ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতন || রফিকুর রশীদ

রফিকুর রশীদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতন || রফিকুর রশীদ

ঢাকা থেকে সেই সাত সকালে ছেড়ে আসা সুবর্ণ পরিবহনের কোচ মেহেরপুর পেরিয়ে যখন কেদারগঞ্জ বাজারে পৌঁছে, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের গায়ে হেলান দিয়েছে। বাজারের উপরে কয়েকজন প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দিয়ে কোচ চলে যায় আরো সামনে, দক্ষিণে। আরো মাইল দুয়েক পরে মুজিবনগর হচ্ছে তার গন্তব্যের শেষ প্রান্ত। আমি নেমে পড়ি কেদারগঞ্জে।

আমজাম শিলকড়ুইয়ের ছায়া ঢাকা গ্রাম্য বাজার। বিশেষ কোলাহল নেই। এদিক ওদিক এলোমেলো তাকাই। রিকশা নেই। চার রাস্তার মোড়ে বেশ কয়েকটি ভ্যান দাঁড়িয়ে। কোনোটি ছইতোলা, কোনোটি খোলা ভ্যান। বুঝতে পারি, এগুলোই এ অঞ্চলের গ্রাম্যরাস্তার প্রধান বাহন। একই কোচের সহযাত্রী এক দম্পতি একটি খোলা ভ্যানে উঠে বসার পর ধোপদুরস্ত পুরুষটি আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আপনি কোথায় যাবেন?

আমি বুঝতে পারি, আমাকেই জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, তবু নিঃসংশয় হবার জন্যে জানতে চাই, আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ, আপনি কি নতুন এসেছেন এখানে?

আমি একটুখানি চমকে উঠি। আমাকে দেখে তাহলে সহজেই বুঝা যাচ্ছে যে আমি আগন্তুক। মানুষ মানুষে কী এমন প্রভেদ যে এত অনায়াসে শনাক্ত করা যায়। চেহারা কিংবা পোশাক আশাকে ওই প্রশ্নকারীর সঙ্গে তো আমি তফাৎ কিছুই দেখি না। যদিও মাথার সামনের দিকে বেশ বিরলকেশ হয়ে উঠেছে, তবু হয়তো সে বয়সে আমার চেয়ে খানিক ছোটই হবে। সুবর্ণ পরিবহনে ঠিক আমার সামনেই ছিল তাদের সিট। বেশ কয়েকবার পুরুষটির সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেও হয়েছিল আমার। পারিনি তার সঙ্গী মহিলার কারণে। নবপরিণীতা গ্রাম্যবধূর মতো এই মহিলাটির সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে আমার ভেতরে দুর্বোধ্য এক সংশয় দানা বাঁধে, সংকোচও হয় কথা বলতে। সারাপথ পুরুষটিকে এক তরফাভাবে বামদিকে ঢলে পড়তে দেখি। পেছন থেকে মহিলার মুখ দেখতে পাইনে বটে, তবু আমার মনে হয় সে ওই খসখসে পাটভাঙ্গা শাড়ির ঘোমটার মাঝে ভয়ানক ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় ওদের সঙ্গে কথা বলা যায়?

অথচ কোচ থেকে নামার পর এখন তারা দিব্যি ভ্যানের দুপাশে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসেছে। মহিলার মাথা থেকে ঘোমটা খসে পড়েছে পিঠের উপরে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। হ্যাঁ খানিকটা অসমবয়সী জুটিই বটে, তবু কী চমৎকার হাতের মুঠোয় হাত ধরে তারা সঞ্চারিত করে দিচ্ছে প্রাণের প্রবাহ। কিন্তু সহসা আমার করোটির অন্ধকারে এক ঝলক বিদ্যুৎ খেলে যায়। আমার মনে হয় মহিলা বুঝিবা স্বামীর হাতের মুঠোয় চিমটি কেটে গোপনে ভর্ৎসনা করছে অচেনা মানুষের সঙ্গে তোমার অতো আগ বাড়িয়ে আলাপ করার কাজ কী! তাদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে এতক্ষণ পর আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিই, হ্যাঁ, নতুন এসেছি।

কিন্তু পরক্ষণেই মনে মনে গুমরে ওঠে বিদ্রোহ, নতুন হবে কেন? আহসান হাবীবের মতো দৃপ্ত কণ্ঠে কেন আমি বলতে পারলাম না আমি কোনো আগন্তুক নই। আমি ছিলাম এখানে। নিজেকেই শুধাই কেন বলতে পারি না? এই আসমানের তারা সাক্ষী দেবে না? মাছরাঙা পাখি, কার্তিকের ধানের মঞ্জুরী, এই তাল-তমাল জারুল জামরুল কেউ বলবে না আমি ছিলাম এখানে? আর এখানে থাকা মানেই সর্বত্র থাকা, সারা দেশে!

পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্য থেকে এক ফালি রোদ্দুর ঘন গাছপালার ফাঁক গলে আমার চোখে মুখে বুকে এসে পড়তেই ভেতরে ভেতরে ভয়ানক দগ্ধে উঠি সত্যিই নতুন এসেছি এখানে? খানিক দূরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের অম্রকানন এসবের কোথাও কখনো আমি ছিলাম না? এই যে এখানকার বেলে দোআঁশ মাটি সোঁদা গন্ধ আমার খুব চেনা চেনা লাগছে, এই যে বাতাসভরা আমের মুকুলের সুবাস আমার চৈতন্যে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, এ সবই কি তবে মিথ্যে?

মন আমার যা-ই বলুক, মুখে তো আমি ঠিকই স্বীকার করেছি যে, এখানে আমি নবাগত একজন, ফলে ভ্যানের উপর থেকে ঘাড় বাঁকিয়ে সেই পুরুষটি আবারও জানতে চায়, কোথায় যাবেন বললেন না তো!

ততক্ষণে ভ্যানের চাকা গড়তে শুরু করেছে। ঘোমটা পড়া মহিলাটির যেন বড্ড তাড়া। স্বামীর হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত খসিয়ে নিয়ে সে ভ্যানঅলাকে ভ্রুভঙ্গিতে ইঙ্গিত করে চলো দেখি, বেলা পড়ে গেল! আমার বিমূঢ় ভঙ্গি দেখে এবার পুরুষটিও মুখ ঘুরিয়ে নেয়, হয়তো আমার গন্তব্যের খবর জানার কৌতূহল তার ফুরিয়েছে। মনে মনে আমার বেশ হাসি পায়। কেন জানি না এতক্ষণে আমার খুব মনে হয় ওই মহিলাটির বাপের বাড়ি এ তলাটেরই নিকটপারের কোনো গাঁওগেরামে, পথের মধ্যে উটকো ঝামেলায় আটকে এ রকম বেশুমার সময় নষ্ট করার অবকাশ তার কোথায়! হয়তো ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে পথ চেয়ে আছেন তার মা জননী-আদরের ময়না তার কখন আসে, কখন আসে...! অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে হয়তোবা এ রকম দোজবরে পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, তাই বলে মা-বাবার উৎকণ্ঠা-উদ্বেগের কি শেষ আছে! ময়নার জন্যে মায়ের চোখে পলক পড়ে না।

ময়না? আমি নিজেই অবাক হই কে বলল ওই মহিলার নাম ময়না? আমি জানি গ্রামে এখনো পাখির নামে মেয়েদের নাম হয় ময়না, টিয়া, বুলবুলি...। দ্যাখো কী অবাক কাণ্ড অতো দূরে যাবার পর পথের বাঁক ঘোরার সময় ময়না ঠিকই ঘাড় উল্টিয়ে তাকায়। কেন তাকায়? কী আছে ফেলে যাওয়া পথের প্রান্তে? এতো দূরে থেকেও দিব্যি আমি তার চোখের ভাষা পড়তে পারি। সহসা যেনবা চিনতেও পারি ময়নাকে। মনে হয় কবে কোন দূর অতীতে হারিয়ে যাওয়া ছোটবোন আমার!

শুধু পাখির নামে কেন, ফুলের নামেও তো কতো মেয়ের নাম হয়। শেফালি, চামেলি, গোলাপ, টগর, হাসনাহেনা, জুঁই কী নয়! প্রায় সবফুলই নিজের নাম ধার দিয়েছে এ দেশের মেয়েদের। ফুটে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল, এতো দিয়েও কিছুতেই নিঃশেষ হয় না সৌন্দর্য-সুবাস। এতো সব নাম ছাপিয়ে কেবল পুষ্প শব্দটুকুতেই কী যে স্নিগ্ধমদির কমনীয়তা! একা পুষ্পই যেন সব ফুলের নাম ঢেকে দেয়। মনে মনে পুষ্প শব্দটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই হঠাৎ আমি চমকে উঠি, দ্রুত হাত চালিয়ে বুকপকেট থেকে বের করে আনি অরুণ কাকার চিঠি, সেখানে লেখা রয়েছে ‘পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতন।’ গ্রাম : সুন্দরপুর। জেলা-মেহেরপুর। নিশ্চিন্তে সে চিঠি আবারও পকেটে পুরে রাখি।

এতক্ষণে নিজেকেই প্রশ্ন করি, সুন্দরপুর কি আমার কাছ অচেনা কোনো জনপদ? পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতনের সঙ্গে আমার কোনো স্মৃতির যোগ নেই? শৈশবজোড়া অমল ধবল স্মৃতি হয়তো সময়ের ধুলো পড়ে খানিক ঝাপসা হয়ে যেতে পারে, তাই বলে নিঃশেষে মুছে যাবে? অরুণ কাকার সেই পুষ্পবীথিতেই আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। সত্যি বলতে কি সেই অবুঝ শিশুবেলাতেই আমার বুকের মধ্যে কবিতার উষ্ণতা এবং ওম সঞ্চারিত করেছিলেন এই অরুণকান্তি স্যানাল। কথায় কথায় কবিতা শোনাতে ভালোবাসতেন। শিশুকণ্ঠে কবিতা শুনতে আরো বেশি ভালোবাসতেন। বাংলা ভাষার কতো কবিতা যে তার মুখস্ত, আমাদের শৈশবে সে হিসেব কখনো মেলাতে পারিনি। আবার ভয়াবহ সেই একাত্তরে, যৌবনদিনে এসে যখন তার সামনে দাঁড়িয়েছি, তখনও রবীন্দ্রনাথ থেকে শুনিয়েছেন যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়ে, যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে... আহা, অরুণ কাকার কণ্ঠে কী যে প্রগাঢ় উচ্চারণ... এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।

অরুণ কাকার সেই সুন্দরপুরই যদি আমার গন্তব্য হবে, তাহলে এখন এই কেদারগঞ্জে নেমে আমি এ রকম বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি কেন? আমি কি পথ ভুলে গেছি?

দুই

আমার বাবার স্বভাবচরিত্রের যেটুকু আমি জেনেছি, তার সঙ্গে অরুণ কাকার কোনোরকম সাদৃশ্য আমি খুঁজে পাইনি। ভেবে পাইনি এই দুটি মানুষের নিবিড় বন্ধুত্ব হয়েছিল কেমন করে? এক কলেজে পড়লেই বন্ধুত্ব হয়? দেশভাগের পূর্বে তাঁরা উভয়েই ছিলেন কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্র। একজনের বাড়ি এই মেহেরপুরের সুন্দরপুর, অন্যজনের কৃষ্ণনগরের উপকণ্ঠেই। একজন পড়ে সায়েন্স গ্রুপে, অন্যজন আর্টস। তবু কী ভাবে যে কবে কবে তাদের এতো নিবিড় বন্ধুত্ব গড়েছিল, সে কথা দুজনের কেউই মনে রাখেনি! অথচ আমার বাবা চরম দুর্দিনে সেই বন্ধুকেই স্মরণ করেছেন সবার আগে। ছুটে এসেছেন তাঁরই কাছে, সুন্দরপুরে।

সাতচল্লিশেও নয়, আমার বাবা পঞ্চাশ সালে স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মুখে টিকতে না পেরে একেবারে খালি হাত-পা নিয়ে বর্ডার টপকে চলে আসেন এপারে। কিন্তু এপারেই বা পায়ের তলায় মাটি কই? দাঁড়াবার জায়গা কোথায়? সোজা এই সুন্দরপুরে এসে বন্ধুর সামনে দাঁড়ালে অরুণকান্তি স্যান্যাল অম্লান বদনে ঘরের দুয়ার হাট খুলে দেন, আশ্বস্ত করেন এ রকম হানাহানি কাটাকাটি চিরকাল থাকবে না। তুমি আমার এখানেই থেকে যাও আনোয়ার হোসেন।

অরুণকাকা বরাবার এমন পূর্ণনামেই আমার বাবাকে ডাকেন। অথচ বাবাকে দেখেছি অরুণদা বলে সম্বোধন করতে। কী জানি হয়তো তিনি দু-এক বছরের বড়ই হবেন বাবার চেয়ে। তা সেই ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধুত্বের আশ্রয়েই আটকে যান আমার বাবা। সুন্দরপুরই হয়ে ওঠে তার ঠিকানা। কিন্তু কাজকর্ম নেই, উদ্যমহীন দিনযাপন আর কাঁহাতক ভালো লাগে! সাতচল্লিশ আটচল্লিশের ডামাডোলে সুন্দরপুর-রতনপুর-বৈদ্যনাথতলার যে সব হিন্দুপরিবার ওপারে উঠে গিয়েছিল, তাদেরই কেউ কেউ আবার ফিরে আসে এপারে, কিন্তু পরিত্যক্ত ভিটেমাটি উদ্ধার করতে না পেরে মাথায় হাত দিয়ে পথে বসে। আনোয়ার হোসেন নিঃশব্দ পায়ে তাদের পাশে গিয়ে খুব সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করেন, ফিরে এলে কেন দাদা, ওপার থেকে? ওদিকের অবস্থা কী?

কেউ নীরবে অশ্রুপাত করে। কেউ হাউমাউ করে কাঁদে। পালপাড়ার সত্যেন হঠাৎ রুখে ওঠে, তুমি কে বটে এ সব শুধোবার? তোমার দেশে তুমি যাও!

আমার দেশ? সত্যেন পালের চোখ থেকে চোখ ফিরিয়ে সুড়সুড় করে কেটে পড়েন আনোয়ার হোসেন। অরুণকান্তি স্যানালও একদিন বলে বসেন, তোমার কি দেশে ফিরতে ইচ্ছে করে?

কোথায় আমার দেশ?

ভয়ানক বিরক্ত হন আনোয়ার হোসেন। তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন প্রিয় বন্ধুর মুখের পানে। কী যে বিব্রতকর দশা!

কী হলো! তাকিয়ে আছ যে!

না, আমি বোধ হয় তোমার বোঝা হয়ে উঠেছি অরুণদা?

কী যা তা বলছ!

হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি, দেশবিহীন মানুষ হয়?

অরুণকান্তি সান্যাল দুহাতে জাপটে ধরেন অনুজপ্রতিম বন্ধুকে। বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে বলেন, না না, এটাই তোমার দেশ। কোথাও যেতে হবে না তোমাকে।

রুদ্ধ আবেগে দুজনেরই চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুদানা।

অরুণকান্তি সান্যাল মা-বাবার একমাত্র সন্তান। জমি-জিরাত বাগান পুকুর যা যা আছে, দুপুরুষ ধরে বসে খেলেও তা তলানি পড়বে না হয়তো। কিন্তু আমার বাবা আনোয়ার হোসেন কী করবেন? সীমান্তবর্তী এই অজপাড়াগাঁয়ে বসে বসে কেবল বন্ধুর অন্ন ধ্বংস করবেন? একদিন হাত কচলে বন্ধুর সামনে সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন কী করি বলো তো অরুণদা, এ ভাবে শুয়েবসে দিন কাটানো যায়?

অরুণকান্তি সান্যাল খুব সহজভাবে গ্রহণ করেন প্রশ্নটি। একগাল হাসি ছড়িয়ে কেমন অবলীলায় জবাব দেন আমিও কদিন থেকে সেই কথাই ভাবছি। আমরা দুজনে মিলে এই গাঁয়ে একটা স্কুল খুলব, মাস্টারি করব, কেমন হবে বলো দেখি!

এমন অকাট্য একটা প্রস্তাবও যে প্রস্তুত হয়ে ছিল, সে কথা কে জানত! পেশা হিসেবে গ্রাম্য স্কুলের শিক্ষকতা খুব বেশি পছন্দ নয় আনোয়ার হোসেনের। তবু মন্দের ভালো হিসেবে এটুকুই আপাতত মেনে নেন। শুরু হয় স্কুল খোলার কর্মযজ্ঞ। অরুণকান্তি সান্যালের জমিতে তারই একক অর্থায়নে গড়ে ওঠে পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতন। শিক্ষকও জুটে যায় আরেকজন, বিমল স্যার। পুরো নাম বিমল সরকার। ইংরেজির স্যার। রতনপুরের খ্রিস্টান পল্লীতে বাস। সেই ছোটবেলায় শুনেছিলাম, মাইকেল মধুসূদনের মতো আমাদের বিমল স্যারও নাকি ইংরেজি শেখার লোভেই খ্রিস্টান হয়েছিলেন।

পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতনের শিক্ষকতা আমার বাবাকে বেশিদিন বেঁধে রাখতে পারেনি। অরুণকাকা অবশ্য তাকে আটকানোর চেষ্টা যথেষ্টই করেছেন। পাশের গ্রামের এক দরিদ্র পরিবার থেকে সুন্দরী মেয়ে পছন্দ করে অনুজপ্রতিম বন্ধুর বিয়ে দিয়েছেন। নিজের বাড়ির একাংশে পৃথক ঘরে সংসার পেতে দিয়েছেন। কিন্তু সব চেষ্টাই তার ব্যর্থ হয়েছে। আমার জন্মের বছর দুয়েক পর আমার খেয়ালী বাবা একদিন কাউকে কিছু না বলে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। সুন্দরপুরে পড়ে থাকে তার স্ত্রী পুত্র, প্রিয় বন্ধু এবং পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতন।

শৈশবে যখন আমার স্কুলে যাওয়া শুরু হয়, তখন অর্থ না বুঝার কারণে আমাদের স্কুলের নামটি আমার ভালো লাগেনি। খড়ের চাল ছাওয়া স্কুলঘর, সামনে কদম গাছ, এক পাশে গাঁদা আর দোপাটির সারি-এ সবই ভালো। অরুণকাকার আদর ভালো, মিষ্টি মিষ্টি কবিতা ভালো, স্কুলের নামটি ভালো লাগে অনেক পরে।

আমার বাবা প্রায় বছর খানেক পর অরুণকাকাকে চিঠি লিখে জানান, তিনি সরকারি চাকরি পেয়েছেন। অল্পদিনেই সুন্দরপুরে এসে স্ত্রীপুত্র নিয়ে যাবেন কর্মস্থলে। কিন্তু সেই কর্মস্থলটা কোথায়? না, সে খবর নেই। পুরো চিঠিজুড়ে কত কথাই তিনি লিখেছেন, এ ভাবে না বলে উধাও হবার জন্যে অরুণদার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন ইনিয়ে বিনিয়ে, শিশুপুত্রকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা পর্যন্ত মেলে ধরেছেন চিঠিতে; কেবল তার কর্মস্থলটা কোথায় অবিস্থত সেই কথটা জানাতেই ভুলে গেছেন। অবশ্য অরুণ কাকার দৃষ্টিতে এটা কোনো ব্যাপারই নয়। চাকরি পাবার আনন্দে এমন প্রমাদ ঘটেছে। দ্যাখো না সে এবার এলো বলে! কিন্তু না, বাস্তবে তেমনটি ঘটে না। আমার বাবার আসতে ঢের বিলম্ব হয়। এরই ফাঁকে পুরনো সেই চিঠির খাম উল্টোপাল্টে অরুণকাকা একদিন আবিষ্কার করেন ঢাকার পোস্ট অফিসের সীল মোহর এবং সানন্দে ঘোষণা করেন সে ঢাকায় আছে।

বাবার স্বভাবটাই বড় বিচিত্র, বড়ই খেয়ালী। আরো বছর খানেক পেরিয়ে যাবার পর হুট করে একদিন উদয় হলেন সুন্দরপুরে। অরুণকাকার সামনে দাঁড়াতে ভয়, লজ্জা, সংকোচ নাকি অন্য কিছু কে জানে! দুই বন্ধুর মধ্যে বিশেষ একটা কথাবার্তাই হয় না। স্ত্রীপুত্রের হাত ধরে একদিন প্রভাতবেলায় ছেড়ে আসেন সুন্দরপুর। বিদায় বেলায় অরুণকাকার দুহাত জড়িয়ে ধরে বলেন, আমাকে তুমি ক্ষমা করো ভাই, তোমার পুষ্পবীথির শিক্ষক হবার যোগ্যতা আমার নেই, তাই পালিয়ে গেছি।

বলতে গেলে সুন্দরপুরের সঙ্গে সেই আমাদের সম্পর্ক শেষ। এরপর আমরা ঢাকার বাসিন্দা। ধীরে ধীরে ঢাকার স্কুল কলেজ চিনেছি এবং সুন্দরপুরের পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতনের কথা ভুলতে বসেছি। অরুণকাকার সঙ্গে বাবার পত্রযোগাযোগ বা অন্য কোনো আদান প্রদান ছিল কিনা আমার জানা নেই। বাবার মুখে কোনোদিন অরুণকাকা কিংবা সুন্দরপুর প্রসঙ্গে কিছুই শুনিনি। দুই বন্ধুর মধ্যে সূক্ষ্ম বিরোধ যে কোথায়, আমি এবং আমার স্বল্পশিক্ষিতা মা কিছুতেই নির্ণয় করতে পারিনি। অথচ দীর্ঘ বছর পনের পরে, দেশে তখন সত্তরের নির্বাচনের উতাল হাওয়া বইছে, তারই মধ্যে হঠাৎ একদিন অরুণকাকা এসে হাজির আমাদের ঢাকার বাসায়। সঙ্গে একটি শ্যামলা মেয়ে। কাজলটানা ডাগর চোখে টলটলে অশ্রুদানা, যে কোনো মুহূর্তে গড়িয়ে পড়বে বাঁধ ভেঙে। লাবণ্যমাখা ভরাট স্বাস্থ্য। নাম পুষ্প। আমি চমকে উঠি। বহুদিন পর পুষ্পবীথি বিদ্যানিবেতনের কথা মনে পড়ে। অরুণকাকা জানালেন, পুষ্প তার একমাত্র সন্তান; ওর জরুরি চিকিৎসার জন্যেই এত ঝড়ঝঞ্ঝা মাথায় করে এ অসময়ে ঢাকায় আসা। এমন চমৎকার প্রস্ফুটিত যে পুষ্প, তার অসুখ! ভালো করে তাকাই, কী অসুখ? অরুণকাকা অত্যন্ত মলিন মুখে জানান, তার মেয়ের কানে অসুখ, গলায় অসুখ। ভালো করে শুনতে পায় কিনা সে-ই জানে, কথা বলতে পারে না। ওর চেহারা দেখে আমার বিশ্বাসই হয় না, পুষ্প বোবা। অচিরেই জানা গেল, বোবা সে ছিল না জন্মসূত্রে; অল্প কিছুদিন থেকে তার এই দশা হয়েছে। কতদিন থেকে হয়েছে, কীভাবে হয়েছে সে সব কথা আমাদের সামনে আলোচনা হয় না, আলোচনা হয় আমার বাবার সঙ্গে। দুজন মিলে পুষ্পকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান, বাসায় ফিরে দুজনে মুখ নামিয়ে আলাপ আলোচনা করেন গভীর রাত পর্যন্ত। আমি জানি আসন্ন নির্বাচন, মুজিব ভাসানী ভুট্টো, ৬ দফা ১১ দফা সবই তাদের আলোচ্য বিষয় হয়ে আসে; কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে পুষ্পই এক সময় মুখ্য হয়ে ওঠে। মেয়েটি এখনো স্কুলের গ-ি পেরোয়নি, দেখতেই যা বাড়বাড়ন্ত, এই মেয়ে নিয়ে এখন কী করবেন, কোথায় যাবেন সেই চিন্তায় মাথার চুল উপড়ানোর দশা অরুণকাকার।

অথচ আমার কিন্তু তেমন দুশ্চিন্তা হয় না পুষ্পকে নিয়ে। আমার মনে হয় কোনো অভিমানে সে চুপ করে আছে, তবে যে কোনো সময় কথা বলবে; আমার সঙ্গেই বলবে। সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছি, দিনরাত ব্যস্ততার শেষ নেই, তার উপরে সারাদেশে বইছে রাজনৈতিক উত্তাল তরঙ্গ, এত কিছুর মধ্যে পুষ্পকে আমি সময় দেব কখন! তবে তার ডাগর কালো চোখ দুটি আমাকে সারাক্ষণ উস্কানি দেয়, আমার মন বলে আমি চাইলেই পুষ্প কথা বলবে। কিন্তু দোষ আমারই। পুষ্পের জন্যে আলাদা করে সময় বের করে উঠতে না উঠতেই বোবা পুষ্পকে সঙ্গে নিয়ে অরুণকাকা গ্রামে ফিরে যান। পুষ্প আদৌ সুস্থ হয়েছিল কিনা সেই খবর নেয়ার অবকাশই ঘটেনি।

একাত্তরের মার্চে বোধ হয় আমারই কারণে আমার বাবা অগ্নিগর্ভ ঢাকা ত্যাগ করে সুন্দরপুরে চলে আসেন। আমার অতিমাত্রায় রাজনীতিসম্পৃক্তি তাকে আতংকিত করেছিল। স্ত্রীপুত্র বেঁধেছেদে নিয়ে এতদিন পর সুন্দরপুরে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন, দুঃসময়ের বন্ধু অরুণকান্তি স্যান্যালের ঘরবাড়ি উদোম পড়ে আছে, তিনি নেই। সপরিবারে তিনি গেছেন কলকাতা, আর ফিরে আসেননি। আমার বাবার খুব মন খারাপ হয়ে যায়, চেহারায় ধস নামে। অনেকেই আমাদের আশ্রয় দিতে চায়, বাবা রাজি হন না। শেষে আমার মাতৃকূলের দরিদ্র আত্মীয়স্বজন জোর করে ধরে নিয়ে যায় তাদের আশ্রয়ে। কিন্তু সেখানে বাবার মোটেই স্বস্তি হয় না। কানের কাছে থ্রি ব্যান্ড রেডিও লাগিয়ে আর কদিন কাটে! ওপারে নানান লোক লাগিয়ে অরুণকাকার তত্ত্ব তালাশ করেন। আমিও ভেতরে ভেতরে ছটফট করি। অজপাড়াগাঁয়ে এই বন্দীদশা আর কাঁহাতক! তবু যদি পুষ্পের দেখা পেতাম! আহা, কেমন আছে সেই বাকহারা মেয়েটি! পুষ্পের নির্বাক হবার বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে নিতে এমনই এক কদাকার আবর্তে এসে পৌঁছে যাই যে আতঙ্কে-বেদনায় আমার চোখ বিস্ফারিত হবার যোগাড় হয়, আমি আর কিছুই জানতে চাই না। এরই মধ্যে ইয়াহিয়া মুজিব আলোচনা ব্যর্থ হলে আমার বাবা ভারতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। বর্ডার খোলা। দিনে-রাতে বহু মানুষ যাচ্ছে, আনোয়ার হোসেন যাবেন না কেন? ওপারেই তো তার জন্মভূমি, এখনো অনেক আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু না, তাতে হবে না; অরুণ সান্যালকে খুঁজে বের করতেই হবে। গন্ধ শুঁকে শুঁকে অরুণকাকার ঠিকানা যোগাড় করে তারপর আমাদের নিয়ে পাড়ি জমান ভারতে। এ দিকে মুখে অবিরাম গজ গজ করেন মেয়ের চিকিৎসা না ছাই। ঢাকায় হলো না, গেল কলকাতা। আর বাড়ি ফেরার নাম নেই। ওপারে গিয়েও আমার বাবা অরুণকাকা মুখের উপরে শপাং শপাং করে কথার চাবুক চালায় নিজের সহায় সম্পদ কুকুর শেয়ালের মুখে তুলে দিয়ে এসে এখানে কী করছ অরুণদা? এই দুঃসময়ে আমি এসে কোথায় দাঁড়াব সেটাও ভাবলে না?

আবার সেই অরুণকাকাই দুহাত বাড়িয়ে উদার আশ্রয় দেন। অমন দুর্দিনেও হা হা করে হাসেন, গমগমে কণ্ঠে কবিতা আওড়ান.... যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিবাইছে তব আলো/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সব চেয়ে অবাক কা- হচ্ছে, পুষ্পকে আমি কোথাও দেখতে পাই না। সহজভাবে কাউকে শুধালেই হয় তার কথা। না, সেটাও পারি না। জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে থাকে। দুচোখে সারাক্ষণ তাকে হাতড়াই। অবশেষে একদিন নিরুপায় হয়ে আমার মাকেই জিজ্ঞেস করি পুষ্পকে কোথাও দেখছি না যে! মা আমার আজগুবি তথ্য জানায়, পুষ্প নাকি এপারেই আসেনি! শুনে সব তাল গোল পাকিয়ে যায়। এক দেশ পাড়ি দিয়ে এতদূর ছুটে আসাও যেন সহসা অর্থহীন হয়ে যায়। তখন পথে পথে ঘুরে ঘুরে একদিন কাউকে কিছু না বলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের লাইনে দাঁড়িয়ে যাই।

তিন

কেদারগঞ্জ থেকে ভ্যানে চেপে আমি যখন সুন্দরপুরে পৌঁছাই, তখন বেলা ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। সেই একাত্তরের পর এই দীর্ঘ সময়ে সুন্দরপুরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই বটে, তাই বলে পথঘাট মানুষজন সব ভুলে বসে আছি এমন তো নয়! কিন্তু কই আমার সেই শিশুবেলার খেলার সাথী অনন্ত, বলাই, নিমাই, হিমাংশু! কোথায় গেছে সরলা, গিরিবালা, পারুল?

স্বাধীনতার পর সুন্দরপুরের কত উন্নতি হয়েছে! ইটবিছানো রাস্তা এসে গ্রামের উপর দিয়ে চলে গেছে দূরে। ঝকঝকে বিজলিবাতি এসে আলোকিত করেছে সারা গ্রাম। রাস্তার আশেপাশে ইটকাঠের দালানকোঠা উঠেছে। কিন্তু আমার সেই ছেলেবেলার সুন্দরপুর কই! আমার চেনা মানুষ না পেলেও অশীতিপর এক বৃদ্ধ আমাকে চিনতে পারে। কাছে এসে কপালের উপরে হাত তুলে পুরু চশমার ওপার থেকে দৃষ্টি ফ্যালে আমার মুখের উপরে, জিজ্ঞেস করে, তুমি কি আনুমাস্টারের ছেলে?

আনু মাস্টার মানে আমার বাবার নাম আনোয়ার হোসেন। এ গ্রামে মাস্টারিও করেছেন কয়েক বছর। গ্রাম্যবৃদ্ধ সেই স্মৃতি আজো ধরে রেখেছে। তার বর্ণনা থেকেই জানা গেল এ গ্রামের হিন্দুপাড়া কীভাবে উজাড় হয়েছে, হিন্দুদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে কী রকম মচ্ছব হয়েছে, এমন কি ভাইয়ে ভাইয়ে মামলা ফ্যাসাদ পর্যন্ত গড়িয়েছে। আমি ভয়ে ভয়ে উৎকর্ণ হয়ে থাকি এরপরই হয়তো পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতনের কথা শুনতে হবে।

অবশ্য এতদিন পর আমি ওই পুষ্পবীথির কথাই জানতে এসেছি।

গেল ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ থেকে আমরা বেশ কজন কবিতাকর্মী ও সাংবাদিক গিয়েছিলাম কলকাতার কবিতা উৎসবে। সাংবাদিকতা আমার পেশা। কিন্তু কবিতার সঙ্গে বসবাস তারও পূর্বে থেকে। আমার এই কাব্যবাতিক আমার বাবার খুব অপছন্দ। তবু প্রথম কাব্যগ্রন্থ আমি উৎসর্গ করেছিলাম বাবাকেই। বইটি উল্টেপাল্টে দেখে উৎসর্গের পাতায় চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়িয়েছিলেন, অস্বাভাবিকভাবে হেসে উঠেছিলেন এবং বলেছিলেন-তবু তুই ফার্স্ট হতে পারলিনে খোকা! এখানেও ফার্স্ট তোর অরুণকাকাই।

মানে? অরুণকাকার সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা কিসের?

বাবা তাঁর বাক্সের তলা থেকে অরুণ সান্যালের কাব্যগ্রন্থ বের করে উৎসর্গপত্র মেলে ধরে সগর্বে বলেন, এ কাজটা তোর আগে অরুণ কান্তি সান্যালই করেছে। আমি এ সবের যোগ্য নই, তবু সেই কবে প্রথম বইটি আমাকেই উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গপত্র থেকে চোখ ফেরাতে পারি না, চোখ ভিজে যায়। বাবার নামের নিচে অরুণকাকা লিখেছেন ‘মাটি বদল হলো, তোমার সঙ্গে জীবন বদল হলো না।’

কলকাতায় কবিতা পড়তে এসে প্রবীণ কবি অরুণ সান্যালকে আমি খুঁজে বের করে আমার প্রাণের প্রণতি জানাই। এ নাগাদ প্রকাশিত চারটি কাব্য তাঁর হাতে তুলে দিতেই আনন্দাপ্লুত হয়ে তিনি কেঁদে ফেলেন। বাবা আমাকে অনেক আগেই বলেছিলেন, তুই কবি হয়েছিস শুনিলে তোর অরুণকাকা খুব খুশি হবেন। আমি দেশে ফেরার পর অরুণকাকা বাঁকা বাঁকা স্বাক্ষরে আমাকে চিঠি লিখে আশীর্বাদ করেছেন, সঙ্গে একটা দায়িত্ব দিয়েছেন সুন্দরপুরে আমার পালিতকন্যা রেখে এসেছি। সেই কন্যা এখন কেমন আছে, একটু খোঁজ নিয়ে জানালে আমি এই শেষ বয়সে স্বস্তি পাব। আমার সেই কন্যার সঙ্গেও তোমার বিলক্ষণ পরিচয় আছে। তার নাম: পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতন।

দীর্ঘ তিন যুগ পর সুন্দরপুরে এসে যে তথ্য জানতে পারি তা হচ্ছে পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতনের নাম নিশানা পর্যন্ত নেই। ওই সম্পত্তি প্রথমে এনিমি প্রপার্টি হয়ে এখন কাগজপত্র উল্টেপাল্টে ইউপি চেয়ারম্যানের দখলে এসেছে। সুন্দরপুর এবং রতনপুরের মাঝখানে নতুন হাইস্কুল হয়েছে। তবে তার নাম পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতন নয়।

অরুণকান্তি সান্যালের পালিতকন্যা বলতে সুন্দরপুরের পুরাতন মানুষেরা পুষ্পবীথি বিদ্যানিকেতন নয়, পুষ্পলতা নামের মেয়েটির কথা মনে রেখেছে, যাকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরের মাধ্যমে মুসলমান করে ঘরসংসার পাতার আগেই বেশ কজন মিলে এক সঙ্গে বেইজ্জত করেছিল। পুষ্পলতার পেটের মেয়ে প্রীতিলতা, মায়ে জোর করে এই নাম রেখেছে; স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় থাকে। এই তো খানিক আগে বাড়ি এলো। গ্রামের মুরব্বি প্রস্তাব দেন, আমি চাইলে পুষ্পলতা কিংবা প্রীতিলতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব। জানতে চান আমি কি দেখা করতে চাই?

আমার খুব ভয় করে। অরুণকাকার চিঠির কী জবাব দেব আমি জানি না। আপাতত এক দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে অসুন্দর এই সুন্দরপুর থেকে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়