ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বড়গল্প || প্রত্যাবর্তন

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০০, ২৩ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বড়গল্প || প্রত্যাবর্তন

অলঙ্করণ: অপূর্ব খন্দকার

বগা লেকের পশ্চিম পাড় দিয়ে পায়ে হাঁটা যে পথ নেমে গেছে তার দুধারেই নানা রকম বুনোফুল গাছ। হরেক রকম প্রজাপতির ভিড় সেসব ফুলে। সেই পথ ধরে রিয়া আর অনুপমা সকালের নরম রোদে হাঁটতে লাগলো। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতিদের পিছু পিছু ক্যামেরা নিয়ে ছুটতে ছুটতে একসময় এমন এক জায়গায় এসে তারা থামলো সেখানে চারটি পায়ে হাঁটা পথ ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলে গেছে। সব পথ দেখতে প্রায় একই রকম। যখন পথ হারিয়েছে বুঝলো তখন একরাশ আতঙ্ক ওদের মনে চেপে বসলো। অফিস থেকে ওরা বগা লেকে ঘুরতে এসেছে। সকালে যখন কটেজ থেকে বের হয় তখন সবাই ঘুমাচ্ছিল। এডমিনের মারুফ ভাই সাথে আসতে চেয়েছিল কিন্তু ওরা পাত্তা দেয়নি। সাথে মোবাইলও নেই যে দলের কাউকে ডেকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে বলবে। হঠাৎ অনুপমা খেয়াল করলো, দূরে একজন লোক বড় একটি শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। মনে দ্বিধা নিয়েই সেদিকে এগিয়ে গেল দুজন। তার আগে রিয়া অনুপমাকে বলে নিল, ওরা যে পথ হারিয়েছে পাহাড়ি লোকটাকে সে কথা না বলতে। অচেনা পাহাড়ি লোককে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। লোকটি যাতে ওদের কথা বুঝতে না পারে, সেজন্য ইংরেজিতে কথা বলছিল ওরা।

লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে অনুপমাই প্রথম জানতে চাইলো, আচ্ছা ভাইয়া, বগা লেকটা কোন দিকে বলতে পারেন?

লোকটি মুখ তুলে চাইলো। তারপর বললো, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? রিয়া কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো, সেটা জেনে আপনি কী করবেন? লেকের পাশের পাড়াটাতে যাওয়ার পথটা দেখিয়ে দিলেই পারেন। লোকটি হেসে বললো, ওই যে কদম গাছটা দেখছেন ওটা লক্ষ্য করে এগোতে থাকেন। কাছাকাছি গেলেই বগা লেক দেখতে পাবেন। রিয়া লোকটিকে কিছু না বলেই অনুপমার হাত ধরে কদম গাছ অভিমুখে চলতে লাগলো। অনুপমা একটু এগিয়েই আবার লোকটির কাছে ফিরে এল। সে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু রিয়া দূর থেকেই ইংরেজিতে বললো, পাহাড়ি লোকের সঙ্গে এত কথা বলার দরকার কী?

এবার লোকটি মাথা তুলে চোস্ত ইংরেজিতে বললো, ম্যাডাম বারবার পাহাড়ি বলছেন কেন? পাহাড়িরা কি মানুষ নয়?

কথাটা শুনে রিয়া কিছুটা বিস্মিত আর অনুপমা ভীষণ লজ্জা পেল। তার মানে এতক্ষণ ওরা যা বলেছে লোকটি সবই বুঝেছে। ফেরার পথে অনুপমা বারবার ভাবছিল কে এই যুবক? পাহাড়িদের মতো দেখতে না হলেও পোশাকে শতভাগ পাহাড়ি। রোদে পোড়া গায়ের তামাটে রং যে একসময় বেশ উজ্জ্বল ছিল বোঝা যায় স্পষ্ট।

*

সকাল থেকে নতুন তৈরি করা জুম ক্ষেতটাতে কাজ করছিল অহম। পাহাড়ি জীবনের অনেক কিছু শিখে নিলেও মাটি কোপানোর কাজটাতে এখনো ভালোভাবে অভ্যস্ত হতে পারেনি। কতটা পরিশ্রম যে লাগে এই কাজটাতে তা শহুরে সাহেবরা কখনো বুঝবে না। মাধব অহমের সাথে থাকে। ও নিচে গেছে মাসকাবারি বাজার করে আনতে। যাবার আগে বলেছিল, দাদা, কাল এসে আমি মাটি কোপাবো, তোমার এসব করে কাজ নেই। এমনিতে মাধবই জুম ক্ষেতের মাটি কোপানোর কাজটা করে। কিন্তু ‘তুমি পারবে না’ সুলভ কথাটা অহমের অহংবোধে লেগেছে। তাই সেই সূর্য ওঠার আগে এসে কাজে লেগে গেছে। অনেকক্ষণ কাজ করে ক্লান্ত হয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করতে গিয়ে পাহাড়ি আলুর গাছটা দেখলো। যদিও এই আলু অহম খায় না কিন্তু মাধবের মা খুব পছন্দ করেন। আজ রাতে মাধবের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে যাবে। শুঁটকিমাছ আর এই আলু নিয়ে গেলে মাসি খুব খুশি হবেন। শালপাতায় মোড়ানো শুঁটকি আর দড়ি দিয়ে বাঁধা আলু। র‌্যাপিংয়ের বালাই নেই। র‌্যাপিংয়ের কথা মনে পড়তেই মৃদু হাসলো অহম। র‌্যাপিংয়ের মেকি দুনিয়া সে কবে ছেড়ে এসেছে। এই পাহাড় কোনো অলগা চকচকে র‌্যাপিংয়ের ধার ধারে না। কী মানুষ, কী আকাশ, কী প্রকৃতি কারো কোনো আলগা রংচংয়ের প্রয়োজন পরে না। এসব ভাবতে ভাবতে সে আলু তোলায় মন দিল। কাজটা খুব সহজ নয়। শাবল দিয়ে আলুর চারদিকের মাটি আগে নরম করতে হয়। এরপর আস্তে আস্তে টেনে তুলতে হয়। কাজটা করতে করতেই দূরে দুটো মেয়েকে আসতে দেখলো অহম। শহুরে পর্যটক। এরা আসে দলবেঁধে পাহাড় দেখতে। পাহাড়িদের সাথে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেবে আর বন নোংরা করে চলে যাবে। তবুও অহম এদের আনাগোনায় খুশি। কারণ এসব পর্যটকের জন্যই কিছু পাহাড়ি পরিবার দুবেলা দু-মুঠো ভাত খেতে পাচ্ছে।

মেয়ে দুটোর মধ্যে একজন খুব মনোযোগ দিয়ে কীসের ছবি যেন তুলছে। এত মগ্ন হয়ে সে ছবি তুলছে যে আশপাশের কোনো কিছুই তার খেয়ালে নেই। বোধহয় প্রজাপতি হবে। কারণ প্রজাপতির ছবি তুলতে এমন একাগ্রতার প্রয়োজন হয়। অহম নিজের কাজে মন দিল। অনেক দিন পর সে আবার শহুরে কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল। মনে মনে লজ্জা পেল। অহেতুক কৌতূহল পাহাড়িদের মানায় না। একমনে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তেই পেছন থেকে একটি নারীকণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকালো অহম। ওই মেয়ে দুটিই। চোখেমুখে তাদের ভয় আর দুশ্চিন্তার ছাপ। মেয়ে দুটো নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলছে। শুনে অহম বুঝলো, বগা লেকে এসে ওরা সকালে ঘুরতে বেরিয়ে পথ হারিয়েছে। মনে মনে হাসলো অহম। সভ্যতার গ্যাঁড়াকলে ওরা আসল পথ তো হারিয়েছে অনেক আগেই। সভ্যতা ওদের সবাইকে অবিশ্বাস করতে শিখিয়েছে। সাহায্য চাইতে এসেও ইংরেজিতে কথা বলছে কারণ অহম যদি ওদের বিপদ জেনে কোনো ঝামেলা করে। মেয়ে দুটোকে পথ দেখিয়ে দিয়ে অহম বসে বসে অনেকক্ষণ তাদের কথাগুলো ভাবছিল। আজ অনেকদিন পর সে শহুরেদের মতো আচরণ করেছে। অহেতুক কৌতূহল দেখানো, হঠাৎ আত্মঅহমিকায় আঘাত লাগা- এসব সে ভুলেই গিয়েছিল। তবে আজ কেন এমন হলো? প্রজাপতিপ্রেমী মেয়েটির ফিরে এসে ধন্যবাদ দেয়ার মুহূর্তটাও সে কেন ভুলতে পারছে না।

*

অনুপমারা আজ কেওক্র্যাডং যাবে। সবার প্রস্তুতি দেখে মনে হচ্ছে হিমালয় জয় করতে যাচ্ছে। অনুপমাদের সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট কোম্পানি। সবার মধ্যে এক ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। সিনিয়র জুনিয়রের বালাই কম। ৪০ জনের একটি পরিবার যেন। কর্মীর সংখ্যা কম হলেও এরাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন সিকিউরিটি সলিউশন কোম্পানি। দেশ-বিদেশের বহু প্রতিষ্ঠান সফটসনিকের ‘ইগো ডিফেন্ডার’ ব্যবহার করে। এই ট্যুরে কোম্পানির সবাই এসেছে। দলনেতার দায়িত্ব পালন করছেন সিইও হাসনাত ভাই। তিনি কটেজগুলোর সামনে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে বাঁশিতে ফু দিলেন। ঠিক যেন বিশ্বকাপের রেফারি। বাঁশি শুনে সবাই হেসে উঠলেও এলোমেলো হাঁটা বন্ধ করে এক জায়গায় জড়ো হলেন। তিনি খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন, আজ সফটসনিক কেওক্র্যাডং জয় করবেন। আমরা গাইডকে ফলো করে সুশৃঙ্খলভাবে ট্র্যাকিং করবো। সবাইকে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে, সুতরাং সবাইকেই সাথে পানির বোতল রাখতে হবে।

যাত্রা শুরুর সময় হঠাৎ অনুপমার ফোন বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করে সে গম্ভীর হয়ে গেল। সে দ্রুত হাসনাত সাহেবকে পাশে ডেকে জানাল বিষয়টি। সফটসনিকের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্লায়েন্ট বাংলাদেশের একটি বড় বেসরকারি ব্যাংক। এই ব্যাংকের সার্ভারে কোনো একটি গ্রুপ বারবার হ্যাকিং করার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক স্তরের সুরক্ষা ব্যবস্থা তারা ভেঙে ফেলেছে। খুব তাড়াতাড়ি ত্রুটি সারাতে না পারলে অনেক বড় অঘটন ঘটে যেতে পারে।

ঘটনাটি শুনে পুরো দল চিন্তিত হয়ে পড়লো। অনুপমা দ্রুত কটেজে গিয়ে ল্যাপটপ অন করলো। কিন্তু এখানে ইন্টারনেটের অবস্থা এত দুর্বল যে কোনোভাবেই সার্ভারে কানেক্টেড হতে পারছিল না। তৎক্ষণাত সিদ্ধান্ত হলো এই প্রজেক্ট যে চারজনের দায়িত্বে ছিল তাদের দুজন সাখাওয়াত ও প্রিয়তোষ এখুনি বান্দরবান ফিরে গিয়ে কাজ শুরু করবে। অন্য দুজন অনুপমা ও রাহাত কটেজে বসে নেট কানেক্টেড হলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবে। বাকিরা কেওক্র্যাডং চলে যাবে।

*

অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও অনুপমা ও রাহাত কাঙ্ক্ষীত জোরালো নেট কানেকশন পেলো না। এসময় একটি ছেলে এসে বললো, দিদিমণি তোমরা অম ভাইয়ের বাড়ি যাও। ওখানে আমরা ইন্টারনেট শিখি, অনলাইনে গেম খেলি। পাহাড়ি বালকের মুখে ইন্টারনেট ব্যবহারের কথা শুনে অনুপমারা অবাক হলেও প্রকাশ করা বা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার মতো মানসিক অবস্থা ওদের ছিল না। ওরা ছেলেটির কাছে ‘অম’ ভাইয়ার ঘরের পথ জেনে নিয়ে দ্রুত সেদিকে এগোলো। প্রায় দশ মিনিট আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে একটি সুন্দর কাঁঠের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বেশ সুন্দর পরিপাটি একটি দোতলা কাঠের বাঙলো। বাড়ির সামনে অরহর ডালের গাছ দিয়ে মোটামুটি দেয়াল তোলা হয়েছে। এক চিলতে উঠোনের একপাশে মুরগি আর খরগোশের ঘর। উঠানে কিছু মুরগি আর তিন চারটি খরগোশ রোদ পোহাচ্ছিল। দোতলা ঘরটির চালে বড় একটি সোলার প্যানেল আর বেশ লম্বা একটি অ্যান্টেনা ছাড়া পুরো বড়িটিই পাহাড়িদের বাড়ির মতোই। তবে বেশ আধুনিক। পাহাড়ি ছেলেটি অম ভাইয়া বলে দুবার ডাক দেয়ার পর যে যুবক বেরিয়ে এলো তাকে দেখার জন্য তৈরি ছিল না অনুপমা। গতকালের সেই যুবকটি। তাকে দেখেই অনুপমা লজ্জা পেল ভীষণ। কারণ কাল তার নামটাও জিজ্ঞেস করেনি। নিজের নাম তো বলেইনি। আসলে ইংরেজিতে কথা বলা নিয়ে যে লজ্জায় পড়েছিলো, তারপর আর স্বাভাবিক সৌজন্যও দেখানো হয়নি। এবার অনুপমা হেসে এগিয়ে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলো। অহমও তার নাম বলে হেসে বললো পাহাড়িদের পরিচয় খুব সংক্ষিপ্ত হয়। অনুপমা খোঁচাটা হজম করে বললো এখনো ক্ষমা করতে পারেননি আমাদের।

আপনাকে সবাই ‘অম’ বলে কেন?

অহম হাসলো। আসলে ওদের উচ্চারণে অহম কবে ‘অম’ হয়ে গেছি জানি না। কী বলে ডাকলো সেটা নিয়ে কখনো ভাবি না। কারণ ওরা আমাকে ভালোবাসে আর আমি ওদের। অহম সবাইকে ডেকে নিয়ে দোতলার বারান্দায় বসালো। কাঠের মেঝেতে মাদুর পেতে বসার ব্যবস্থা। বসতে বসতে মাটির পাত্রে ঠান্ডা পানি আর বিস্কুট সাথে গরম গরম চা এলো।

অনেকটা পথ হেঁটেছেন একটু জিড়িয়ে নিন, তারপর আপনাদের কথা শুনবো বলে অহম উঠতে চাইলো। কিন্তু অনুপমা ব্যাকুল হয়ে তার সমস্যাটি বললো। সব শুনে অহম বললো, বাপরে! এসেই জটিল সমস্যা। এই বলে ঘর থেকে একটি কাগজে তার ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের পাসওয়ার্ড লিখে এনে দিলো। আর বারান্দায় বৈদ্যুতিক সংযোগটাও দেখিয়ে দিলো।

আপনারা কাজ করুন, আমি এবার একটু স্কুলে যাবো। দুপুরে মুরগির মাংস আর খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। আশা করি তাড়াতাড়ি ফিরে আপনাদের সাথে যোগ দিতে পারবো। আর চা খেতে চাইলে মাধবকে বললেই হবে। বাথরুম কিংবা অন্য যেকোনো কিছু প্রয়োজন হলে যেকোনো ঘরেই যেতে পারেন। আমার ছোট দুনিয়াটা সবার জন্যই খোলা। এই বলে অহম স্কুলের পথ ধরলো। অনুপমা মুগ্ধ হয়ে তার চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইলো। তার মনে অনেক প্রশ্ন কিন্তু নিজের প্রাতিষ্ঠানিক ঝামেলায় এখন অন্য কিছু নিয়ে না ভেবে কাজে মনোযোগ দিলো।

*

স্কুলের পথে যেতে যেতে অহমের মনে অনেক পুরোনো স্মৃতি ভিড় করলো। এমন অনেক কিছু যেগুলো সে ভুলে যেতে চায়, ভুলে থাকতে চায়। ঢাকা শহরের মোহ ছেড়ে আজ পাঁচ বছর এই সভ্যতা বিবর্জিত অঞ্চলে এসে বাস করছে অহম। অস্ট্রেলিয়া থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিল। ভালো চাকরি আর সাথে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্বের হাতছানি ছেড়ে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো সে। দেশে ফিরে নিজেই কিছু করার চেষ্টা। দেশকে কিছু দেয়ার ইচ্ছায় চালু করা ফার্মটি বিশ্বের উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করে আবার হঠাৎ সব ছেড়ে এই পাহাড়ে এসে বসবাসের সিদ্ধান্ত- সব কেমন যেন এলামেলো লাগে অহমের।

রায়ান বিন রেজওয়ান অহম। বাবা-মায়ের বড় আদরের বড় ছেলে অহম। ছোট বোনের অন্তঃপ্রাণ অহম। বন্ধুদের প্রিয় অহম। আজ খুব বেশি পুরোনো কথা মনে পড়ছে। এসব ভুলে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করতে করতে অহম স্কুলের খুব কাছে চলে এলো। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই জুনিয়র হাইস্কুলে ইংরেজি এবং বিজ্ঞান পড়ায় অহম। স্কুলের নতুন টিনের ঘরটিও অহম করে দিয়েছে। এই করুণ সবুজ পাহাড়ে ওরা এত কষ্ট করে বেঁচে থাকে যে লেখাপড়া কিংবা স্কুল ওদের কাছে বিলাসিতার পর্যায়েই পড়ে। তবুও ওরা পড়ে। সকল প্রতিকূলতা জয় করে কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিতও হয়। এরপর বেশির ভাগই সমতলের এলিট শ্রেণির সাথে মিশে গিয়ে ভুলে যায় পাহাড়ের হাতছানি। অথচ ওদের সবাই যদি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পাহাড় আকড়ে থাকতো তবে পাহাড়ের চেহারাটাই বদলে যেত। আজ ক্লাসে তেমন মন বসাতে পারলো না অহম। অষ্টম শ্রেণির একটা ক্লাস বাদ রেখেই বাড়ির পথ ধরলো। শহুরে সৌজন্য আর পাহাড়ি আতিথেয়তা দুটো মিলেই অহমের তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরাটা যুক্তিযুক্ত মনে হলো।

*

হ্যাকিং প্রতিরোধে অনুপমাদের করণীয় কিছু গাইডলাইন থাকে। প্রথম কাজ হলো- কোথা থেকে হ্যাক হচ্ছে খুঁজে বের করা। কম্পিউটারে তখনি কেউ অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করতে পারবে যখন সেটি কোনো নেটওয়ার্ক সিস্টেমে যুক্ত থাকবে আর আপনি ভুল করে হলেও অন্যকে প্রবেশের পথ খুলে দেবেন। এক্ষেত্রে ব্যাংকের তেমন একটি পিসিতে হ্যাকাররা লগ-অন করেছিল। এর ব্যবহারকারী হয়তো না বুঝে কোনো ভাইরাসের অনুপ্রবেশের পথ করে দিয়েছে। কীভাবে হ্যাকাররা এই হোলটা করেছিল সেটা ব্যাংকের পিসিগুলো পরীক্ষার পরই বোঝা যাবে। তবে আক্রান্ত পিসিটিকে চিহ্নিত করে সেটি নেটওয়ার্ক থেকে ইতিমধ্যে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন অন্য পিসিগুলো ভাইরাসমুক্ত করতে সকাল থেকে একমনে নিজের ল্যাপটপে কাজ করছিল অনুপমা। এর মধ্যে মাধব কয়েক দফা চা খাইয়ে গেছে। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে একটু হেঁটে আসার সিদ্ধান্ত নিলো অনুপমা। অহমের ঘরের পর্দা সরিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। পরিপাটি সাজানো ঘরের প্রায় চারদিকেই বইয়ের সেলফ। নানা রকম বইয়ের ভিড়ে সাহিত্যের পাশাপাশি প্রচুর অনলাইন সিকিউরিটি ও নেটওয়ার্কিং-বিষয়ক বই। একটি বড় মনিটরযুক্ত শক্তিশালী ডেস্কটপ কম্পিউটার রাখা আছে টেবিলের উপর। সবকিছু দেখছিল আর মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন জট বাঁধছিল- কে এই অহম?

উচ্চশিক্ষিত এতে সন্দেহ নেই। কী উদ্দেশ্যে সে এই বুনো পাহাড়ে পড়ে আছে? এত উচ্চশক্তির ইন্টারনেট কিংবা কম্পিউটার দিয়ে সে কী করে? শুধু পাহাড়ি শিশুদের প্রযুক্তি জ্ঞান দিতে নিশ্চয়ই এত আয়োজন নয়। এসব ভাবতে ভাবতে বাইরে অহমের কণ্ঠ শুনতে পেল। অহম স্কুল থেকে ফিরে এসেছে।

*

পাহাড়ে পানি সংগ্রহ খুব কঠিন কাজ। তাই যেসব কাজ নিচে গিয়ে সেরে ফেলা যায় সেসব কাজের জন্য অহম পানি উপরে তুলে আনায় না। যদিও মাধবের এতে ঘোর আপত্তি আছে। সে চায় অহম তোলা জলে নিজের বাথরুমেই গোসল করুক। মনে মনে হাসে অহম। বড় ভালোবাসে ছেলেটি তাকে। এই ভালোবাসাতেই অহমের ভয়। খুব বেশি ভালোবাসা তার সহ্য হয় না। তাই ভালোবাসা থেকে পালিয়ে এই পাহাড়ে সে।

প্রায় ছয় বছর আগে কারওয়ান বাজারে কিছু মানুষের জটলা দেখে এগিয়ে গিয়েছিল অহম। শীর্ণকায় এক আদিবাসী ছেলেকে একজন লোক ধরে মারছে, আর সবাই মিলে তামাশা দেখছে। অহম লোকটির হাত ধরে জিজ্ঞস করে, মারছেন কেন?

পান খাওয়া লালচে দাঁত খিঁচিয়ে লোকটি বলে, পারবো না তো বোঝা লইলো ক্যান? আমার এক খাচি ডিম ভাঙছে। এর দাম দিবো কেডা? মারমু না তো কী করমু?

ডিমের দাম কতো? অহমের প্রশ্ন। লোকটি প্রশ্ন শুনে পুনরায় খিঁচিয়ে ওঠে- কেন আপনি দিয়া দিবেন নাকি? যত্তোসব!

এমন কথা শুনে অহমের রাগ চড়ে যায়। পকেট থেকে এক তোড়া টাকা ছুড়ে দিয়েই ধাই করে লোকটির নাকে ঘুষি বসিয়ে দেয়। লোকটির নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত বের হতে থাকে। এরপর থানা পুলিশ বহু ঝামেলার পর মাধব অহমের ছায়াসঙ্গী। যেদিন সে ঢাকায় আর থাকবে না সিদ্ধান্ত নিল- প্রথমে অস্ট্রেলিয়া ফিরে যেতে চেয়েছিল। সেভাবে তার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এলেক্সকে মেইলও করেছিল পিএইচডিটা শুরু করার ইচ্ছা জানিয়ে। এলেক্সও খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে ফিরতি মেইলে তাকে দ্রুত কাগজপত্র পাঠাতে বলেছিল। কিন্তু মেইলের শেষে এলেক্স লিখেছিল, ‘আমি জানতাম তোমার মতো জিনিয়াসকে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটা দেশ ধরে রাখতে পারবে না।’

এই লাইনটা পড়ে অহমের অহংবোধে আঘাত লেগেছিল। অহমের জন্মদাত্রী মা তার নামটার সাথে সাথে এমন এক অহমিকা দিয়ে গেছে যে তাতে আঘাত লাগলে আর কিছুই ভাবতে পারে না। অস্ট্র্রেলিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত ওখানেই ইতি। এরপর বহুবার এলেক্স তাকে মেইল করেছে কিন্তু অহম তার সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি।

অহম যখন কোথায় যাবে, কী করবে এমন সাতপাঁচ ভাবছিল তখন মাধব বাড়ি যাবার ছুটি চাইতে তার সামনে আসে। অহম জিজ্ঞেস করলো তোর বাড়ি আমাকে নিয়ে যাবি? মাধব যেন আকাশ থেকে পড়লো- কী বলো দাদা, তুমি আমাদের বাড়ি যাবে। মা শুনলে খুব খুশি হবে।

বলেই পরক্ষণে মাধবের ফর্সা মুখটা কালো হয়ে গেলো। অনেক কষ্টে বললো, তুমি আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবে? আমরা তো খুব গরিব।

মাধবের কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়ে অহম বললো, ধুর এ সপ্তাহেই তোদের বাড়ি যাবো। এবার চল মাসির জন্য কিছু কেনাকাটা করে আনি। এই বলে অহম অনেক কিছু কিনলো। তার শহুরের জীবনকে সে রাতারাতি বদলে ফেলতে পারবে না সেটা সে ভালোই জানে। আর এই কেনাকাটার উদ্দেশ্য যে পাকাপাকি পাহাড়ে আবাস গাড়ার জন্য সেটা মাধব টের পেল গ্রামে আসার কয়েকদিন পর। যেদিন অহম কারবারির কাছ থেকে অনেকটা জমি লিজ নিলো চাষবাস আর ঘর বানানোর জন্য। সেদিন মাধব কিছু বলতে গিয়েও সাহস পেল না। কারণ অহম মাধবের কাছে দেবতুল্য। দেবতার কাছে প্রশ্ন তোলার মতো অপরাধ মাধবদের মতো অনুগত ভূমিপুত্ররা কখনো করতে পারে না। তারা শুধু পারে মুনিবকে অনুসরণ করতে। যদিও অহম আর মাধবের সম্পর্ককে কোনোভাবে মুনিব-চাকরের সম্পর্ক কেউ বলতে পারবে না। তবুও হাজার বছরের লালিত নিয়ম একা অহম ভাঙতে পারবে কী করে।

*

অহম গোসল সেরে ফিরলে খাওয়ার আয়োজন শুরু হলো। বাড়ির পেছনের ঝুল বারান্দায় মাদুর পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা। অনুপমার মনে হলো সবুজের সমুদ্রে কোনো এক জাহাজের মাস্তুলে দাঁড়িয়ে আছে সে। সবুজ গাছের মাথায় হাওয়াদের খেলা ঠিক সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই। দুপুরের হালকা গরম থাকলেও দখিণা বাতাস অনুভব করতে দিচ্ছে না। দূরের কড়ই গাছে একটি কাঠ ঠোকরা সমস্ত আক্রোশে ঠকাঠক ঠোঁটের কুঠার চালাচ্ছে। এই শব্দে কিংবা ঠোঁটের আঘাতে কাঠের ছাল সরে গেলে যেকোনো মথ বেরুবে অমনি তার মধ্যাহ্নভোজ হয়ে যাবে। হঠাৎ ঠকাঠক শব্দের বিরতি। মনে হয় তার কাঙ্ক্ষীত লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে পাখিটা। ক্রমাগত লেগে থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সময়ের ব্যাপার শুধু। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অনুপমা এসব দেখছিল আর ভাবনার জাল বুনছিল। আজ সকালেও সে যাকে তেমন চিনতো না তার সঙ্গে দুপুরের খাবার খাবে বলে অনুপমা এত পুলক কেন অনুভব করছে? এমন সময় কথা বলতে বলতে অহম আর রাহাত ঘর থেকে বারান্দায় এল। অহমই প্রথম কথা শুরু করলো, ম্যাডামের নাকি হ্যাকিংয়ের চিন্তায় ক্ষুধা-তৃষ্ণা গায়েব।

অনুপমা মৃদু হেসে বললো, আসলে এটা বন্ধ না করতে পারলে আমাদের প্রতিষ্ঠানের খুব বদনাম হয়ে যাবে।

অহম বললো, কিন্তু খাওয়া-দাওয়া না করলেই কি হ্যাকাররা তাদের কাজ বন্ধ করে দেবে? বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক সিস্টেমে যুক্ত যেকোনো কম্পিউটারই যেকোনো সময় হ্যাক হতে পারে। বেহুলার বাসরের মতোই কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই শতভাগ নিñিদ্র বানানো সম্ভব নয়। কোনো না কোনো ছিদ্র থেকেই যায়। আপনাদের ভাষায় যাকে ব্যাকডোর অথবা রুটকিট বলে। এই ছিদ্রগুলো দিয়েই বেহুলার সাপের মতো ভাইরাস অথবা হ্যাকিং টুলস দিয়ে মূল নেটওয়ার্কে ঢোকে হ্যাকাররা। এরপর ভাইরাসগুলো ভেতরে থেকেই হ্যাকারকে সব তথ্য পাচার করে আক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণ করার কর্তৃত্ব প্রদান করে। আপনাদের নজর রাখা উচিত সাপ কোথা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেছে। ছিদ্র পেলে সেটা বন্ধ করাটা যেমন জরুরি সেই সাথে কোনো সাপ ঢুকে পড়ে থাকলে সেটাকেও মেরে ফেলা প্রয়োজন।

মুগ্ধ হয়ে শুনছিল অনুপমা। এবার নিজের কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলো না সে। প্রশ্নটা করেই ফেললো, আপনি আসলে কে?

হো হো হো করে হেসে উঠলো অহম। হেয়ালি করে উত্তর দিলো, আমি পাহাড়ি। টুকটাক বই পড়ে শিখেছি এসব কথা। অনুপমা বললো, সে দিনের ঘটনার জন্য আমরা সত্যি লজ্জিত। আসলেই আমার সবকিছুই এখন রহস্যময় লাগছে।

সে দিনের ঘটনা, পাহাড়ি মানুষ এসবের মাথামুন্ডু কিছুই না বুঝে বোকার মতো দাঁড়িয়ে কথা গিলছিল রাহাত। এবার সে মুখ খুললো। বললো, আমার আসলে খুব ক্ষুধা পেয়েছে।

অহম বললো, তাই তো খাবার সামনে রেখে আমরা অহেতুক কথা বলছি কেন? আসুন ম্যাডাম আগে খেয়ে নিই। আমার মন বলছে আপনার সমস্যাটা খেতে খেতে সমাধান হয়ে যাবে। জুম চালের খিচুড়ি আর পাহাড়ের আলো-হাওয়া-খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যবান মুরগি আর মাধবের রান্না সব মিলিয়ে খুব চমৎকার একটা খাওয়া হলো অনুপমার। এত মজাদার খাবার সে অনেকদিন খায়নি। খাওয়া শেষে রাহাত সিগারেট টানতে বাইরে গেলে অহমকে শক্ত করে ধরলো অনুপমা- কে আপনি? কেন এই পাহাড়ে পড়ে আছেন? অনুপমার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে অহম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। উল্টো প্রশ্ন করে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইলো- খাওয়া কেমন হলো?

কিছুটা হতাশা নিয়ে অনুপমা বললো, মনের ভেতর এত প্রশ্ন নিয়ে কি আর ভালো করে খাওয়া হয়? তবুও মিথ্যে বলবো না, এমন ভালো খাবার অনেক দিন খাইনি। অহম হেসে বললো, কী এমন ভালো খাবার। মোটা চালের খিচুড়ি আর মুরগির মাংস। আর আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আপনাকে আমি দেব। তবে আজ নয়, অন্য কোনো দিন।

অনুপমা এবার অধৈর্য হয়ে গেলো। না আজই এবং এখুনি জানতে চাই আপনি কে?

আমি অহম। আর কিছু জানতে না চেয়ে আপনার সমস্যাটার আগে সমাধান করুন। আর কিছু মনে না করলে আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।

অহমের কথায় অনুপমা ভীষণ লজ্জা পেলো। অহমের দিকে এবার অনেক গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকালো অনুপমা। নিজেরে কাছেই নিজেকে খুব ছোট মানে হলো। বললো, ছিঃ ছিঃ এভাবে আপনার বাড়ি এসে বিব্রত করার জন্য দুঃখিত। বারান্দায় বসে আর কিছুক্ষণ চেষ্টা করেই আমরা চলে যাব। আশা করি, কাল সকালে আমার অন্য টিমমেটরা অফিসে গিয়ে বাকিটুকু সমাধান করে ফেলতে পারবে। এই বলে খুব কষ্টমাখা চেহারা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসলো সে।

*

কিছুক্ষণ বারান্দায় চুপচাপ বসে রইলো অনুপমা। কেন এমন হঠাৎ তাকে ঘর থেকে বের করে দিলো অহম। পাহাড়ের এই সবুজ সৌন্দর্য হঠাৎ অনুপমার বড্ড একঘেয়ে আর বাজে লাগছিল। মনে হচ্ছিল এক দৌড়ে মা’র কোলে গিয়ে মুখ লুকিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদবে সে। দূর থেকে রাহাতের ব্লুটুথ স্পিকারে গান শোনা যাচ্ছে। শ্রীকান্তের ‘যদি জানতে আমার মনের কথা’। অনুপমার প্রিয় গানটিও এখন শুনতে অসহ্য লাগছে। খুব কান্না পাচ্ছে। সে মাকে ফোন করলো।

তাহেরা বানু দুপুরের খাবার খেয়ে কেবল ঘুমাবেন- এমন সময় মেয়ের ফোন। হ্যালো বলতেই অনুপমা হু হু করে কেঁদে ফেলল। হঠাৎ মেয়ের এমন আচরণে ভড়কে গেলেন তাহেরা বানু। দুই ছেলের পর তার এই এক মেয়ে বড়ই আদরের। তার বড় ছেলে আমেরিকা আর ছোট ছেলে আর্মিতে আছে। শুধু এই মেয়ের কথা ভেবেই অনুপমার বাবা শেরপুরের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় এসে মোহাম্মদপুরে ফ্ল্যাট কিনেছেন। অফিস পিকনিকে পাহাড়ে গিয়ে মেয়ের কোনো অজানা বিপদ হলো কিনা সেই আশঙ্কায় তিনি অস্থির হয়ে গেলেন। কিছুটা কেঁদে অনুপমা স্বাভাবিক হলো। বললো, মা তেমন কিছু হয়নি হঠাৎ তোমাদের কথা খুব মনে পড়লো তাই। এখন রাখছি মা। পরে কথা হবে।

ফোনটা পাশে নামিয়ে রেখে পেছনে তাকিয়ে দেখলো অহম দাঁড়িয়ে আছে। সে কি তার কান্না দেখেছে? তাহলে খুবই লজ্জার ব্যাপার হলো। একথা ভাবতে ভাবতে সে তার ল্যাপটপ বন্ধ করতে গেলো।

অহম বললো, আপনার কাজ কি শেষ?

অনুপমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, না এখনো হয়নি। তবে হয়ে যাবে। আমার টিমের বাকি দুজন বান্দরবান পৌঁছে গেছে। ওরা কাজ শুরু করেছে। এখন আমরা যাই। আপনার অনেক সময় আর অন্ন নষ্ট করে গেলাম আমরা। ক্ষমা করে দেবেন আশা করি।

অহম বুঝলো তার কথায় অনুপমা কষ্ট পেয়েছে। মৃদু হেসে বললো, ক্ষমা করে দিতে পারি আমার সাথে এক কাপ চা খেলে।

অনুপমা আলতো করে মুখটা তুলে অহমকে দেখলো। অহমের মনে হলো এই দৃষ্টি তার চোখ ভেদ করে ভেতরটা দেখে ফেলছে। তাই সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।

অহম মাধবকে ডেকে চা দিতে বলে মোড়া টেনে অনুপমার পাশে বসে বললো, চা আসতে আসতে আপনি কি আবার একটু ট্রাই করে দেখবেন যে আপনাদের নেটওয়ার্কে অনাহুত আগন্তুককে তাড়ানো যায় কি না। অনুপমা বললো, আসলে আমাদের ইগো ডিফেন্ডার দিয়ে কয়েকবার পুরো সিস্টেম স্ক্যান করেছি। কিছু পাচ্ছি না। তবুও একটা কিছু যে আছে সেটা বুঝতে পারছি। অহম বললো, আমরা না চাইলেও হঠাৎ করেই যেমন মনের ভেতর ঢুকে পড়ে অনাহুত অগন্তুক তেমনি নেটওয়ার্কেও ঢুকে পড়ে অজানা নতুন কোনো ভাইরাস।

সত্যি বলতে মেয়েটির প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করছে অহম। আর এই আকর্ষণ তাকে বারবার লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিতে চাইছে। নিজের প্রতি নিজে প্রচণ্ড বিরক্ত হলেও কিছুই করতে পারছে না। এ যেন আলোর ঝলকে অন্ধ পোকার মতো ক্রমেই আগুনের দিকে ছুটে যাওয়া।

*

পরদিন খুব ভোরে অহম বগালেকের কদম গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পর সূর্য উঠবে। আঁধার সরে গিয়ে আলোয় হাসবে ফুল, পাখি আর প্রজাপতি। সূর্য ওঠার জন্য কখনো এভাবে অপেক্ষা করেনি অহম। সেটা টের পেয়েই বোধহয় সূর্য দেরি করে উঠছে। কথাটা মনে হতেই আপন মনে হাসলো অহম। দূর, কী সব আবোল তাবোল ভাবছে। সূর্য দেরি করে উঠতে যাবে কেন? সে একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। আসলে গতকাল সারা রাত ঘুমাতে পারেনি অহম। তার একত্রিশ বছরের এই জীবনে কখনো এভাবে কোনো মেয়েকে ভালো লাগেনি। গতকাল যখন অনুপমার ভাইরাসজনিত সমস্যাটা সমাধান হয়ে গিয়েছিল তখন আনন্দে সে চিৎকার করে উঠেছিল। অহম সেই চিৎকার শুনে হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় ছুটে গিয়ে দেখলো অনুপমা ঘুরে ঘুরে প্রায় নাচার ভঙ্গি করছে। অহম দরজায় কপাট ধরে মুগ্ধ হয়ে শেষ বিকেলের লাল আলোয় একটি সাদা পরীর নাচ দেখছিল। অনুপমা যখন অহমকে খেয়াল করলো তখন বেশ লজ্জা পেল। হেসে বললো, আমাদের চিফ মি. ইগো আসলেই জিনিয়াস। উনি সমস্যাটার সমাধান কেরে ফেলেছেন। মনে মনে মুহূর্তের জন্য হলেও মি. ইগোকে খুব হিংসা হলো অহমের। দূর থেকে রাহাতকে উপরে আসতে দেখে অনুপমা বললো, এখন তাহলে আমরা যাই। অহম বললো, আবার কি কখনো দেখা হবে?

তীর্যক দৃষ্টি হেনে অনুপমা বললো কেন হবে না? এই নিন আমার কার্ড। ঢাকা গেলে অবশ্যই দেখা করে আসবেন। আর এখানে আমার ফোন নম্বর দেয়া আছে। পাহাড়ি মানুষটি যদি আমাকে ফোন করে তাহলে ভালো লাগবে আমার।

অহম বললো, কিন্তু এই পাহাড়ি মানুষটির যে কোনো ফোন নেই। অনুপমা শুধু মৃদু হেসে বললো, কাল সকালে আমরা চলে যাবো। তার আগে ভোরবেলা আপনি কি সেই কদম গাছটির নিচে আসবেন?

অহমের ইতস্ততা দেখে অনুপমা বললো, কথা দিচ্ছি কোনো প্রশ্ন করবো না। আপনি ইচ্ছে হলে কোনো একদিন আপনার গল্প আমাকে বলবেন। সেই আশায় থাকলাম। আর সবকিছুর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। কাল দেখা হবে কি না জানি না। কারণ আপনার রহস্যের কাছে আমি এত ক্ষুদ্র যে আপনাকে বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। এটুকু বলতে বলতেই রাহাত চলে এলো। অহমের সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো, অনেক অনেক ধন্যবাদ ব্রাদার। যদি কখনো ঢাকায় বেড়াতে যান অবশ্যই আমাদের অফিসে আসবেন।

এরপর মাধবকে ওদের পৌঁছে দিতে বলে পেছনের বারান্দায় গিয়ে বসেছিল অহম। সারা রাত আর ঘুমাতে পারেনি। বারান্দায় বসে ভাবতে ভাবতে ভোরের আলো ফোটার আগে এই কদম তলায় এসে দাঁড়িয়েছে।

চারদিকটা কিছুটা আলোকিত হলে দূরে একটি নারীমূর্তি আসতে দেখলো অহম। তার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে ওটা অনুপমা। হাজার লোকের ভিড়ে দেখলোও অনুপমাকে চিনতে তার ভুল হবে না আর। অনুপমা এসেই খুব সুন্দর করে হাসলো। তার হাসির সাথে একরাশ রোদ এসে কদম গাছটার মাথায় মুকুট হয়ে বসলো। অনুপমাই প্রথম কথা বললো, এলেন তাহলে।

অহম হেসে বললো, পাহাড়িরা কথা দিলে সেটা রাখে। কথা দিয়েছিলেন না কি? অনুপমার প্রশ্ন।

অহম বললো, দিইনি না কি? বলতেই দুজনে একত্রে হেসে উঠলো।

অনুপমা বললো, কিছুক্ষণ পরেই চলে যাবো আপনাদের এই সুন্দর পাহাড়-লেক ছেড়ে। মনটা খারাপ লাগছে। কিন্তু কী করা ফিরে তো যেতেই হবে। তবে অনেকগুলো সুন্দর মুহূর্ত সাথে নিয়ে যাচ্ছি। কথা দিয়েছিলাম কোনো প্রশ্ন করবো না। তবুও একটা প্রশ্ন করি?

অহম মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। আজকের পর আবার কি আপনার সাথে দেখা হবে আমার? গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে অহম মৃদু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। অনুপমার মুখটা নিমিষে সূর্যের চেয়েও বেশি আলোকিত হয়ে উঠলো বলে মনে হলো অহমের কাছে।

অনুপমা হসিমুখে বললো, এখন তাহলে যাই। গোছগাছ করে বেরুতে হবে। সবাই খুঁজবে।

অহম শুধু একটু হাসলো আর কিছু বললো না। অনুপমার চলে যাওয়া পথে চেয়ে রাইলো। যতক্ষণ দেখা গেল বারবার মেয়েটি পেছন ফিরে দেখছিলো। ফিরে দেখা সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যে রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীর স্বামী অপুর মতো অহমের মন বারবার করে বলতে লাগলো, ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।’

*

অনুপমারা চলে যাওয়ার পরদিন মাধব এসে বায়না ধরলো বান্দরবান ছোট মাসির বাড়ি যাবে। মানা করার কোনো কারণ ছিল না তবে মাধবের চেহারায় কেন যেন একটা লুকোচুরি ভাব দেখে অহম বললো, কেন যাবি? এমন প্রশ্নের জন্য মাধব প্রস্তুত ছিল না। আমতা আমতা করে বললো, মাসিকে দেখতে যেতে বলেছে মা।

অহম বললো, ঠিক আছে যা। শোবার ঘরে বিছানার নিচে টাকা আছে ওখান থেকে যা লাগে নিয়ে নিস। কিপ্টামি করে আবার সারা পথ হেঁটে যাস না। জিপে যাস। বলে অহম তার কাজে মন দিল।

মাধব হাপ ছেড়ে বাঁচলো। তবে মিথ্যে বলার জন্য মনে মনে অপরাধ বোধ হলো খুব। আসলে বান্দরবান যেতে হচ্ছে তাকে অনুপমার জন্য। সে যাওয়ার আগে মাধবকে বলে গিয়েছে, বান্দরবানের একটা ঠিকানায় অনুপমা একটা জিনিস পাঠাবে। মাধবের কাজ হলো, জিনিসটি এনে অহমের কাছে পৌঁছে দেওয়া। অবশ্য তার আগে আকেরটি শর্ত সে জুড়ে দিয়েছিল। কথাটি আগে থেকে যেন অহম জানতে না পারে। যে কারণে মাধবের এই মিথ্যা বলা।

সেদিন বান্দরবান গিয়ে রাতটা ছোট মাসির বাড়িতে থাকলো মাধব। পরদিন সকালে নির্দিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে সেখান থেকে অনুপমার পাঠানো প্যাকেটটা নিয়ে বিকেলে ফিরে এলো মধাব। অহমের কটেজে সে যখন পৌঁছল তখন অহম নেই। মাধব প্যাকেটটা রেখে বাড়ির পেছনের সবজি ক্ষেতে পানি দিতে গেল।

অনেকদিন পর তার প্রিয় ১০৫এমএম ম্যাক্রো ল্যান্সের সাথে নিকন ডি-৮০০ ক্যামেরাটা নিয়ে একটু বনের ভেতরে গিয়েছিল অহম। প্রজাপতি ও কীট-পতঙ্গের ছবি তোলাটা তার নেশা। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিনে তার তোলা ছবি ছাপা হয় নিয়মিতই। একবার তো একটা অ্যাওয়ার্ডও জিতেছিল। কানাডার মনট্রিলে যাওয়ার আমন্ত্রণ ছিলো সেটি গ্রহণ করার জন্য। সে যায়নি। অহমের পক্ষে ওর এক ক্যানাডিয়ান বন্ধু সেটা গ্রহণ করেছে। আসলে এসব অহমকে টানে না খুব একটা। সে কাজ করে নিজের ভালো লাগার জন্য। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে সে ছবি পাঠায় চট্টগ্রামের গহীনের এই বনগুলোতে কত অজানা সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে সেটা বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য। তার লেখা ফিচার পড়ে অনেক বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে ঘুরতে আসে এটাই তার ভালো লাগে। আজ একটি ওয়ান স্পট গ্র্যাস ইয়োলো প্রজাপতির ছবি তুলেছে। ঘরে এসেই ছবিগুলো কম্পিউটারে ট্রান্সফার করার পর বিছানার উপরে রাখা বেগুনি প্যাকেটটা তার চোখে পড়লো। উপরে মেয়েলি হাতে সুন্দর করে নিজের নাম লেখা দেখে কৌতূহলী হয়ে প্যাকেটটি খুললো। খুলতেই টুপ করে একটি ভাঁজ করা কাগজ মাটিতে পড়লো। তুলে দেখলো তাকে লেখা একটি চিঠি। নিচে কোনো স্বাক্ষর নেই।

রহস্যময় অহম,

আমি কখনো মাকে ছাড়া কাউকে চিঠি লিখিনি তাই কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। ভনিতা না করে আসল কথায় চলে আসি। আপনাকে সেই পাহাড়ে কাজ করা অবস্থায় দেখেই অন্যরকম ভালো লেগেছিল। এটাকে লাভ এট ফার্স্ট সাইট বলে কি না জানি না। অবশ্য প্রথম দর্শনে ভালোবাসায় আমি বিশ্বাসও করি না। প্রথম দেখায় ভালো লাগাটা হয়তো একটি গাছের বীজ বপনের ন্যায়। এরপর অনুকূল পরিবেশ পেলেই হয়তো সেই গাছে একদিন ফুল ফোটে। সেই ফুলটাই হলো ভালোবাসা।

ছোটবেলা থেকেই অজানাকে জানার আমার প্রবল আকর্ষণ। তাই আপনাকে জানতে চাই, বুঝতে চাই। তবে কথা দিচ্ছি অনাহুত কোনো প্রশ্ন করে আপনাকে বিব্রত করবো না। আমি আপনাকে আবিষ্কার করতে চাই। এই ফোনটা আপনাকে জানার লোভে নিজের প্রয়োজনেই পাঠালাম। ফোনটি চালু হলে ভাববো আমি স্বপ্নের সিঁড়ি পেলাম আর না হলে ভাববো সুন্দর স্বপ্নটা দেখার শুরুতেই ভেঙে গেল।

ভালো থাকবেন সবসময়।

কিছুক্ষণ কাগজটা নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো অহম। তার মাধবের উপর খুব রাগ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু কেন যেন রাগ করতে পারছিলো না। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে আবার কিছুক্ষণ দেখলো। এরপর বিছানায় ছুড়ে ফেলে বাইরে বেরিয়ে এলো। মাধব, মাধব বলেও ডেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বাড়ির পেছন দিকে গিয়ে দেখলো একটি ঝোঁপের আড়ালে মাধব বসে আছে। বোঝা যাচ্ছে সে প্রচ- ভয় পেয়েছে। মাধবের ভয় দেখে যেটুকু রাগ ছিল সেটাও মাটি হয়ে গেল অহমের। এমন একটি ভয়ার্ত মুখ দেখেই মাধবকে বাঁচিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল অহম। সেই দিনের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় কিছুটা অপরাধ বোধ হলো। সে বললো, অনুপমাকে তোর পছন্দ হয়েছে খুব? শুনেই মাধবের মুখটা হাস্যোজ্বল হয়ে উঠলো। বললো, জ্বি দাদা। দিদিমণি অনেক ভালো। তোমার  সাথে খুব মানাবে।

অহম কপট রেগে বললো মারবো এক থাপ্পড়। আমার সাথে মিথ্যে বলে বান্দরবান গিয়েছিস আবার পাকাপাকা কথা বলছিস। যা ওই বেলিফুলের ঝাড়ে পানি দে।

*

রাতের খবার খেয়ে অহম চালু করবে না, করবে না করেও ফোনটার অন বাটনে চাপ দিয়েই দিলো। ফোনটা অন করতে না করতেই একটি এসএমএস এলো। বাংলায় লেখা ‘গল্পটার দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হোক এখান থেকেই’। খুদে বার্তাটি অনেকক্ষণ ধরে দেখলো অহম। লেখার অক্ষরগুলো এত সুন্দর কী করে হয়! মনে হচ্ছে এই হরফগুলো এই প্রথম দেখছে সে। ভাবতে ভাতেই ফোনের রিংটোন বেজে ওঠলো। অহম জানতোই যে ফোন কলটা কার। তাই রিসিভ করেই বললো, কেমন আছেন অনুপমা?

অনুপমা হাসলো। আপনি বুঝলেন কী করে? বলেই বুঝলো বোকার মতো প্রশ্ন হয়ে গেছে। তাই উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার প্রশ্ন, কেমন আছেন?

অহম বললো, ভালো নেই। আপনি আমার ছোট ভাইটিকে মিথ্যে বলা শেখাচ্ছেন কেন?

যে মিথ্যে কারো ক্ষতি করে না বরং উপকার হয় এমন মিথ্যেতে কোনো দোষ নেই। বলেই হাসলো অনুপমা। তারপর কথা চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। মোবাইল অপারেটর ৫৩ মিনিটে কল ড্রপ না করলে হয়তো অনন্তকাল চলতো এই কথোপকথন। এরপর প্রতিদিন নিয়ম করে কথা চলতে থাকে। তবে অহমের রহস্যময়তা নিয়ে কোনো প্রশ্নই করে না অনুপমা। মাঝে মাঝে অহম নিজেই কিছু কিছু বলে। অহমের বাবা-মায়ের কথা, ছোট বোনের কথা, হাসেম দাদুর কথা, বাড়ির কথা অনেক কিছুই বলেছে অহম। কথা বলতে বলতে ওরা কবে পরস্পরকে তুমি করে বলতে শুরু করেছে নিজেরাই জানে না। এমন একদিন অনুপমা বললো, অহম তুমি তোমার মাকে এত ভালোবাসো তাহলে মার সাথে যোগাযোগ কর না কেন?

অহম চুপ করে রাইলো। অহমের নীরবতায় অনুপমা বুঝলো অহমকে প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি। অনুপমা দুঃখিত বলতে যাবে এমন সময় অহম বললো, আমার আসল মা মারা গেছেন আমি যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। মা মারা যাওয়ার এক বছর পর আমার কথা ভেবে আর পারিবারিক চাপে বাবা আমার ছোট খালাকে বিয়ে করেন। এরপর আমার ছোট বোন তমার জন্ম হয়। মিথ্যে বলবো না আমার ছোটখালা ‘মা’ হয়ে আসার আগে বা পরে কোনো দিনই মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। বরং আমার ছোট বোনের চেয়ে আমিই মায়ের কাছে বেশি ভালোবাসা পেয়েছি। এটুকু বলে অহম থামলো। ওপাশ থেকে একটি দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনে অনুপমা বললো, অহম তোমার কষ্ট হলে বলার দরকার নেই। আমি তোমাকে যতটুকু চিনেছি সেটুকুই যথেষ্ট আমার জন্য। যে স্মৃতি তোমাকে কষ্ট দেয় সেই কথা আমার শোনার দরকার নেই।

অহম বললো, আমি আজ আমার গল্প তোমাকে বলবো। এই বলে অহম তার রহস্যের বেড়াজালের একটি অংশ অনুপমার কাছে তুলে ধরতে শুরু করলো।

আমি যখন এইচএসসি পাশ করি তখন আমার বাবা মারা যান। আমাদের ঢাকায় একটি মার্কেট ও দুটি বাড়ি আছে। তাই অর্থের অভাব ছিল না। বাবার ইচ্ছেপূরণ করতে আমি অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশোনা করতে যাই। অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে দেশে ফিরে আসি। দেশে এসে চাকরি না খুঁজে নিজেই কিছু করতে চাইলাম। মা-ই আমাকে উৎসাহ দিল বেশি। মাত্র এক বছরের চেষ্টায় আমার কোম্পানিটি মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেল। এরপর মা আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। আমার ছোট মামার বড় মেয়ে রাইমার আনাগোনা বেড়ে গেল আমাদের বাড়িতে। মা যা চাচ্ছেন সেটা বুঝে একদিন মাকে বললাম, মা আমি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছি না। সিঙ্গাপুরে একটা অফিস খুলতে চাচ্ছি। বিশ্ববাজারে কাজ করবো মা। এখন বিয়ে না, সময় হলে আমিই তোমাকে বলবো। আর রাইমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। ছোটবেলা থেকে ওকে ছোট বোন ছাড়া আর কিছু ভাবিনি।

মা খুব রেগে গেলেন। বললেন, আমি তোমার ছোট মামাকে কথা দিয়ে রেখেছি অহম। অন্য কিছু এখন আর সম্ভব নয়। বলেই মা চলে গেলেন। এর কিছুদিন পর ছোট মামাসহ নানুর বাড়ির অনেকেই এলেন। মোটামুটি আংটি পরানোর প্রস্তুতি। অথচ মা আমাকে কিছুই জানাননি। আমি পরদিন সিঙ্গাপুর যাবো। নিজের ঘরে ব্যাগ গোছাচ্ছি। ছোট বোন তমা এসে বললো, ভাইয়া রাইমার সাথে কাল না কি তোমার পানচিনি? আজ সব ফাইনাল হচ্ছে। রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো আমার। মা কেন এমন করছে? কী করবো বুঝতে পারলাম না। বাবা বেঁচে থাকলে তার পরামর্শ নিতে পারতাম। আমি আস্তে আস্তে নিচে বসার ঘরে গেলাম। সরাসরি মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, মা আমি এখন বিয়ে করবো না। আমার কথাটি যেন ঘরের ভেতর বোমার মতো ফাটলো। নিজেদের মধ্যে কথা বলা বন্ধ করে সবাই হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল। ছোট মামা পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্য হাসতে হাসতে বললেন, এখনই তোমাদের কে বিয়ে দিচ্ছে। পানচিনিটা কাল হোক তারপর সুবিধাজনক সময়ে বিয়ে হবে।

আমি বললাম, ছোট মামা আমি রাইমাকে বিয়ে করতে পারবো না। ওকে আমি নিজের ছোট বোন তমা থেকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখি না। তা ছাড়া কাল আমি সিঙ্গাপুর যাবো। কবে ফিরবো ঠিক নেই। ছোট মামা এবার রেগে গেলেন। নিজের বোনকে বললেন, কীরে শায়লা অহম কী বলছে এসব। তুই তাহলে আমাদের ডেকে আনলি কেন?

মা যে রেগে গেছেন তা তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছিলাম আমি। মা রেগে গেলে তার কান লাল হয়ে যায়। রাগান্বিত কণ্ঠে মা বললেন, কাল পানচিনিটা শেষ করে যেখানে খুশি যাও।

আমি অসহায়ভাবে সবার দিকে তাকালাম। এই আশায় যে কেউ হয়তো আমাকে বুঝে আমার পক্ষে কথা বলবে। কারণ ওখানে সবাই ছিলেন আমার অতি আপন। ছোটবেলা থেকে এদের সবার ভালোবাসাই পেয়ে এসেছি। কিন্তু কঠিন সময়ে সবার মুখোশ খুলে যায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। ছোট মামি বললেন, নিজের মা হলে কি মুখের উপর এভাবে না বলতে পারতে? এবার অহম রেগে গেল। কী বলছেন ছোট মামি? নিজের মা পরের মা কী? মা তো মা-ই।

মা বললেন, ঠিকই তো বলছে। তুমি আমার নিজের পেটের ছেলে হলে কী এভাবে আমার কথা অমান্য করতে পারতে?

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। যে কথা সে কবেই ভুলে গিয়েছিলাম আজ মার মুখ থেকেই সেই কথা শুনতে হলো। হাসেম দাদু বললেন, বউমা কী শুরু করলে তোমরা? তোমরা চুপ করো। আমি খোকাকে বুঝিয়ে বলছি।

ছোট মামি বললেন, শায়লা তোর বাড়ির চাকর বাকরকে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছিস। এমন মাথায় তুলে রাখিস বলে কেউ তোর কথা শোনে না। আমি তোকে আগেই বলেছিলাম, পরের ছেলেকে এত আদর দিস না। হলো তো এখন।

আমাকে বলা কথাগুলো সহ্য করলেও দাদুকে অপমান করাটা সহ্য করতে পারলাম না। কারণ আমার দাদাভাইয়ের সময় থেকে হাসেম দাদু আমাদের বাড়িতে আছে। তিন কূলে কেউ নেই। আমাদেরকেই নিজের পরিবার মানেন। আমার বাবাকেও কোনো দিন দাদুর সাথে অসম্মান করে কথা বলতে দেখিনি। আমি রেগে গিয়ে বললাম, বাড়িতে এসে আমাদের এমন অপমান করার অধিকার আপনার নাই মামি। আপনি হাসেম দাদুর কাছে ক্ষমা চান। নতুবা আমাদের বাড়ি থেকে চলে যান। ছোট মামি একথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। মামাকে বললেন, শুনেছো কী বলল? এরপরেও এখানে বসে থাকবে তোমরা?

মা এবার মুখ খুললেন। তবে না খুলেই হয়তো ভালো হতো। তিনি শীতল কণ্ঠে বললেন, যেতে হলে তুমি বেরিয়ে যাও। ভুলে যেও না বাড়িটা তোমার বাবা আমার নামে লিখে দিয়ে গেছেন।

আমি আর কথা বাড়াইনি। ব্যাগ গোছানোই ছিল। ছোট বোন আর হাসেম দাদুর কান্না উপেক্ষা করে মাধবকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম। সেখান থেকে অফিসে গেলাম। রাতটা অফিসেই কাটালাম। পরদিন সকালে প্রথমে সিঙ্গাপুর অফিস করার বিষয়টা বাতিল করে দিলাম। লিগ্যাল অ্যাডভাইজারকে ডেকে কোম্পানির মালিকানা হস্তান্তরের একটা দলিল বানাতে বললাম। আমার মায়ের নামে ৫০ শতাংশ, ছোটবোনের নামে ৪০ শতাংশ আর আমাদের সিইওর নামে ১০ শতাংশ মালিকানা দিয়ে একদিনের মধ্যে সব কাগজপত্র তৈরি করতে বললাম। আর হাসেম দাদুর নামে ৫০ লাখ টাকার একটা ফিক্সড ডিপোজিট একাউন্ট খুলতে বললাম যার লভ্যাংশ প্রতি মাসে তার একাউন্টে চলে যাবে। ‘ল’ অ্যাডভাইজার যেন আকাশ থেকে পড়লেন। সে বের হওয়ার কয়েক মিনিট পর আমার সিইও হন্তদন্ত হয়ে আমার ঘরে ঢুকলো। আমার হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুলে বললো, কী শুনছি এসব? তুই কি পাগল হয়ে গেলি না কি? বললাম, পাগল হইনি বন্ধু, বলে আমি ওকে আমার চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। আজ থেকে এই অফিস তুই সামলাবি। আমার বন্ধুটি কেঁদে ফেললো। বললো, আমার কিচ্ছু লাগবে না। আমাকে শুধু কী হয়েছে বল। আমি কোনো ভুল করেছি? আমাকে এমন শাস্তি কেন দিচ্ছিস? বেকার ছিলাম ডেকে এনে এমন একটা চাকরি দিয়েছিস সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। আর কিছু লাগবে না আমার।

আমি বললাম, দূর বোকা তুই ভুল করবি কেন। তোর ভালোর জন্য এসব করছি। আমি আবার বিদেশ চলে যাচ্ছি। তুই না থাকলে এত কষ্ট করে গড়ে তোলা কোম্পানিটা নষ্ট হয়ে যাবে। আর তোর প্রাপ্য অধিকারই তোকে দিয়ে যাচ্ছি। এই কোম্পানি এত দূর আনার পেছনে তোর অবদান তো কম নয়। মাকে আর তমাকে দেখিস। আর আমার সাথে ই-মেইলে তোর যোগাযোগ থাকবে। চিন্তা করিস না।

বন্ধু বললো, সব যে আমাদের দিয়ে যাচ্ছিস তুই চলবি কী দিয়ে? আমি হেসে আমার মাথা দেখিয়ে বললাম, এটা তো সাথেই নিয়ে যাচ্ছি। আর আমার ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টিগুলোর রয়্যালিটি ঠিক ঠিক আমার একাউন্টে দিয়ে দিবি কিন্তু। আরেকটি কথা- আমি যাওয়ার আগে এসব কথা, আর আমি এখন কোথায় আছি আমার বাড়িতে বলবি না। মা কিংবা তমা ফোন করলে বলবি আমি কোথায় তা তুই জানিস না। যদি বলিস তবে শুধু তোর সাথে যোগাযোগ রাখবো বলেছিলাম সেটাও কিন্তু বাতিল করে দেবো। বলেই হাসলাম।

অনুপমা এতক্ষণ চুপচাপ কথাগুলো শুনছিল। কোম্পানিটির নাম কী এটা জানার খুব ইচ্ছে হলেও জিজ্ঞেস করলো না। শুধু বললো তুমি এমন কেন? অহম হাসলো। খুব খারাপ, না? মায়ের কথা শুনিনি।

অনুপমা মৃদু হেসে বললো, ইশ সবাই যদি তোমার মতো খারাপ হতো। অবশ্য আমাদের চেয়ারম্যান ম্যাডামের একমাত্র ছেলেও এভাবে রাগ করে আলাদা থাকে। সেদিন ছেলের জন্মদিনে অফিসে এসে অনেক কেঁদেছেন উনি। অহম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো, কেন কী হয়েছে তার ছেলের?

অনুপমা বললো, আমি ঠিক জানি না। পুরোনোদের মধ্য কেউ কেউ হয়তো জানে। কিন্তু অফিসে এসব নিয়ে আলোচনা নিষেধ। অনুপমার সাথে কথা শেষ করে বারান্দায় গিয়ে বসলো অহম। সফটসনিকের চেয়ারম্যান তার ছেলের জন্য কেঁদেছেন শোনার পর থেকেই অহমের মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। অনেকদিন পর অহম আজ কাঁদলো। অনেকক্ষণ আকাশ থমথমে থাকার পর যেভাবে ঝুম বৃষ্টি নামে ঠিক সেভাবে। এক সময় ধীরে ধীরে ধাতস্থ হলো অহম। ফোনটা হাতে তুলে নিল। অনেকদিন পর আজ সে ফোন করবে বন্ধু আফজালকে। তার মার কথা মনে পড়ছে খুব।

*

পরের দুদিন অহমের ফোন বন্ধই রইলো। তৃতীয় দিন ফোন চালু করতেই অনুপমার নম্বর থেকে ফোন এল। রিসিভ করতেই রাজ্যের অভিযোগ আর অভিমান। কেন তুমি ফোন বন্ধ রেখেছো- বলেই কেঁদে ফেললো অনুপমা। এরপর যা বললো তা শোনার জন্য অনেকদিন থেকেই অহম উদগ্রীব ছিল। তবু সেটা শোনার পর অহমের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। অনুপমা বললো, আমি তোমাকে ভালোবাসি অহম। অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি। তুমি কি সেটা বোঝ না? অহম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, কী বললে তুমি? আবার বলো তো! অনুপমা এবার আরো বেশি আবেগমাখা কণ্ঠে বললো, ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।

অহম অনুপমা দুজনের কেউ এর আগে ভালোবাসার কথা বলেনি। দুজন মানুষ একে অপরের অস্তিত্বে নিজেদের বিলীন করে দিলেও এতদিন মুখ ফুটে কথাটা বলেনি। আসলে ভালোবাসি কথাটা বলতে হয় না। এটা কখন হয়ে যায় তা কেউ বলতে পারে না। অনুপমার মুখ থেকে কাক্সক্ষীত কাথাটা শুনে অহমেরও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, আমিও ভালোবাসি। মেয়ে, আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু সে কিছুই বললো না। অহমের নীরবতায় একরাশ অভিমান নিয়ে ফোনটা রেখে দিল অনুপমা।

*

দুদিন পর অনুপমা অফিসে গিয়ে দেখলো তাদের চেয়ারম্যান এসেছেন। সাধারণত বছরে এক দুবার তিনি অফিসে আসেন। কিছুক্ষণ পর ম্যাডাম তাকে ডাকলেন। এর আগে তার সাথে কখনো কথা হয়নি অনুপমার। ফর্সা সুন্দর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীকে দূর থেকে দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে হয়। অনুপমা ঘরে ঢুকে দেখলো তাদের এমডি স্যারও সেখানে বসে আছেন। একটু ঘাবড়ে গেল অনুপমা। সে কি কোনো ভুল করেছে?

অনুপমাকে বসতে বলে চেয়ারম্যান ম্যাডাম নিজের আসন ছেড়ে উঠে এসে অনুপমার পাশে বসলেন। স্নেহের সাথে অনুপমার হাত ধরে বললেন, বাহ্ তুমি তো অনেক সুন্দর! বাড়িতে তোমার কে কে আছেন? ইতস্তত করে অনুপমা বললো, ঢাকায় বাবা-মা আর আমি থাকি। বড় ভাই আমেরিকা গেছেন পিএইচডি করতে আর ছোটভাই আর্মির ক্যাপ্টেন। তিনি বগুড়া থাকেন।

তিনি এবার হেসে বললেন, আমি আগামী শুক্রবার সন্ধ্যায় তোমাদের বাসায় যেতে চাই। তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? অফিসের চেয়ারম্যান বলে নয়, এমন মায়ের বয়সি অন্য কেউ বাসায় আসতে চাইলেও অনুপমা নিষেধ করতে পারতো না।

*

অনুপমাদের মোহাম্মদপুরের ফ্ল্যাটে আজ সাজ সাজ রব। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভেতরে ভেতরে বাড়ির সবাই বেশ উৎসুক। তার মা তাহেরা বানু উত্তেজিত। মেয়ের অফিসের চেয়ারম্যান আসবে শুধু সেটা বলে নয়। অনুপমা না বুঝলেও তাহেরা বানু বেশ বুঝতে পারছেন যে কোনো না কোনো প্রস্তাব আসতে যাচ্ছে। আবহমান বাংলার বিবাহযোগ্যা মেয়ের মায়েরা এসব বেশ বোঝেন। তা ছাড়া চেয়ারম্যানের সাথে অনুপমাদের এমডিও আসছে। ছেলেটি তাহেরা বানুর বিশেষ পছন্দের। তাই আজ বাড়িতে বিশাল আয়োজন করে রান্নাবান্না করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর অনুপমার অফিসের এমডি, চেয়ারম্যান ও সিএও হাসনাত সাহেব এলেন। অনুপমার বাবা অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল আনোয়ারুল কবীর সবাইকে নিয়ে বসার ঘরে বসালেন। অনুপমার বড়ভাই মায়ের জরুরি ফোন পেয়ে গতকাল রাতে বগুড়া থেকে ঢাকা এসেছে। সেও সবার সাথে বসলো। অনুপমা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে মায়ের ইশারায় ভেতরে চলে গেল।

মনে মনে তাহেরা বানু সফটসনিকের এমডির সাথে মেয়ের বিয়ের কথা ভাবলেও চেয়ারম্যান ম্যাডাম তাকে অবাক করে নিজের একমাত্র ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। ছেলের একটি বায়োডাটা ও ছবি তাহেরা বানুর হাতে দিয়ে সেদিনের মতো সবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। অতিথিরা চলে গেলে তাহেরা বানু খুশিতে লাফাতে লাফাতে মেয়ের ঘরে গেলেন। গিয়ে দেখলেন মেয়ে শক্ত মুখে বিছানায় বসে আছে। মা ঢুকতেই অনুপমা বললো, মা আমি এখন বিয়ে করবো না। তাহেরা বানু বললেন, আচ্ছা ছেলেটাকে দেখ আগে। দেখলেই তো কেউ ধরে তোকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে না। এই বলে তাহেরা বেগম ছবি আর সিভির খামটা রেখে চলে গেলেন। অনুপমা বিছানা থেকে উঠে সেটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। এরপর অহমকে ফোন করলো। অহমের ফোন বন্ধ। সেদিন সারা রাত অহমের ফোনে কল করে গেলেও সংযোগ পেলো না অনুপমা। পরদিন অফিসে গেলো না সে। এদিকে অহমেরও খোঁজ নেই। অনুপমার বড় ভাইয়ের বন্ধুর মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানলো, অনেকদিন ফিরবে না বলে সে মাধবকে নিয়ে কোথায় যেন গেছে। মাধবের মাও কোনো খোঁজ দিতে পারেনি তাদের। শুনে অনুপমা সারা দিন আর ঘর থেকেই বেরুলো না। তাহেরা বেগম খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। কী হলো তার মেয়ের?

সন্ধ্যায় মেয়ে যখন ঘর থেকে বেরুলো তখন তাকে চেনা দায়। নির্ঘুম রাতের অবিরত কান্নায় চোখ মুখ থমথমে। এমন অবস্থা দেখে তিনি আর মেয়েকে কিছু বললেন না। অনুপমা নিজে থেকেই বললো, মা আমি আর চাকরিটা করবো না। তাহেরা বেগম মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, যেটা ভালো বুঝিস তাই কর। তুই আমাদের একমাত্র মেয়ে। তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমরা কিছু করবো না।

*

অহমকে বহনকারী বাসটা যখন ঢাকার কলাবাগানে পৌঁছলো তখনো পূর্ব দিক ফর্সা হয়নি। সূর্য মামা ঘুম থেকে উঠবো উঠবো করছে। অহম তার ওঠার অপেক্ষা না করে বাস থেকে নেমে পড়লো। এখান থেকে অহমদের ধানমন্ডি ৮ নাম্বার রোডের বাড়ি খুব দূরে নয়। হেঁটেই রওনা হলো সে। ভোরের ঠান্ডা বাতাসে হাঁটতে অহমের ভালোই লাগছিল। ছেলেবেলা থেকেই এই পথ দিয়ে কত চলে গেছে সে তবুও সবকিছু নতুন নতুন লাগছিল। বন্ধু আফজালের সাথে সেদিন কথা বলার পরই মা শায়লা বেগমকে ফোন করেছিল অহম। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর মা ছেলের সেই কথোপকথনে মূলত কান্না ছাড়া আর কোনো শব্দমালার ব্যবহার হয়নি। কান্না কিংবা হাসিরও একটা নিজস্ব ভাষা আছে। সেই ভাষায় দুজনেই বুঝে নিয়েছে পরস্পরের মনের কষ্ট, আবেগ, ভালোবাসা। অহমের অভিমান পরিণত হয়েছে অনুশোচনায়। কেন সে এতদিন মাকে ফোন করেনি। তাই এতদিনের অভিমান ভুলে আজ বাড়ি ফিরে এসেছে সে। আসার আগে কাউকে কিছু জানায়নি। এমনকি অনুপমাকেও না। জানালে হয়তো দেখা যেত সারা রাত বাস কাউন্টারে এসে বসে রয়েছে। বাড়ির বড় সাদা গেটের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো অহম। কত স্মৃতি মিশে আছে এই বাড়িতে। বড় বড় মেহগনি গাছগুলো আগের মতোই আছে। পরিবর্তনের মধ্যে বাড়িটির রং আগে লাল ছিল। এবার দেখছে সেটাকে সাদা রং করা হয়েছে। লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে অহম দেখলো ভেতরে হাসেম দাদু হাঁটাহাঁটি করছে। ছেলেবেলা থেকে এই দৃশ্যটা কতবার যে দেখেছে তার হিসেব নেই। দাদু কি একটু বুড়িয়ে গেছে? এটা ভাবতে ভাবতেই অহম যখন বাড়ির কলিং বেলে নিজের আঙুল ছোঁয়ালো ততক্ষণে চারদিকে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। দুবার বেল চাপার পর হাসেম দাদু এগিয়ে এলেন গেট খুলতে। গেটের গায়ের ছোট ফোকরে চোখ রেখে বুঝতে চাইলেন সাতসকালে আসা আগন্তুকটি কে? ভালো করে খেয়াল করে হাসেম দাদু ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। প্রায় জ্ঞান হারানোর অবস্থা! সেই ছেলেবেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করা ছোট খোকার হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি হাসেম দাদু। জায়নামাজে বসে কতো দোয়া করেছে যাতে খোকা ফিরে আসে। আজ আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেছেন। তিনি গেট খুলে অহমকে বুকে জড়িয়ে ধরে ‘বউমা, বউমা’ বলে বাড়ি মাথায় করে তুললেন। অনেক বছর পর শায়লা বেগম ছেলেকে পেয়ে কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। মনে মনে ভাবলেন ছেলেকে এবার শক্ত বাঁধনে বাঁধতেই হবে।

*

অফিসে ঢুকেই অনুপমা নিজের সিটে গিয়ে ল্যাপটপ থেকে ইস্তফাপত্রটি প্রিন্ট করলো। এরপর ব্যক্তিগত জিনিসগুলো একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিলো। সবাই অনুপমাকে দেখছিল কিন্তু কেউ ওকে কিছু বললো না। এরপর অনুপমা এমডির রুমে গেল। দেখলো এমডি তার নিজের আসন ছেড়ে সামনের আসনে বসে আছেন। আর এমডির চেয়ারটা পেছন ফিরিয়ে কেউ একজন বসে আছে। রিজাইন লেটারটা টেবিলের উপর রেখে অনুপমা বললো, স্যার আমি জবটা ছেড়ে দিচ্ছি।

এমডি কিছু বলার আগেই চেয়ারে বসা লোকটি বললো, চাকরিটা ছেড়েই দাও। কারণ পাহাড়ি মানুষের স্ত্রীর চাকরি করা মানায় না। চমকে উঠলো অনুপমা। আনুপমার প্রাথমিক ধাক্কা কাটতে না কাটতেই লোকটি রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

অনুপমা স্থান-কাল ভুলে ‘তুমি’ বলেই অহমের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তুমি! তুমি এখানে কী করে?

এমডি আফজাল সাহেবকে এবার বলতেই হলো, সফটসনিকের ফাউন্ডার, ইগো ডিফিন্ডারের স্রষ্টা অহম। ইগোই অহম, অহমই ইগো- হা হা হা হা। হঠাৎ দরজায় শব্দ হতেই অনুপমা সম্বিত ফিরে পেয়ে অহমকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো। তমাকে সঙ্গে নিয়ে শায়লা বেগম ঘরে ঢুকলেন। তিনি অনুপমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কি মা, করবে বিয়ে আমার ছেলেকে?

অনুপমা লাজুক মুখে মাথা নেড়ে হাসলো। হাসিতে তার বিশ্বজয়ের আনন্দ।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুন ২০১৭/রাসেল পারভেজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়