ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিশ্বসাহিত্যের ক্রমবিকাশ

কে এম আব্দুল মোমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২২, ১৩ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বসাহিত্যের ক্রমবিকাশ

কে এম আব্দুল মোমিন: সাধারণত, কোনো একক লিখিত কর্ম সাহিত্য হিসেবে গণ্য হয়। প্রকৃত অর্থে কোনো নির্দিষ্ট শিল্পসম্মতরূপে লেখা বা কোনো লেখার শিল্পসম্মত বা বুদ্ধিবৃত্তিক গুণ থাকলে তাকে সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাহিত্যে ভাষা প্রয়োগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে যা সাধারণ ভাষা থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভ করে।

সাহিত্যের ইংলিশ প্রতিশব্দ ‘লিটারেচার’ (literature) ল্যাটিন শব্দ ‘লিটারেচুরা’ (litteratura) থেকে উদ্ভুত। লিটারেচুরা এসেছে লেটার (letter) থেকে। লেটার অর্থ বর্ণ বা হস্তলিপি। ল্যাটিন ভাষায় লিটারেচার বলতে সব রকম লিখিত বিবরণকে বুঝানো হতো। অবশ্য তদানীন্তন সংজ্ঞায় যা বলা হয় বা গাওয়া হয় অর্থাৎ মৌখিক বিবরণও সাহিত্যরূপে গণ্য হয়। সাহিত্য বিষয়ে এ ধারণারও বিবর্তন ঘটেছে। আজকাল মৌখিক সাহিত্যের মধ্যে বিভিন্ন অলিখিত শিল্পরূপ প্রযুক্ত হয়েছে। সুতরাং সাহিত্যের মৌলিকতা সম্পর্কে লিখিত ও মৌখিকরূপের মধ্যে তুলনা করা জটিল হয়ে পড়েছে। মুদ্রণশিল্পের বিস্ময়কর অগ্রগতির ফলে বিপুল পরিমাণে লিখিত সাহিত্যের সৃষ্টি ও বিতরণ সম্ভব হয়েছে। অধিকন্তু, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, ট্যাব ও সেলফোনের মতো ডিজিটাল উপকরণের মাধ্যমে প্রাপ্ত ব্লগ ফিকশন, লিংকডইন, টুইটার, ফেসবুক জাতীয় ইলেকট্রনিক সাহিত্যও অবিশ্বাস্য গতিতে অগ্রসর হচ্ছে।

বিশ্বসাহিত্য বলতে সাধরণত বিভিন্ন দেশের জাতীয় সাহিত্যের সমাহারকে বোঝায়। বস্তুত কোনো সাহিত্য কর্ম দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করলে তাকে বিশ্বসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করা হয়। অতীতে প্রায়শ পশ্চিমা তথা ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রধান সাহিত্যকর্মগুলোকে বিশ্বসাহিত্য মনে করা হতো। পশ্চিমা সাহিত্য পরিচিতি লাভ করে ইউরোপীয় সাহিত্য হিসেবে। ইউরোপীয় ভাষায় পশ্চিমা সংস্কৃতিপুষ্ট এই সাহিত্য। এ সমস্ত ইউরোপীয় ভাষা বলতে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীকে বুঝানো হয়। তবে ভৌগলিক বা ঐতিহাসিক কারণে সম্পৃক্ত বাস্ক ও হাঙ্গেরীয় ভাষা এগুলোর সাথে যুক্ত। পশ্চিমা সভ্যতাকে কেন্দ্র করেই পশ্চিমা সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং উৎকৃষ্ট পশ্চিমা সাহিত্য হচ্ছে পশ্চিমা আদর্শ রীতিনীতি নির্ভর।

পশ্চিমা আদর্শ রীতিনীতির ধারক হচ্ছে পণ্ডিতদের স্বীকৃত বইপত্র, সঙ্গীত ও কলা। এগুলো পশ্চিমা সংস্কৃতিকে যেমন প্রভাবিত করে তেমনি গতিপথ প্রদর্শন করে। এ সমস্ত আদর্শ অনুসারে সাহিত্যকে কল্প-কাহিনী বা ফিকশন ও বাস্তব তথ্যভিত্তিক বিবরণ বা নন-ফিকশন দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। এগুলো আবার গদ্য ও কবিতা দুশ্রেণিতে বিভক্ত। প্রতিটি শ্রেণি পুনরায় নানা শ্রেনিতে বিভক্ত। বস্তুত, আদর্শ পশ্চিমা সাহিত্যের মধ্যে ফিকশন, নন-ফিকশন, কাব্য, নাটক, সঙ্গীত, কলা, ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকে প্রধান শিল্পসম্মত মেধা এবং ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার উন্নত সংস্কৃতি বিকাশের প্রতিনিধিরূপে বিবেচনা করা হয়।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক জন সিয়ার্ল বলেন, পশ্চিমা রীতিনীতিকে মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে একটি বিশেষ পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য যা সাহিত্য জগতে সক্রেটিস থেকে উইটজেনস্টিন এবং হোমার থেকে জেমস জয়েস পর্যন্ত বিস্তৃত। মধ্যপূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতিতে সৃষ্ট বাইবেল একটি শক্তিশালী প্রভাবক হিসেবে পশ্চিমা সংস্কৃতির রূপ দান করে এবং মানবচিন্তা, সাহিত্য ও কলা বিষয়ক ধারণায় উদ্বুদ্ধ করে অনেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনে সহায়তা করে।

অতীতে প্রায়শ পশ্চিমা তথা ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রধান সাহিত্যকর্মগুলোকে বিশ্বসাহিত্য মনে করা হলেও বর্তমানে বিশ্বসাহিত্যের পরিমণ্ডল বৃদ্ধি পেয়ে তা বিশ্বে বিস্তৃত হয়েছে। আধুনিক পাঠকসমাজ বিশ্বের অসংখ্য সাহিত্যকর্ম চমৎকার অনুবাদের মাধ্যমে হস্তগত করছে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে জাতীয় ঐতিহ্যের গণ্ডী পেরিয়ে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় শিল্পগুণ, রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে উৎসাহোদ্দীপক বিতর্ক শুরু হয়েছে।

জোহান উলফগ্যাঙ ভন গোথা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তাঁর প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধে বলেন, ইউরোপীয় সাহিত্যের পাশাপাশি নন-ওয়েস্টার্ন সাহিত্যকর্মও আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার ও গ্রহণের বিষয়টি ব্যক্ত করেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর শিষ্য জোহান পিটার একারম্যান এ সম্পর্কে গুরু-শিষ্যের একগুচ্ছ সংলাপ প্রকাশ করেন, তখন বিষয়টি আরও গুরুত্ব লাভ করে। গোথা ও একারম্যানের সংলাপে গোথা চাইনিজ উপন্যাস, পার্সিয়ান ও সার্বীয় কাব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁর অনুবাদ কর্মগুলো বিদেশে বিশেষত ফ্রান্সে ব্যাপক প্রশংসিত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি একারম্যানের নিকট ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, আসছে বছরগুলোতে বিশ্বসাহিত্য দেখা যাবে জাতীয় সাহিত্যগুলোকে অপসারণ করবে এবং সাহিত্য সৃষ্টির প্রধান ধারায় পরিণত হবে:

‘আমি নিশ্চিতভাবে মনে করি, কাব্য মানুষের বৈশ্বিক সম্পদ। সবখানে ও সবসময় শত শত মানুষের প্রকাশ।...আমি নিজেকেও বিদেশি জাতির মানুষ হিসেবে ভাবি। সবারই তা ভাবা উচিৎ। জাতীয় সাহিত্য এখন নিরর্থক পরিভাষা। আমরা বর্তমানে বিশ্বসাহিত্যের দ্বারপ্রান্তে। প্রত্যেকের উচিৎ বিশ্বসাহিত্যের দ্বার উন্মোচন করে ভিতরে প্রবেশ করা।’

কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টোতে বিশ্বসাহিত্যের অর্থনৈতিক বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বাণিজ্যিক বিনিময় প্রক্রিয়াকে বুর্জোয়া সাহিত্যিক উৎপাদনের বিশ্বজনীনরূপ হিসেবে বর্ণনা করেন। বলা হয়, ‘দেশজ উৎপাদন সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছুলে পুরাতন চাহিদার পরিবর্তে দূরদেশ ও অপরিচিত জলবায়ুতে উৎপাদিত পণ্যের প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে আমরা নতুন চাহিদা বোধ করি। ... এটা বস্তুগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় প্রকার পণ্যের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। স্বতন্ত্র জাতিগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টি হচ্ছে সাধারণ সম্পদ, যে সম্পদে সকলের অধিকার আছে। জাতির একদেশদর্শিতা ও সংকীর্ণতা ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অসংখ্য জাতীয় বা স্থানীয় সাহিত্য থেকে বিশ্বসাহিত্যের সৃষ্টি হচ্ছে।’

মার্টিন পাচনার বলেন, গোথা বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে গভীর ধারণা পোষণ করতেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সাহিত্যের জন্য একটি বিশ্ববাজার তৈরি হতে যাচ্ছে। এই বাজারের কথাই মার্ক্স ও এঙ্গেলস ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বলেছিলেন। কিন্তু তখনও তাঁরা মনে করতেন বুর্জোয়া পুঁজিপতিরা সাহিত্যবাজার সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা পুঁজিপতিদের এ ভূমিকাটিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেন এবং সাহিত্যবাজারের কল্যাণকর দিক বিবেচনা করে তা সম্প্রসারণের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। তাঁদের মেনিফেস্টোতে বিষয়টি উল্লেখ করেন, যা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করা হয়। মেনিফেস্টোর এ পাঠ ছিল নতুন ধরনের সাহিত্য এবং তা সফলও হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী পাঠ হিসেবে গণ্য হয়।

মার্ক্স ও এঞ্জেলস যখন গোথাকে অনুসরণ করে বিশ্বসাহিত্যকে আধুনিক এমন কী ভবিষ্যৎ বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে মনে করেন, আইরিশ পণ্ডিত এইচ এম পসনেট ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে বলেন যে, আধুনিক জাতীয় সাহিত্যের উত্থানের বহুপূর্বে বিশ্বসাহিত্যের উন্মেষ ঘটে প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে। বর্তমানে অবশ্য বিশ্বসাহিত্য বলতে সকল কালের চিরায়ত সাহিত্যকেই প্রধানত বুঝানো হয়ে থাকে। তবে সেই সাথে বিশ্ব পাঠক সমাজের উদ্দেশ্যে লিখিত সাম্প্রতিক কালে রচিত সাহিত্যও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষে বিশ্বের নানা প্রান্তের বুদ্ধিজীবীরা বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে সক্রীয়ভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন। তাঁরা এখন বিশ্বসাহিত্যকে জাতীয়সাহিত্যের আদলেই ভাবছেন। বিষয়টির ধারণা পাওয়া যায় লু জুনসহ চায়না’স মে ফোর্থ আন্দোলনকারীদের প্রগতিবাদী লেখকদের প্রবন্ধে।

উনবিংশ এমন কী বিংশ শতাব্দীতেও জাতীয়তাবাদের উচ্ছ্বাসে বিশ্বসাহিত্যের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আমেরিকায় বিশ্বসাহিত্যের পুনর্জাগরণ শুরু হয়। দেশটি প্রধানত অভিবাসীদের। অন্যান্য দেশের তুলনায় জাতীয় ঐতিহ্য নেই বললেই চলে। ফলে শুরু হয় তুলনামূলক ও বিশ্বসাহিত্য অধ্যয়নের, বিশেষত শিক্ষাস্তরের গ্রাজুয়েট পর্যায়ের প্রথম বছর সকলকেই অধ্যয়ন করতে হয়। প্রধানত দৃষ্টি দেওয়া হয় গ্রিক ও রোমান চিরায়ত সাহিত্যের প্রতি। এছাড়াও আধুনিক প্রধান প্রধান পশ্চিম ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোর সাহিত্য পড়ানো হয়। একই সঙ্গে উনিশশ’ আশির দশকের শেষ দিক থেকে উনিশশ’ নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত প্রধান প্রধান ঘটনাও পড়ানো হয়ে থাকে।

শীতলযুদ্ধশেষে বিশ্ব অর্থনীতিতে শুরু হয় বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমেরিকায় বিপুল হারে অভিভাসন চলতে থাকে। বিশ্বসাহিত্যের পাঠ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। সাহিত্য নির্বাচনে কিছু পরিবর্তন ঘটে। ব্যাখ্যাসহ প্রকাশ করা হয় ‘দ্য নর্টন অ্যান্থলজি অব দ্য ওয়ার্ল্ড মাস্টারপিসেস’ ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে। তবে এ সংগ্রহে স্থান পায় কেবল পশ্চিম ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকার সাহিত্যকর্ম। নতুন বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করা হয় ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে। এ সংস্করণটিতে কিছু নন-ওয়েস্টার্ন কিছু সাহিত্য স্থান পায়। বইটির শিরোনাম থেকে ‘মাস্টারপিসেস’ কথাটি বাদ দেওয়া হয়। এর পরিবর্তে ‘লিটারেচার’ শব্দটি যুক্ত হয়। বর্তমানে জরিপে দেখা যায়, নর্টন ছাড়াও লংম্যান ও বেডফোর্ডের অ্যান্থলজিগুলোতে অনেক দেশের শত শত লেখকের লিখা স্থান পেয়েছে।

বিশ্বসাহিত্যের নামে নানা দেশের সংস্কৃতি পাঠের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। জ্ঞানরাজ্যের বিভিন্ন শাখায় অধ্যয়নের অবারিত সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে। গবেষণা ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও ফলপ্রসু উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ডেভিড ড্যামরোস তাঁর ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত What Is World Literature? গ্রন্থে বলেন বিশ্বসাহিত্যে রীতিনীতি সম্পর্কিত বইয়ের চেয়ে বরং বিভিন্ন বইয়ের প্রচার ও গ্রহণ অধিক পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। তিনি প্রস্তাব করেন যে বিশ্বসাহিত্যে নন্দিত বইয়ের অনুবাদের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে উপকারিতা পাওয়া যেতে পারে। ড্যামরোসের প্রস্তাব অবশ্য ব্যক্তিগত সাহিত্যকর্মের নিবিড় পাঠের দিকেই কেন্দ্রিভূত থাকে। অপরদিকে স্ট্যানফোর্ডের সমালোচক ফ্র্যাঙ্কো মোরেটি দুটি প্রবন্ধে বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন বিশ্বসাহিত্যের মানদণ্ড সনাতন পদ্ধতিতে নিবিড় পাঠের চেয়ে অনেক উঁচুতে। তিনি বরং বলেন দূরপাঠের কথা, যার মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক পাঠক পাঠ করতে পারে এবং মুদ্রণ হিসাব ও জাতীয় ইতিহাসের বাইরে থাকে। যেমন উপন্যাস বা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বপরিমণ্ডলে তাদেরকে শনাক্ত করা যেতে পারে।

মরেটির পদ্ধতি অনুসারে বিবর্তনবাদের তাত্ত্বিক উপাদানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পদ্ধতির বিশ্লেষণ করা। এ পদ্ধতি শুরু করেন ইমানুয়েল ওয়ালারস্টিন। পরবর্তীতে এমিলি অ্যাপ্টার তাঁর বিখ্যাত The Translation Zone গ্রন্থে এ সম্পর্কে আলোচনা করেন। আন্তর্জাতিক পদ্ধতি সম্পর্কে ফ্রেঞ্চ সমালোচক পাস্কেল ক্যাসানোভা তাঁর La République mondiale des lettres (১৯৯৯) গ্রন্থেও আলোচনা করেন। সমাজতত্ত্ববিদ পিয়ারে বুর্ডিউএর সাংস্কৃতিক তত্ত্বের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন প্রান্তীয় লেখকদেরও কেন্দ্রীয়ভাবে প্রচার হওয়া প্রয়োজন যেন তাঁরা বিশ্বসাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন। মরেটি ও ক্যাসানোভা বিশ্বসাহিত্যের অসম সাহিত্যক্ষেত্রের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। মরেটি বলেন, এ ক্ষেত্রটি অভিন্ন কিন্তু অসম।

বিশ্বসাহিত্যের ক্ষেত্র নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। সমালোচকদের মধ্যে গায়ত্রি চক্রবর্তী স্পিভক বলেন, প্রায়শ অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্য পাঠের মাধ্যমে মূল ভাষার যেমন সমৃদ্ধি আসে তেমনি রাজনৈতিক শক্তিগুলো মূল পরিবেশের আলোকে কাজ করতে পারেন। অপরদিকে অন্যান্য পণ্ডিতগণ জোর দিয়ে বলেন যে মূল ভাষা ও পরিবেশে বিশ্বসাহিত্য গভীর মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করা উচিৎ যেন তা বিদেশিদের নিকট নতুন অর্থবহ দিক উন্মোচন করতে পারে। এক সময় এ সাহিত্য ছিল ইউরোপীয় সাহিত্য। এখন তা বিশ্বসাহিত্য হিসেবে সক্রীয়ভাবে পাঠ করা হয়। বিশ্বসাহিত্য এখন প্রকৃত অর্থে বিশ্বসাহিত্যে পরিণত হয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বসাহিত্যের সিরিজ এখন চায়না থেকে এস্টোনিয়া পর্যন্ত সবখানে প্রকাশিত হয়। বিশ্বসাহিত্য এখন একটি নতুন প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান থেকে সামার সেশনে মাসব্যাপী বিভিন্ন প্রকার তাত্ত্বিক ও শিক্ষাদান ভিত্তিক কর্মসূচির আয়োজন করে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পরবর্তী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ইস্টানবুল বিলজি ইউনিভার্সিটিতে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসের বস্তুগত পাঠের শুভসূচনা হয়েছে। সেই সাথে চলছে সাম্প্রতিক বিতর্ক। সৃষ্টি হচ্ছে অনেক মূল্যবান প্রবন্ধ ও গ্রন্থ।

দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব বিভিন্নভাবে বিশ্বব্যাপী বিশ্বসাহিত্য প্রচারের যুক্তিসঙ্গত মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। সারা দুনিয়ার সকল পাঠকের নিকট বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন উপকরণ। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ওয়ার্ডস উইদাউট বর্ডার্স সরবরাহ করছে প্রচুরসংখ্যক নির্বাচিত উপন্যাস ও কাব্য। অ্যানেনবার্গ ফাউন্ডেশন তৈরি করেছে উচ্চাভিলাষী ১৩টি ডিভিডি/ওয়েব সিরিজ। এটা প্রযোজনা করেছে বোস্টনের পাবলিক টেলিভিশন স্টেশন WGBH. নাম দিয়েছে ‘ইনভাইটেশন টু ওয়ার্ল্ড লিটারেচার’। বিভিন্ন জরিপ অ্যান্থলজিগুলোর রয়েছে বিস্তৃত ওয়েবসাইট। পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর পটভূমির তথ্য, ছবি, অনেক লেখকের লিংক।

পরিশেষে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকদের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। আরও বাড়ছে তাঁদের ইন্টারনেটভিত্তিক কর্মকাণ্ড। সার্বিয়ার বিশেষজ্ঞ মিলোর‌্যাড প্যাভিক (১৯২৯-২০০৯) ইলেক্ট্রোনিক মোডে সাহিত্য সৃষ্টি ও ওয়েবসাইটে পাঠের সুযোগের অমিত সম্ভাবনার প্রবক্তা ছিলেন। যদিও তিনি মূলত মুদ্রণভিত্তিক লেখক ছিলেন, দ্য কোরিয়ান/অ্যামারিকান ডুয়ো পরিচিত ইয়ং-হে চ্যাং হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ তাদের সকল সৃষ্টি ইন্টারনেটে সরবরাহ করার জন্য করে থাকে। আর তারা করে থাকে প্রায়ই বেশ কয়েকটা ভাষায়।

বিশ্বসাহিত্য বর্তমানে জাতীয় সাহিত্যগুলোর সাথে সমন্বয় করে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। ছোট দেশগুলোর লেখকদের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে অগণিত দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের মান বজায় রাখতে হবে। মানবজাতির কল্যাণের স্বার্থে প্রতিটি সাহিত্যকর্মের শৈল্পিক মূল্য ও মর্যাদা বজায় রাখতে হবে। তবেই বিশ্বসাহিত্যের যথার্থ অগ্রগতি সাধিত হবে। কী ধরনের সাহিত্যকর্ম বিশ্বসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হবে তার মান নির্ধারণ করা সহজ নয়। কারণ ব্যক্তিপর্যায়ে রচিত সাহিত্যকর্ম বিবেচিত ও মূল্যায়িত হয়ে থাকে সাধারণত সংশ্লিষ্ট সময় ও অঞ্চল ভিত্তিতে।

লেখক: রেজিস্ট্রার, রাজশাহী সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, নাটোর




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়