ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

রজনীগন্ধাপুর : সূচনা পর্ব

ইমদাদুল হক মিলন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০১, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রজনীগন্ধাপুর : সূচনা পর্ব

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

এক অসহায় পিতা

আমি একজন বাতিল মানুষ।

এই বাতিল মানুষটাকে নিয়ে কেন যে ওরা টানাটানি করলো? তোমরা আউটিংয়ে আসবে, আসো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনটা এখানে কাটাবে, কাটাও। আমাকে কেন? আমি আমার মতো বাড়িতেই থাকতাম। জুলেখার মা প্রতিদিনকার মতো রান্নাবান্না করতো। আমার যেভাবে দিন কাটে, কাটতো।

বাতিল মানুষদের দিন সহজে কাটতে চায় না। কাজ কাম নেই, কাটে কী করে?

তার পরও কেটে যায়। সময় কাটাবার পথ তারা বের করে নেয়। আমিও আমার মতো কয়েকটা পথ বের করে নিয়েছি।

সকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে উঠে টয়লেট ইত্যাদির কাজ সারি। তার আগে দুগ্লাস পানি খাই। কয়েক মিনিট নিজের রুমেই হাঁটাহাঁটি করি। ফলে বেগটা ভালো হয়। টয়লেটে গেলেই পেট একদম পরিষ্কার। তারপর দুটো বড় সাইজের সুগার ফ্রি বিস্কুট খেয়ে, আরেক গ্লাস পানি খেয়ে ঢোলা টাইপের সূতি টাউজার্স আর টিশার্ট পরে, পায়ে কেডস, হাঁটতে বেরিয়ে যাই।

 

সেগুন বাগিচা থেকে রমনা পার্ক কাছে। শিল্পকলা একাডেমি আর দুর্নীতি দমন কমিশন অফিসের মাঝখানকার রাস্তা দিয়ে যতদূর সম্ভব লম্বা পায়ে হাঁটা ধরি। কয়েক মিনিটের মধ্যে রমনা পার্ক।

সকালবেলা বিকাল বা সন্ধ্যাবেলা রমনা পার্কে আজকাল এলাহি কাণ্ড। শত শত মানুষ হাঁটতে আসে। বিভিন্ন বয়সের মানুষ। সকালবেলা প্রচুর মহিলাও আসেন, কিশোরী যুবতী মেয়েদেরও দেখা যায়। দল বেঁধে হাঁটছে, একা বা দুজনে মিলে হাঁটছে। সংগঠন আছে অনেকগুলো। বাঙালিদের যা স্বভাব! একটা সংগঠন হলো তো তার দেখাদেখি আরও চার পাঁচটা হয়ে গেল।

পুরুষদের সংগঠন দশ বারোটার কম হবে না। মহিলাদেরও চার পাঁচটা হবে। পুরুষরা পুরুষদের মতো স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যস্ত, মহিলারা মহিলাদের মতো। একসঙ্গে হাঁটছেন, নানা রকম শারীরিক কসরৎ করছেন। তাঁদের প্রায় সবাই মোটা। ছমাস এক বছর ধরে দেখার পরও দেখছি স্বাস্থ্য তাঁদের কমছে না। বরং কাউকে কাউকে দেখে আমার মনে হয়, আগের তুলনায় যেন একটু বেড়েছেন। কমার লক্ষণ চোখেই পড়ে না।

পুরুষদেরও প্রায় একই অবস্থা।

 

কারণটা পরে আমি উদ্ধার করেছি। সংগঠনগুলো খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু নিয়ম করে নিয়েছে। বিশেষ করে সকালবেলার সংগঠনগুলো।

ছুটিছাটার দিনে, শুক্র শনিবার, ক্লাব মেম্বারদের একেকজনের ওপর একেক দিনকার নাশতার দায়িত্ব পড়ে। যার ওপর দায়িত্ব তিনি হয় তাঁর বাড়ি থেকে নয় ভালো রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিয়ে বিশ চল্লিশজনের নাশতা নিয়ে আসেন। পরোটা, গরু খাসির মাংস। মুরগি ভূনা। কোনওদিন নেহারি, নানরুটি। সকালবেলাই মুরগির বিরানি কিংবা বিখ্যাত বাবুর্চিদের কাচ্চি পর্যন্ত দেখা যায়। একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে নাশতা করেন তাঁরা। হাঁটাহাঁটি করে যতটা বার্ন করেন, গেইন করেন তার তিনগুণ। ফলে শরীর কমে না। হাঁটাচলা আর ব্যায়াম করে উল্টো ক্যালরি বাড়িয়ে বাড়ি ফেরেন।

তবে তাঁদের ওই খাওয়া-দাওয়ার আনন্দ গল্পগুজব আর হাসি ঠাট্টাটা দেখার মতো। গভীর ফূর্তিতে থেকে কাজটা তাঁরা করেন। দেখে আমার খুব ভালো লাগে। বেঁচে থাকার জন্য আনন্দটা খুব জরুরি।

 

এই জরুরি ব্যাপারটা আমার জীবন থেকে উধাও হয়ে গেছে।

পার্কের পশ্চিম দিকটায়, ঢাকা ক্লাবের দেয়ালের ওদিকটায় বেশ বড় একটা মাঠ। চারদিকে গাছপালা মাঝখানে সবুজ ঘাসের মাঠ। দক্ষিণে লেক। ওই মাঠটায় একজন ফিজিক্যাল ইন্সট্রাকটর জনা চল্লিশেক বিভিন্ন বয়সী পুরুষ মানুষকে এক্সারসাইজ করান। নিশ্চয় চাঁদা করে তাঁকে পে করা হয়। ভদ্রলোক ট্রাক স্যুট কেডস পরে শরীরের একেকটা ভঙ্গি করেন, তার দেখাদেখি অন্যরাও তাই করে। একটা পর্যায়ে শুরু করেন হাসি। কে কতটা উচ্চস্বরে হাসতে পারেন তার প্রায় একটা প্রতিযোগিতা।

আমি হয়তো তখন হাঁটার ফার্স্ট রাউন্ড শেষ করে সেকেন্ড রাউন্ড শুরু করেছি। সেগুন বাগিচা থেকে পার্কের পুবদিককার গেট দিয়ে ঢুকি। ঢুকে প্রথমে যাই উত্তরে। বকুলগাছগুলোর তলা দিয়ে হেঁটে পুরো পার্ক ঘুরে আবার ওখানে এসে শেষ করি ফার্স্ট রাউন্ড। তারপর শুরু করি সেকেন্ড রাউন্ড। দুই রাউন্ডে আমার সময় লাগে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন মিনিট।

সেকেন্ড রাউন্ডের সময় ওদিকটায় এসে দেখি হাসি শুরু হয়ে গেছে। এ রকম হাসিতে নাকি হার্ট ভালো থাকে।

মানুষের হাসি দেখলে আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কারণ আমার জীবন থেকে হাসি উধাও হয়ে গেছে। আমি হাসতে ভুলে গেছি।

আজ সাত বছর আমি হাসি না।

 

খুব কম লোকই পার্কে দুবেলা হাঁটতে আসেন। আমি সেই কম লোকদের একজন যে দুবেলাই আসি। সকালবেলা ছটার দিকে। সাতটার মধ্যে হাঁটা শেষ। তারপরও অনেকক্ষণ পার্কের বেঞ্চে বসে থাকি। বসে বসে নিজের জীবনের কথা ভাবি। একটা সময়ে ধীর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরি। আটটা সোয়া আটটা বেজে যায়। বাড়ি ফাঁকা। ছেলেমেয়ে নিয়ে মিলিয়া চলে গেছে স্কুলে।

মিলিয়া আমার একমাত্র ছেলের বউ। সে স্কুল টিচার। যে স্কুলে পড়ায় সেই স্কুলেই আমার নাতি নাতনিরা পড়ে। নাতনিটা বড়। নাম মুনা। নাইনথ গ্রেডে পড়ছে। নাতির নাম অপু। সে পড়ে ফিফথ গ্রেডে।

মিলিয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স। খুব ভালো ছাত্রী ছিল। ছেলেমেয়ে দুটিও হয়েছে ওর মতোই।

তবে মিলিয়ার চেয়ে অনেক বেশি ব্রিলিয়ান্ট ছিল আমার দিপু। গভর্মেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের ছাত্র। এক থেকে দশের মধ্যে রেজাল্ট। এসএসসি এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করলো। এসএসসিতে ফিফথ, এইচএসসিতে সেভেনথ। বুয়েটে ভর্তি হলো আর্কিটেকচারে। সেখানেও দুর্দান্ত রেজাল্ট। পাস করে বেরিয়ে ওর সবচাইতে প্রিয়বন্ধু জামি, জামির সঙ্গে আর্কিটেকচারাল ফার্ম করল। ছোট্ট একটা অফিস নিল লালমাটিয়ায়। ধা ধা করে উন্নতি। মিলিয়ার সঙ্গে ভাব ছিল। মিলিয়াদের পরিবার ভালো। বাবা জয়েন্ট সেক্রেটারি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। আমার যেমন একটামাত্র ছেলে, তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। মিলিয়াই বড়। ভদ্রলোকের নাম মনজুর হোসেন। দুই পরিবার মিলেমিশে ভালোভাবেই বিয়েটা হলো।

 

তিন বছরের মাথায় আমি দাদা হয়ে গেলাম। মুনা এল সংসারে, অপু এল। সেগুন বাগিচার বত্রিশ শো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনে ফেলল দিপু।

এসময় আচমকা চলে গেলেন দিপুর মা।

আগা গোড়াই রোগা দুর্বল শরীরের মানুষ। প্রচণ্ড জ্বর ছিল। রাতে ওয়াশ রুমে গিয়ে এমন ভাবে পড়ে গেলেন, মাথা প্রচণ্ড শব্দে লাগল বেসিনের সঙ্গে। সেই শব্দে আমি দৌড়ে গেছি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দিপু মিলিয়া দৌড়ে এল। দরজার লক ভেঙে বের করলাম তাঁকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বাথরুম। মাথা ফেটে চৌচির। জ্ঞান নেই। নিয়ে গেলাম পিজিতে। দিপুর পরিচিত ডাক্তার ছিল। আমারও পরিচিত আছেন কেউ কেউ। চিকিৎসার ত্রুটি হলো না। কিন্তু জ্ঞান ফিরল না তাঁর। অজ্ঞান অবস্থাতেই আট দিনের মাথায়...

 

তাঁর নাম ছিল মায়া।

আমি খুবই নামকরা একটা গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর। ঊনষাট বছর বয়স। চাকরি জীবন শেষ হয়ে আসছে। তার আগেই প্রিয় মানুষটি আমাকে ছেড়ে গেলেন। জগৎসংসারের মায়া কাটিয়ে কোন অচিনলোকে চলে গেলেন মায়া। আমার জীবন থেকে হাসি আনন্দ অনেকখানি চলে গেল!

বাকিটা গেল দিপু চলে যাওয়ার পর...

সকালবেলার হাঁটা শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আটটা সাড়ে আটটা। শুক্র শনিবার ছাড়া বাড়ি নিঝুম। শুধু জুলেখার মা একা এতবড় ফ্ল্যাট আগলে বসে আছে।

বহু বছর হলো মহিলাটা আমাদের সঙ্গে। বছর তিরিশেক হবে। দিপুর কিশোর বয়সে এসেছিল। আমার সংসারের এই এতগুলো দিনের সাক্ষী। সব দেখেছে। আলো অন্ধকার, আনন্দ বেদনা। সুখ দুঃখ হাসি কান্না। মায়া তাকে সব শিখিয়ে ছিল। আমাদের রুচি, চালচলন, রান্নাবান্না অতিথি আপ্যায়ন। ধীরে ধীরে সব রপ্ত করল মহিলা। সংসারের অংশ হয়ে গেল।

অল্প বয়সে এক মেয়ে নিয়ে বিধবা হয়েছিল। পিরোজপুরের মানুষ। মেয়ের নাম জুলেখা। কোনও কোনও মানুষের জীবন যে কী অদ্ভুত হয়! এতবড় পৃথিবীতে কেমন কেমন করে যেন সে একা হয়ে যায়। একদমই একা। চারদিকে এত মানুষ কিন্তু তার থাকে না কেউ।

জুলেখার মার জীবনটা তেমন।

কোলে এক দেড় বছরের শিশু জুলেখা। বিধবা হয়ে ভাইদের সংসারে ফিরে এল। গ্রাম এলাকার গরিব গৃহস্থ ঘরের মেয়ে। ভাইরা তাকে খাওয়ায় পরায় কী করে? এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে মেয়েকে বড় করে। ভাইরা শুধু আশ্রয়টুকু দিয়েছে। বাপের বাড়ি। মহিলারও তো বাড়ির ভাগ, জমাজমি যেটুকু আছে তার ভাগ প্রাপ্য। দুই ভাইয়ের একবোন। ভাইরাও এই কারণেই আশ্রয় দিয়েছে। গাছপালা ঘেরা গরিব গৃহস্থ বাড়ির এককোণে এক কুঁড়েঘরে মেয়ে নিয়ে থাকতো মহিলা। গ্রামের এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে যা পেত, মেয়ে নিয়ে খেয়ে বাঁচতো। ধানের সিজনে ভালই কাটতো দিন। খাওয়ার অভাবটা হতো না। অন্য সময়, বর্ষা বাদলের দিনে তীব্র অভাব, না খেয়ে থাকা।

 

 

এ রকম জীবনই তো ছিল এক সময় এদেশের গ্রাম এলাকার গরিব মানুষদের। বাংলাদেশের মানুষদের জীবনমান বদলাতে শুরু করলো স্বাধীনতার পর। পাকিস্তান আমলে যে জীবন এদেশের মানুষের ছিল, বিশেষ করে কৃষিজীবী, নিম্নবর্গের মানুষদের, সে অবর্ণনীয়।

ওই জীবনেই মেয়েটিকে কোনও রকমে বিয়ে দিয়েছিল মহিলা। বছর দেড়েকের মাথায় মা হতে গিয়ে মারা গেল জুলেখা।

মহিলা একা, একদম একা।

তারপর ঘটলো আরেক ঘটনা। ভিটামাটি গেল নদী ভাঙনে। দুই ভাই তাদের সংসার নিয়ে বাঁচার আশায় একেকজন গেল একেক দিকে।

জুলেখার মাকে কে নেবে?

সে তো বোঝা!

তাকে নেবে কে?

মহিলা ঢাকায় এল কাজের আশায়। মায়ার বাপের বাড়ির দিককার এক বুয়াকে ধরে এল আমার সংসারে। সেই যে এল, আর গেল না।

কোথায় যাবে? তার তো যাওয়ার জায়গা নেই। ভাইরা কে কোথায় আছে, পরে জেনেছিল। তাদের ছেলেমেয়েরা কে কোথায় আছে, মেয়েদের কার কোথায় বিয়ে হয়েছে কোনও না কোনওভাবে জেনেছে। তারাও নিশ্চয় জেনেছে জুলেখার মা কোথায় আছে। আশ্চর্য ব্যাপার, এই এতগুলো বছরে একজন মানুষ কোনওদিন খোঁজ নিতে আসেনি মানুষটি বেঁচে আছে, না মরে গেছে!

জুলেখার মা জেনেছে তার দুই ভাইই মারা গেছে। ভাইদের জন্য চোখের পানিও ফেলতে দেখেছি তাকে। কিন্তু ভাইরা বেঁচে থাকতে কোনওদিন খোঁজ নিতে আসেনি একমাত্র বোনটির?

এমন হয় মানুষ!

তাহলে রক্তের সম্পর্ক ব্যাপারটা কী?

রক্তের টানেও কি কেউ ছুটে  আসে না কারও কাছে!

 

মায়া বেঁচে থাকতে দুয়েকবার জুলেখার মাকে বলেছে, তোমার ভাইরা বা তাদের ছেলেমেয়েরা তোমার খোঁজ খবর করে না। তুমি করো! খোঁজ নিয়ে তুমি যাও। দেখা করো তাদের সঙ্গে। তুমি তো আর থাকতে যেতে যাচ্ছো না। মাসে মাসে যে বেতন তোমার জমছে ওই টাকা খরচ করে তাদের সঙ্গে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসো।

জুলেখার মা যায়নি। মনের ভিতর কোথায় যেন একটা অভিমান জমে পাথর হয়ে গেছে। সেই পাথর এই জীবনে আর ভাঙবে না। সে যায়নি।

তবে খুবই ধর্মপ্রাণ মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। কখনও কখনও পুরান ঢাকায় যায়। কোন কোন বস্তিতে তাদের এলাকার কিছু মানুষজন থাকে। তাদের খোঁজ খবর করে। কারও অসুখ বিসুখে, মেয়ের বিয়েতে নিজের বেতনের জমানো টাকা থেকে টাকা পয়সা দিয়ে আসে।

জুলেখার মার কথা ভাবলে অবাক লাগে আমার। অদ্ভুত জীবন। নদীর স্রোতে খড়কুটো ভেসে যাওয়ার মতো ভাসতে ভাসতে আমাদের সংসারে এল। প্রকৃত অর্থে কোথাও কেউ নেই। এখন আমরাই সব। এই সংসারই তার সংসার। অন্যের সংসার সামলাতে সামলাতে বুড়ো হতে চলল। একদিন এই সংসারেই মরণ এসে থাবা দিয়ে নেবে। আমরা তাকে কবর দিয়ে আসবো। শেষ। একটা জীবন শেষ।

কী পেল এই মানুষটা তার জীবনে?

হত দরিদ্র পরিবারে জন্ম। অল্প বয়সে বিয়ে। জীবন বুঝতে না বুঝতে স্বামীহারা। কোলের সন্তান নিয়ে খাওয়া পরার যুদ্ধ। চার দিককার পুরুষদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা, মেয়েকে রক্ষা করা। সেই মেয়েও চলে গেল একটা সময়ে।

তারপর?

কী পেল মানুষটা এই পৃথিবীতে!

এই কি মানুষজীবন!

তবে কর্মঠ মানুষ বলতে যা বোঝায়, জুলেখার মা তাই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর সংসারের কাজ। বাজারঘাট দোকানপাট, যা যা একটা সংসারে দরকার সব একা হাতে করে। মায়া থাকতে মায়াকে জিজ্ঞেস করতো, কোনটা করতে হবে, কী রান্না হবে।

প্রথম প্রথম মায়া বলতো। একটা সময়ে আর বলতে হতো না। ধীরে ধীরে নিজেই বুঝে নিয়েছিল সব। মায়ার কিছু বলতেই হতো না।

আজও সেই অবস্থাই চলছে। মিলিয়াকেও বলতে হয় না কিছু। মিলিয়া থাকে নিজের স্কুল আর ছেলেমেয়ে নিয়ে। আমি আমার মতো আর পুরো সংসারটা ভেতর থেকে চালিয়ে নিচ্ছে জুলেখার মা।

কথা কম বলা মানুষ। চলাফেরা নিঃশব্দ। আমরা টেরই পাই না অথচ সব ঠিকঠাক চলছে। এত সৎ, এত ভাল মানুষ, কী অদ্ভুত জীবন তার...

হাঁটা শেষ করে বাড়ি ফিরে দেখি টেবিলে সব সাজানো। একবাটি সবজি, একটা সিদ্ধ ডিম, চারটা ছোট ছোট পাতলা আটার রুটি, এক টুকরা লেবু, একটুখানি পাকা পেঁপে। ডায়াবেটিস রোগীর নাশতা। একপাশে অষুদের ছোট্ট ব্যাগ, পানির বোতল গ্লাস।

 

ডায়াবেটিসটা হলো দিপু চলে যাওয়ার পর।

তখন উদভ্রান্তের মতো জীবন আমার। যে গেছে সে তো গেছে! তাকে তো আর ফিরে পাবো না। সংসারের কী হবে? মিলিয়া আর মিতুয়া অপু। মিলিয়া সুন্দরী মেয়ে! কাঁচা বয়স। কী করবে সে? আবার বিয়ে করবে? বিয়ে করলে আমার নাতি নাতনির কী হবে? অন্যের সংসারে গিয়ে কেমন হবে তাদের জীবন? আমার একমাত্র ছেলের সন্তানেরা বাবা ডাকবে আরেকজনকে? কেমন করে আমি তা সহ্য করবো?

আমার তখন এই এক চিন্তা।

মিলিয়ার বাবা মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলতে যাই। মিলিয়ার ছোট ভাই দর্পণ। খুবই ভালো ছেলে। বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল। সেও ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভাবে। মিলিয়ার মা বাবা দুজনেই আমার মতো চোখের জলে ভাসলেন প্রথম প্রথম। তারপর তাঁরাও চিন্তিত হতে লাগলেন মেয়ে আর নাতি নাতনির ভবিষ্যৎ ভেবে।

মানুষের নিয়মই এরকম। যতবড় বিপদই জীবনে আসুক, যতবড় শোকের ঘটনাই ঘটুক, সেই ধাক্কা সামলে মানুষ একসময় নিজের দিকে তাকায়। যে মানুষগুলো তার পাশে আছে তাদের দিকে তাকায়। তাদের নিয়ে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করে। নিজের অজান্তেই শুরু করে অন্য রকমের এক যুদ্ধ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়