টি গোপনীয় ছিল। রাতে এসে তারা খাবার খেতেন। কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার চলে যেতেন।

 

মহিলারা খাবার রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তা সরবরাহ করতেন। বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়েও খাবার দিয়ে আসতেন। ভোর হলে তারা রওয়ানা করলেন ভারতের পথে। পরদিন তারা পৌঁছালেন ভারতে একটি ক্যাম্পে, সেখানে বাংলাদেশ থেকে আগত লোকদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।

 

ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ চলাকালীন সবধরনের সহযোগিতা করা হত। খাবার, পোশাক সবই ক্যাম্প থেকে দেওয়া হত। ক্যাম্পে থাকাকালীন প্রতিদিন সকালে পাঁচমাইল পথ দৌঁড়াতে হতো। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল কঠোর। কেউ চাইলে হুট করে কোনো ক্যাম্পে ঢুকতে পারতো না। ক্যাম্পের প্রতিটি গেইটে আলাদা পাসওয়ার্ড থাকতো। পাসওয়ার্ড বলতে না পারলে কাউকে ক্যাম্পে ঢুকতে দেওয়া হতো না। গেইটে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হত ক্যাম্পে প্রশিক্ষণে আসা সাহসী ও সুঠাম দেহের জওয়ানদের। তারা দায়িত্বপালনে যেমন ছিলেন সাহসী তেমনি সিদ্ধান্তে অটল।

 

একদিন জিপে করে সাধারন পোশাকে এক মেজর আসলেন ক্যাম্প পরিদর্শনে। ক্যাম্পে প্রবেশ করতে গিয়ে পড়লেন বিপত্তিতে। কারণ তিনি পাসওয়ার্ড ভুল গেছেন! ক্যাম্পের প্রতিটি গেইটে আলাদা পাসওয়ার্ড ছিল। মেজর সাহেব ভুল পাসওয়ার্ড বলায় তাকে ফটকে আটকে দেওয়া হল। ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হল না।

 

পরে মেজর সাহেব ওয়াকিটকিতে কথা বলে ক্যাম্পের ওই গেইটের সঠিক পাসওয়ার্ড জানলেন। সঠিক পাসওয়ার্ড বলার পর জওয়ানরা নিশ্চিত হলেন (ছদ্মবেশী) মেজর কোনো গুপ্তচর নন। বিষয়টি ক্যাম্পের ভেতর থেকে একজন এসে নিশ্চিত করলেন। জানা গেল উক্ত মেজর ক্যাম্প ভিজিট করতে আসার কথা ছিল। ক্যাম্পে প্রবেশ পথে দায়িত্বশীল জওয়ানদের দায়িত্ববোধ দেখে তিনি অবাক হলেন। ভেতরে ঢুকে এক জওয়ানের পেটে দিলেন একটি ঘুষি! যে তাকে ঢুকতে দেয়নি।

 

ভয়ের কিছু নেই, এ ঘুষি সেই ঘুষি না। মেজর সাহেব গেইটে দায়িত্বশীল ওই জওয়ানের দায়িত্ববোধ দেখে খুশি হলেন। এর কারণ হচ্ছে রণাঙ্গনের প্রস্তুতি নিতে আসা এসব জওয়ানদের কেউই সেনা কিংবা অন্যকোনো সামরিক কায়দা সম্পর্কে প্রশিক্ষিত নয়। এরা ঘর ছেড়ে দেশ স্বাধীন করার জন্য বেরিয়েছে। আর তাই এরা অসাধারণ। উচ্চ প্রশংসিত হলো দায়িত্বরত সেই জওয়ান।

 

যুদ্ধের সময় প্রশিক্ষণ শিবিরে বহিরাগত কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হত না। তখন প্রতিটি গেইটে প্রবেশ করার জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড ছিল। যেমন কোনো গেইটের পাসওয়ার্ড ছিল টাকির মাথা, অপর গেইটের পাসওয়ার্ড ছিল চিংড়ির লেজ। এভাবে কানে কানে পাসওয়ার্ড বলে দেওয়া হতো। যাকে বলা হতো সে কারও কাছে তা বলতো না। 

 

তরুণ কিশোররামিলে বিকেলে নিকটবর্তী গঞ্জে গিয়ে দু’চার আনা করে খরচ করে খাবার কিনতো। এভাবে করতে করতে কয়েকদিন বাদে সত্তরের পকেটও প্রায় খালি। এরই মধ্যে সত্তরের বাবা যুদ্ধের আগেই ভারতে চলে আসা গ্রামের এক হিন্দু পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালেন সত্তর যুদ্ধে গেছে। এখন ভারতে আছে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গিয়ে তার খোঁজখবর রাখতে বললেন আর লোকমারফত কিছু টাকাও পাঠালেন। বললেন সত্তরের হাতে যেন টাকাগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়।

 

টাকাগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য ভারতে অবস্থানরত ওই প্রতিবেশি ক্যাম্পে গিয়ে সত্তরের খোঁজ করলেন। তখন সেখানের কর্তব্যরতরা তাকে খুঁজে বের করতে সহায়তা করলেন। তাকে খুঁজে পেতে প্রথমেই ক্যাম্পে জেলার নাম ধরে প্রথমে ডাকা হলো। এরপর মহল্লা। এরইমধ্যে একজন জানাল সত্তর ওই ক্যাম্পে আছে। খবর পাঠানো হল যোগাযোগ করতে।

 

এরই মধ্যে একদিন সময় হল অস্ত্র চালনা শেখানোর। সাধারণত যুদ্ধের কৌশল শেখানোর পর ক্যাম্প থেকে যোদ্ধারা দেশে ফেরত এসে যুদ্ধ করতেন। অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরুর আগে একজন আর্মি জিজ্ঞেস করলেন, তোরা কে কে রাইফেল চালাতে পারিস? সবাই চুপ! তখন একটা খারাপ গালি দিল- যাতে কেউ যদি সত্যিকার অর্থে রাইফেল চালাতে জানে তাকে বের করা যায়।

 

সত্তর তখন হাত তুলল, বলল, আমি পারি। কাছে ডাকা হল সত্তরকে। তার কাছে রাইফেলের দুরত্ব ঠিক করা ও রাইফেল চালনার বিষয়ে কৌশলে জানার চেষ্টা করা হল। সে-ও একে একে জবাব দিল। তখন, আর্মির মেজর বললেন, আমরা একটা ডাকাত পেয়েছি! আমরা একটা ডাকাত পেয়েছি! বল কোথায় কোথায় ডাকাতি করতি? কার কাছে রাইফেল চালানো শিখেছিস?

 

সত্তর তখন বলল, “যুদ্ধের সময় এক প্রতিবেশি প্রায়ই বাড়ির ওপর দিয়ে ক্যাম্পে যেত। তার কাঁধে রাইফেল থাকত। একদিন তার কাছে রাইফেল চালানো শিখতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন, আজকে না। কালকে সকাল সকাল আসবা, তখন শেখাবো। পরদিন তিনি আমাকে শেখালেন কীভাবে রাইফেলে গুলি ঢুকাতে হয়, লক্ষ্য সেট করতে হয়।”

 

সাহসী সত্তরকে এবার জিজ্ঞেস করা হল- কোন ক্লাসে পড়িস? সে বলল এবার মেট্রিক পরীক্ষার্থী। জ্যামিতির কোণ সম্পর্কে তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হলো। সত্তরও একে একে জবাব দিল। মেজর খুশি হলেন। তাকে আদর করলেন। অনুপ্রেরণা দিলেন। ক্যাম্পে সবাই তাকে দেখার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠল। এভাবে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটতো।

 

ক্যাম্পে আসা অধিকাংশই ছিল বয়সে তরুণ। প্রশিক্ষণ শেষে তারা দেশে ফিরে যেত, বিভিন্ন টিম আকারে তারা অপারেশনে ঝাঁপিয়ে পড়তো শত্রুদের আস্তানায়। তারা নিজেরা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিত আর আগ্রহীদের যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিত। এভাবে চলল দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।

 

অবশেষে এল ষোল ডিসেম্বর। যুদ্ধ শেষ হল। আমরা পেলাম স্বাধীনতা। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে কেউবা মায়ের কোলে ফিরল আবার কেউবা হয়েছেন পুত্রশোকে কাতর। যারা তাদের সন্তানের মরদেহ দেখার সুযোগও পাননি।  

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ মার্চ ২০১৬/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়