ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

উদযাপনের নয় চাই শক্তির নববর্ষ || অজয় দাশগুপ্ত

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৭, ১০ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উদযাপনের নয় চাই শক্তির নববর্ষ || অজয় দাশগুপ্ত

অজয় দাশগুপ্ত : বাংলা নববর্ষের জাতীয় উৎসবে পরিণত হওয়া খুব বেশি দিনের কথা নয়। এর আগেও ছিল, তবে এমন ঘটা করে পালিত হতোনা।

আমাদের ছেলেবেলায় চৈত্র সংক্রান্তি ছিল অনেক পদ দিয়ে রান্না করা ব্যন্জনের দিন। মা খালারা বাবা বা অভিভাবকরা বাজার করে আসার পরপরই রন্ধনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। চৈত্র নিদাঘ গরমের মাস। এই ব্যন্জনের মূল পদগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কেন এর প্রচলন। যত তিতা যত শাক যত তরকারি তার বেশির ভাগই মূলত গরম সহায়ক। এর সাথে যুক্ত ছিল বাংলার মাটি ও ঐতিহ্য থেকে আহরিত শিবের গাজন। মুখোশের নাচ।

আমরা দেখতাম বহুরুপীরা এসব সাজে সেজে সন্ধ্যার পর বাড়ির উঠোনে উঠোনে নেচে বেড়াতেন। ঢাক ঢোল আর বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাদের নাচ ছিল উৎসবের প্রস্তুতি। ঐদিন হালখাতা লেখার প্রচলন ছিল দোকানে দোকানে। দোকানীরা জিলিপি বাতাসা রসগোল্লার মত মিষ্টি মজুদ রাখতেন। যথাসম্ভব কাউকে ফিরাতেন না তারা।

এখন সময় পাল্টে গেছে। চাইলেও আর আগের মত সে সব নিয়ে মেতে ওঠা যাবে না। তা ছাড়া সেই গাজন বা নাচের শরীরেও এসেছে পরিবর্তন। সেটা মানার পর ও বিস্ময় মানি কি কারনে হঠাৎ করে আমিষ ইলিশ দখল করে নিলো বৈশাখের মূল জায়গা। পান্তা ভাত আর ইলিশ সহযোগে বৈশাখ পালনের আজ যে সমারোহ তার সাথে অতীত বা ঐতিহ্যের কোনো মিল নাই। আমরা চিরকাল হুজুগে জাতি। যখন যেটা মাথায় ঢোকে সেটা নিয়েই মেতে উঠি আমরা। পান্তা ইলিশ এখন এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে এটি নাহলে নাকি পহেলা বৈশাখই হয় না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই পান্তা ইলিশ এখন দেশের বড় বড় হোটেল থেকে মেলার অনিবার্য অংশ। তার দাম তার চাহিদা তার সামাজিক স্ট্যাটাস এখন আকাশচুম্বি। আমি বিষয়টা নিয়ে বলছি এই কারণে আজকের বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে ঘটে চলেছে তার সবটাই প্রায় হুজুগ।

চোখ মেলে দেখুন, বাংলাদেশের নারীরা কী আগের মতো আছেন? একাত্তরে যে দেশের জন্ম যে দেশের নারীরা খোলা চুলে কাঁধে বন্দুক নিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছিল আজ তাদের কী চেহারা? দেশের নারীকূলের মাথা দেখা যায় না আর। সেটা কি আসলে ধর্ম না কোন বিশ্বাস? না মরুর হাওয়া? এই হাওয়ায় তাদের কাঁধের এককালের মুক্তির বন্দুক আজ হয়ে গেছে জঙ্গির হাতিয়ার। চিরকাল জেনে আসা মায়ার দেশ মমতার সমাজে নারীরা ভবনের ভেতর থেকে আইনের সাথে যুদ্ধ করে। লড়াই করে এদেশের নিয়মিত বাহিনীর সাথে। কেন? তারা এই কাল ইহকাল বা আজকের কিছুতে বিশ্বাস করে না। তাদের মগজে মস্তিস্কে পরকাল। যার সাথে ধর্মের আসলে কোনো যোগ নাই। চিরকাল যে আলো আমাদের পথ দেখিয়েছে, যে ধর্ম আমাদের সাম্য ও মৈত্রীর বাণী শুনিয়ে মহান করে তুলেছিল এরা তাকে বিতর্কিত করে ফেলছে। এরা এদেশের পানি হাওয়া কিংবা সংস্কৃতি কিছুতেই তাদের বিশ্বাস নাই। নাই বলেই এরা আমাদের জাতীয় পতাকা গান ভাষ্কর্য সবকিছু ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে চায়। যদি তাই হয় বা হতে থাকে তাহলে কিভাবে পহেলা বৈশাখ নিরাপদ থাকবে দেশে?

পুরুষদের অন্তর আর বাইরে চলছে নিত্য দ্বন্দ্বের এক আশ্চর্য খেলা। তারা ভেতরে ভোগী বাইরে সুশীল। সামাজিক মাধ্যমের কিটরা খুব ভালো ভাবে জানে তারা এখানে কী করে? আজ দেশে যে পুরুষতন্ত্র দাপটের সাথে ঘুরে বেড়ায় সমাজ শাসন করে তাদের ভেতর বাঙ্গালিয়াবা নেই বললেই চলে। হিল্লি দিল্লি ঘুরে বেড়ানো এদের সাথে বাঙ্গালিয়ানার সম্পর্ক এখন শূন্যের কোঠায়। চারিত্রিক বিশৃঙ্খলা বহুগামিতা আর বান্ধবীর নামে পরকীয়ার সমাজে একদিন সকালে নতুন পান্জাবি বা পোশাক পরে ঘুরলেই বাঙ্গালি হওয়া যায় না। তাও একবেলার জন্য। সকালের রোদ তেতে উঠতেই আমাদের আরেক চেহারা। সন্ধ্যা গড়াতে পানাহারে মত্ত আরেক বাঙ্গালি জাতি আমরা। এই জাতি কি করে পহেলা বৈশাখের পতাকা বহন করবে?

যে কারণে আজকের সমাজে মঙ্গল শোভাযাত্রা পড়েছে চরম বিপাকে। কে না জানে বাংলাদেশে সবসময় খারাপ মানুষ ছিল এবং থাকবে। দুনিয়ার কোনো দেশে তা নেই? উন্নত আধুনিক চরম উৎকর্ষে পৌঁছে যাওয়া সমাজেও খারাপ মানুষ আছে। যারা যৌনতা নিয়ে খেলে। নারীদের শরীর যাদের কাছে খেলার বিষয়। আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঢুকে পড়া বদ মানুষেরা কোন পেশার কোন শ্রেণির বা কাদের ইন্ধনে এরা এসব করে তা কম বেশি সবাই জানে। কিন্তু ঠেকানো যায় না। কারণ আমাদের ভেতরেই আছে তারা। এরা আমাদের ভেতর দিয়েই ঢুকে পড়ে। ধরা পড়লেও তাই বিচার হয় না। বিচার হলেও শাস্তি মেলেনা। যাদের ওপর আমাদের গভীর বিশ্বাস যারা মুক্তিযুদ্ধ ও চেতনার ধারক তাদের আমলেও এরা নিরাপদ। এই ফাঁদে পরা সমাজে মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন তোপের মুখে। ভাবখানা এমন যেন নারীরা এই শোভাযাত্রা ছাড়া আর সবজায়গায় চরম নিরাপদে আছেন। বাসে ট্রেনে ঘরে বাইরে অনিরাপদ নারীদের দিকে খেয়াল না রেখে কেবল শোভাযাত্রার ওপর এত আক্রোশের কারণ আসলে ভিন্ন।

যেভাবেই হোক এতে এখন মুখোশের ওপর নিষেধাজ্ঞা চলছে। মুখ ও মুখোশের সমাজে মুখোশ পরা মানুষ যে আসলে কারা সেটাই বোঝা দায়। ধরে নিলাম এটা সাময়িক। কিন্তু এভাবে চললে আর কী কী বিষয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে সেটা কী ভেবেছি আমরা? মূল ক্রোধ বা রাগের জায়গাটা কিন্তু পহেলা বৈশাখ। কারণ এটি বাংলাদেশ ও বাঙ্গালির শক্তির উৎস। সে শক্তি কিভাবে কাজ করে সেটি আমরা আগে দেখেছি। এর প্রাণ যে সংস্কৃতি সেটাই অন্ধ মানুষদের রাগের কারণ। তারা আমাদের সংস্কৃতিকে ভয় পায়। তারা জানে এই শক্তি একবার জাগলে তাকে ঠেকানো যায় না। এবং সেটাই এই জাতির মুক্তির উৎস।

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব কি শুধু একদিন হৈ চৈ করার জন্য? এক বেলা আনন্দ ফূর্তি করে বাড়ি চলে গেলেই এই উৎসব আমাদের পথ দেখাবে? না কি আমাদের উচিৎ এর দেখভাল করা? এক সময় এই জাতি পহেলা বৈশাখের শক্তি ও সাহসে ভর করে বাঙ্গালিকে মুক্ত করেছিল। পাকিস্তানের মত দানবের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সেই জাতি আজ কৃশ আজ দোদুল্যমান। আজ তার ভেতরে বাইরে দুশমন। তার চিন্তা চেতনা মাথায় ঢুকে আছে বিদেশি ভূত। পরজাতির কালচার। মূলত বাংলাদেশ ও বাঙ্গালিকে পেছনে টেনে রাখার চক্রান্ত মুক্ত পহেলা বৈশাখ না পেলে একদিন এর শক্তিহীন বলহীন উদযাপনে মগ্ন জাতিকে দেখে করুণা করার বিকল্প থাকবে না।

পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ আমাদের সেই শক্তির আধার যা চিরকালের। তাকে যেন হারিয়ে যেতে নাদেই আমরা। শুভ নববর্ষে সবার জীবন বাঙ্গালিয়ানায় ভরে উঠুক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ এপ্রিল ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়