ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ

শুভাশিস সিনহা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৬, ৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার



‘আমরা যখন একটি কবিতা পড়ি, তখন তাহাকে আমরা শুদ্ধমাত্র কথার সমষ্টিরূপে দেখি না- কথার সহিত ভাবের সম্বন্ধ বিচার করি। ভাবই মুখ্য লক্ষ্য। কথা ভাবের আশ্রয়-স্বরূপ।’

(সংগীত ও কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

খুবই সহজ, সাধারণ, কিন্তু এক্কেবারে খাঁটি কথাটাই বলেছেন রবীন্দ্রনাথ, একেবারে রাস্তার লোকের ধরণে বয়নে। ভাবের রাস্তায় কবিগুরু ভোক্তা বা উপভোক্তাকে এভাবেই সহজে টেনে আনেন। এরপর ধীরে ধীরে দুঃসহ বিষয়মণ্ডলে টেনে নিতে থাকেন। কিন্তু সহজ লোকের মতো।

কবিতা নামের আজ-অবধি অমীমাংসিত বিষয়কর্মটির অন্দরমহলের কথা জানার বা জানাবার জন্য কবি স্পষ্ট পথেই এগোতে চেষ্টা করেন। একটা র‌্যাশনাল ব্যক্তিত্বে। তিনি বলেন :

‘বিশ্বাস করাইয়া দেওয়া এক, আর উদ্রেক করাইয়া দেওয়া স্বতন্ত্র। বিশ্বাসের শিকড় মাথায়, আর উদ্রেকের শিকড় হৃদয়ে। এইজন্য বিশ্বাস করাইবার জন্য যে ভাষা, উদ্রেক করাইবার জন্য সে ভাষা নহে। যুক্তির ভাষা গদ্য আমাদের বিশ্বাস করায়, আর কবিতার ভাষা আমাদের উদ্রেক করায়। যে-সকল কথায় যুক্তি খাটে তাহা অন্যকে বুঝানো অতিশয় সহজ; কিন্তু যাহাতে যুক্তি খাটে না, যাহা যুক্তির আইনকানুনের মধ্যে ধরা দেয় না, তাহাকে বুঝানো সহজ ব্যাপার নহে।... যুক্তি যে-সকল সত্য বুঝাইতে পারে না বলিয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছে, কবিতা সেই-সকল সত্য বুঝাইবার ভার নিজ স্কন্ধে লইয়াছে। ... অনেক সময় এমন হয় যে, শত-সহস্র প্রমাণের সাহায্যে একটা সত্য আমরা বিশ্বাস করি মাত্র, কিন্তু আমাদের হৃদয়ে সে সত্যের উদ্রেক হয় না। আবার অনেক সময়ে একটি কথায় আমাদের হৃদয়ে একটি সত্যের উদ্রেক হইয়াছে, শত-সহস্র প্রমাণে তাহা ভাঙিতে পারে না।’

এতক্ষণ পর্যন্ত পড়ে আমরা কবিতার সাথে সম্পর্কিত বেশ কিছু চাবিশব্দ পাই। প্রথমত পাই দুটো আপাতবিরোধী বিষয়। বিশ্বাস আর উদ্রেক। বিশ্বাস মানে বিশ্বাসই, যা মন মেনে নেয় তার চৈতন্য-অবচৈতন্যের অভিজ্ঞতায়। আর উদ্রেক হচ্ছে মাত্র শুরু। একটা আলোড়ন। একটা চমক। হঠাৎ কিছু টের পাওয়া। রবীন্দ্রনাথেরই কথায়, হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে চিত্তের ঝলমল করে ওঠা। কিন্তু সেই আলোর ঝলকানি মানসিক সামাজিক কোনো ক্ষেত্রেই কোনো কিছুর প্রতিষ্ঠাকারী শক্তি নয়। তার কোনো ভাবগত স্পষ্ট পরিচয় নেই। রবীন্দ্রনাথ বলতে চাচ্ছেন যে, সেই স্পষ্ট ভাবের দূরান্বয়ী ভাবটিই কবিতার শক্তি। তাকে নিয়েই কবিতার কারবার।

কবি আরও বলতে থাকেন :

‘আমি যাহা বিশ্বাস করিতেছি তোমাকে তাহাই বিশ্বাস করানো আর আমি যাহা অনুভব করিতেছি তোমাকে তাহাই অনুভব করানো-এ দুইটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার। আমি বিশ্বাস করিতেছি একটি গোলাপ সুগোল, আমি তাহার চারিদিক মাপিয়া-জুকিয়া তোমাকে বিশ্বাস করাইতে পারি যে গোলাপ সুগোল। আর আমি অনুভব করিতেছি সে সুন্দর। তখন কবিতার সাহায্য অবলম্বন করিতে হয়। গোলাপের সৌন্দর্য আমি যে উপভোগ করিতেছি, তাহা এমন করিয়া প্রকাশ করিতে হয়, যাহাতে তোমার মনেও সে সৌন্দর্যভাবের উদ্রেক হয়। এইরূপ প্রকাশ করাকেই বলে কবিতা।

এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে!

তাহলে এ-ই কবিতা। প্রাচ্যের কাব্যদার্শনিকের সাথে গলা মেলান পাশ্চাত্যের আরেকজন- ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ। তিনি বলেন, কবিতা শক্তিশালী এবং স্বতঃস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশ। আর এটা কবির মনের অনুভূতি পাঠকের কাছে সমানভাবেই সঞ্চারিত করে দিতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই নন্দনতাত্ত্বিক আলোচনা দৈনন্দিনতার সহজিয়া দর্শনে বেঁধে ফেলতে চান। তাই আরও এক ধাপ এগিয়ে বিষয়টাকে সহজ করে তুলতে যান। বলেন: চোখে চোখে চাহনির মধ্যে যে যুক্তি আছে, যাহাতে করিয়া প্রেম ধরা পড়ে- অতিরিক্ত যত্ন করার মধ্যে যে যুক্তি আছে, যাহাতে অসীম কথা প্রকাশ করে- কবিতা সেই-সকল যুক্তি ব্যক্ত করে। 

কবি কইতে চান, কবিতা নামের এই বচননন্দনে অনির্বচনীয়তার সাধনই সিদ্ধির প্রধান উপায়। যা বলতে চাই, তা না বলে না-বলার ভেতর কহতব্যকে প্রকাশ করা।

আবার কবি এ-ও বলছেন যে, কবিতা বা কবিতা-উপম অন্তর্গত ভাবের ভেতর মহা একটা জটিল চক্র আছে। ‘আপনাকে প্রকাশ করার জন্য তাহার তেমন সোজা রাস্তা নাই। সে নিজের উপযোগী নূতন রাস্তা তৈরি করিয়া লয়। যুক্তির অভাব মোচন করিবার জন্য সৌন্দর্যের শরণাপন্ন হয়।’

এই সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য কবিতায় কী করতে হয়? অথবা কবিতা কীভাবে সুন্দর হয়, যা মানুষের ভেতর অনিবর্চনীয় আনন্দ উৎপাদন করে। কবি তাও বলে দিচ্ছেন।

‘সে (কবিতা) এমনি সুন্দর করিয়া সাজে যে, যুক্তির অনুমতিপত্র না থাকিলেও সকলে তাহাকে বিশ্বাস করে। এমনি তাহার মুখখানি সুন্দর যে, কেহ তাহাকে কে কী বৃত্তান্ত কেন জিজ্ঞাসা করে না, কেহ তাহাকে সন্দেহ করে না, সকলে হৃদয়ের দ্বার খুলিয়া ফেলে।’

এখনও আমরা রবীন্দ্র-কাব্যনন্দনতত্ত্বের জৈবিক কাঠামোটির সন্ধান কিন্তু পেলাম না। এতদূর পর্যন্ত এসে জানতে পারলাম এটুকুই, কবিতার সৌন্দর্য সঞ্চরণশীলতা উপলব্ধির ব্যাকরণ একেবারেই অজৈবিক বা অ-বস্তুগত কিছু। কিন্তু মনীষী রবীন্দ্রনাথ পরের ধাপেই উন্মোচন করতে যান কবিতার নন্দন বা সুন্দরের উপচারগুলোর মোড়ক। ছন্দের কথাটি তোলেন আগেভাগে। কারণ ‘অনুভূতির ভাষা ছন্দোবদ্ধ। পূর্ণিমার সমুদ্রের মতো তালে তালে তাহার হৃদয়ের উত্থান-পতন হইতে থাকে, তালে তালে তাহার ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়িতে থাকে। নিঃশ্বাসের ছন্দে, হৃদয়ের উত্থান-পতনের ছন্দে তাহার তাল নিয়মিত হইতে থাকে। কথা বলিতে বলিতে তাহার বাধিয়া যায়, কথার মাঝে মাঝে অশ্রু পড়ে, নিঃশ্বাস পড়ে, লজ্জা আসে, ভয় হয়, থামিয়া যায়...’


কবিতায় ছন্দ বিষয়টা আসলে কী, তার চরিত্র কীরকম, কেন তা জরুরি হয়ে ওঠে, ব্যাকরণের সূত্রে নয়, তাকে একেবারে জাগতিক ভাব-সাবের সাথে মিলিয়ে এভাবেই রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কার করে নিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু যে সুন্দরকে নিয়ে কিংবা সুন্দর হয়ে-ওঠার মধ্য দিয়ে কবিতার অন্তর্গত যাত্রাপথ বিস্তৃত, তার আদ্যন্ত ভরে থাকে নানান সৃষ্টিসজ্জাপুষ্পে। কবি এর জন্য প্রথমেই উল্লেখ করেছেন ছন্দের কথা। বাহ্য-জীবনের নিখাদ কথার থেকে কবিতার ভিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় ছন্দ অন্যতম কারিগর। আমাদের মধ্যযুগের বঙ্গ অঞ্চলের সমস্ত গীতিকাব্য, পালা ছন্দোবদ্ধ, এটা তাই ঐতিহ্যেরও অংশ।

পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি

আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি।


যে অজ্ঞাত-গন্তব্য গহনপথ দুটো সত্তার মধ্যে বন্ধন জুড়ে দেয়, তার রেখায় রেখায় আঁকা পদস্পন্দন এই ছন্দ ছাড়া ধরা হতো বৃথা। অথবা যখন বলেন,

                       রাশি রাশি ভারা ভারা

                       ধান কাটা হল সারা

                       ভরা নদী ক্ষুরধারা

                       খর পরশা

                       কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।


অধ্যাত্মের ক্ষেতে ও ক্ষেত-পারে মানুষের স্থির-হয়ে-যাওয়া মুহূর্তের আন্দোলন যে ছন্দে ধারণ করেছেন, তার কোনো বিকল্প খোঁজা যেন অর্থহীন।

আবার মধ্যদিনে যবে গান কবিতা রচনা করেন এভাবে :

              মধ্যদিনে যবে গান

                     বন্ধ করে পাখি

             হে রাখাল, বেণু তব

                     বাজাও একাকী।


সেই মধ্যদিনের অবসাদ ও অবসাদ-ভাঙা সুর যেন চলার জন্য ওই লয়কেই বেছে নিয়েছে। কবিতার বিষয়ই নির্ধারণ করে নিচ্ছে ছন্দ। ধ্বনি, শব্দ ও ছন্দ যখন পরস্পর বোঝাপড়া করে গ্রন্থিবদ্ধ হয় বিষয়াত্মার অঙ্গে-উপাঙ্গে, কবিতার সৌন্দর্য তখনই প্রকাশ পায়, তখন ভাষা ভাষা-ঊর্ধ্ব বোধের নভোমণ্ডলে ভেসে বেড়াতে থাকে। তার ছায়ায় বসে পাঠক মানুষ কেবল বলে উঠতে পারে- সুন্দর! কিন্তু এই ছন্দোবদ্ধ রবীন্দ্রনাথ কাব্যজীবনের অন্তিম পর্যায়ে আপাতদৃষ্ট ছন্দ থেকে দূরে থেকেছেন, কিন্তু ছন্দকে মিশিয়ে দিয়েছেন আপাত-অদৃশ্য ধমণির যাত্রাস্পন্দে।


রূপনারানের কূলে বা প্রথম দিনের সূর্য-র মতো কবিতা নির্মিতিতে একটা ভাব নিয়েছে যেন জীবন এমনই ছন্দ বা নিয়মশৃঙ্খলহীন একটা দার্শনিক বোঝাপড়া, কিন্তু তারপরও বের হয়ে যেতে পারেন না সেই চলনসুষমা থেকে, তাই দেখতে পাই এসব কবিতা বাঁধা আছে চলার গভীর ছন্দে। এবং যে রবীন্দ্রনাথ বলেন, আমারই চেতনার রঙে পান্না হ’লো সবুজ, চুনী উঠল রাঙা হয়ে... গোলাপের দিকে চেয়ে যাঁর উচ্চারণ মাত্র গোলাপ সুন্দর হয়ে ওঠে, সেই রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর এই ক্ষ্যাপামি, কাব্যিক ‘অহম’, প্রকাশের গদ্যরুক্ষতা বিদীর্ণ হয়ে ওঠে এ-সকল মজ্জাক্ষরিত উপলব্ধিতে: আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ-জীবন অথবা দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগর-তীরে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়- কে তুমি/ পেল না উত্তর।


রোমান্টিক মেরুদাঁড় ভেঙে পড়ে চিরন্তন সংশয়ের ঝড়ে। আর কবিতা সুন্দর হয়ে-ওঠার কৈবল্যে দেখা রবীন্দ্রনাথ নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়ান দর্শনের কাব্যশক্তি নিয়ে। আর আমরা বুঝে নিতে থাকি, এভাবেই কবিতার কাঠামোগত হয়ে-ওঠার পথ বাৎলে দেয়া রবীন্দ্রনাথ কবিতার আত্মিক শক্তির বৈচিত্র্যে পূর্ণ হওয়ার উপায়চি‎‎হ্ন এঁকে এঁকে যান।


সেই চিহ্নের তিলক পরে নিলে কাব্যললাট- আজও মহিমান্বিত হতে পারে।
 

 

লেখক: কবি, নাট্যকার ও নির্দেশক

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়