ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শাহ্‌নাজ মুন্নীর গল্প || প্রতারিত প্রেমিকারা

শাহ্‌নাজ মুন্নী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ৩১ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শাহ্‌নাজ মুন্নীর গল্প || প্রতারিত প্রেমিকারা

বৈশাখ এসেছে বুঝি, আমাদের দেশে? উজ্জ্বল রোদ, ঝড়ের দাপট আর উৎসবের আলো নিয়ে? অথচ দেখো আমাদের এই বাড়িটার জানালায় সারাক্ষণ মিহি পর্দার মতো ধূসর বিষাদের ঝিরিঝিরি কুয়াশা ঝুলে থাকে।

‘ওগুলো কুয়াশা নারে, ও তোদের দীর্ঘশ্বাস, তোদের কান্না, আর তোদের অনিঃশেষ হা হুতাশ।’  

আমাদের ভুল শুধরে দিয়ে বলেন প্রাচীন দ্বার রক্ষকেরা।

আমরা যারা এই বাড়িতে থাকি তাদের সবার চোখেই সারাক্ষণ মেঘের মতো কষ্ট জমে থাকে, আঁধার হয়ে দুঃখ জমে থাকে। আমাদের নিদ্রা নেই, স্বপ্ন নেই, পরিত্রাণ নেই। আমাদের সম্মিলিত হাহাকারে এ বাড়ির বিহ্বল বাতাস ভারী হয়ে থাকে। এখানে সবসময় সূর্যাস্ত, সবসময় রোদ্রহীন, স্যাঁতসেঁতে কালো আকাশ। এ বাড়ির দেয়ালজুড়ে ভেজা ভেজা নোনাধরা অভিশপ্ত গন্ধ। খ্রিস্টপূর্ব কত হাজার বছর আগে বুক ভরা অভিমান নিয়ে এক মায়াময় বোকা বালিকা স্বেচ্ছায় মরণের মালা গলায় পড়ে এ বাড়ির প্রথম বাসিন্দা হয়েছিলেন কে জানে! তিনি চির বালিকা হয়েও আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ, তার বসন্তগুলোও বহু বহু দিন ধরে মলিন আর এক রঙা। কোকিলের কুহুতানবিহীন। এমন আরো কত শত জন যে আছেন এখানে, যারা সাঙ্ঘাতিক অভিমানে, গভীরতম বিষাদে মগ্ন হয়ে জীবনের সাথে সমস্ত সংযোগ নিজ হাতে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। 

তাদের মতোই, এ বাড়িতে প্রতিদিনই পৃথিবীর যাবতীয় লেনা দেনা চুকিয়ে কেউ না কেউ আসতেই থাকেন। দ্বার রক্ষকেরা বার্তা দিয়ে গেলে বয়োজ্যেষ্ঠরা চেঁচিয়ে আমাদের জানান দেন, ‘ওই আসতেছে রে আরেকজন, আত্মঘাতী নারীদের তালিকায় লিখে রাখ তার নাম। দেখ্‌ ওর গলায় কীভাবে আটকে আছে বিষ টোপ, দেখ ওর গলায় কতটা গভীর হয়ে বসেছে ফাঁসীর নীল দাগ, দেখ ওর গায়ের উপর দিয়ে কীভাবে চলে গেছে রেলের ধাতব চাকা, ওরে আয়, তোরা ডেকে নে এই নবীনারে, আহ হা হা হা, আয় আমরা সজোরে রোদন করি। প্রিয় মানুষের দেয়া আঘাতের বেদনায়, আয় বোন আমরা কাতর হয়ে কাঁদি, আমাদের পায়ের নিচে ছিল চোরাবালি, আর সেই বালিতে আমরা তো স্বেচ্ছায় ডুবেছি। আয় বোন আয়, হাত ধরাধরি করে কাঁদি, আয় বোন আয় জড়াজড়ি করে কাঁদি, আর ঝুলে থাকি স্বর্গ ও নরকের মাঝখানে এই বাড়িতে। এই বাড়ির নাম প্রেম, এই বাড়ির নাম আত্মহনন।’

সদ্য আসা সেই নবীনা তখনো থাকে আত্মধংসের ঘোরে, আর কোনদিন পুরনো পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে না জেনেও সহসা ফেলে আসা জীবনের মায়া’য় ঘুরপাক খায়। ফলে সে আর্তস্বরে বিলাপ করে বলে, ‘প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করেছে আমাকে। আমার সর্বস্ব লুটে নিয়ে আমাকে সর্বশ্বান্ত  করেছে। যাকে ভালোবাসা ভেবেছি সেগুলো আসলে হালকা আবেগ ছাড়া কিছুই ছিল না। আমি বুঝিনি, সে ছিল অনেকের মতোই সুবিধাবাদী, মিথ্যুক, লম্পট আর ভণ্ড...’ 

‘ওরে নবীনা, থাম্‌ সখী থাম। আমাদের সবার গল্প তো একটাই, নতুন করে তুই আর কি-ই বা বলবি? আমরা তো সকাল সন্ধ্যা সম্মিলিত কণ্ঠে একই গল্প বলে যাই। আমরা সবাই হৃদয় উজাড় করে সব ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়ে ভিখারি হয়েই তো এখানে এসেছি। আমরা কূলহারা কলঙ্কিনী, আমরা দিকহারা পাতকিনী। আমরা অনন্য আমরা তুলনাহীন। পৃথিবীতে প্রতিদিন কত মানুষের মন ভাঙে, ঘর ভাঙে, কত মানুষের সম্পর্ক ভাঙে, সবাই কী আর আমাদের মতো আত্মঘাতীত হয়?’

‘আমরা তো ভালোই ছিলাম, নিজেদের আপন ভুবনে আত্মহারা, তবে সর্বনাশা প্রেম কেন আমাদের এত দুর্বল, এত ক্ষুদ্র, এত অসহায়, এত বিপন্ন করে? কেন অসহ্য যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হলো আমাদের হৃদয়, হায়, রাজপুত্র তুমি প্রেমিকের ছদ্মবেশে এসেছিলে নীরব ঘাতক, হায় তুমি এসেছিলে শীতল দিঘীর ছদ্মবেশে জ্বলন্ত আগুন, তোমাতে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিয়ে আমরা পুড়ে মরেছি। আমরা প্রতারিত প্রেমিকার দল, যারা বেছে নিয়েছি স্বেচ্ছামৃত্যু।’

‘আমার সুখী হওয়ার একমাত্র চাবিটি রেখেছিলাম তার পকেটে, তার হাসি, তার গান, তার কথা, তার স্পর্শ ... আহা যেন জগতে কানু বিনে গীত নাই, রাধিকার ভীরু বুকে অহেতুক কে দিয়েছিল গো নিশি ডাক। সে বিনে মোর শূন্য বাসর, সে বিনে আমি জীয়ন্তে মরা ... 

হায়, এখন মনে হয়, বেকুব মাছের মতো সুখ টোপের প্রলোভনে গিলে ফেলেছিলাম শিকারির বড়শি, সেই শিকারি ইচ্ছামতো খেলেছে আমাকে নিয়ে, তার হাতে রাখা রঙিন সুতোর টানে প্রেমের নদীতে অহেতুক ছুটে বেড়িয়েছি, হাবুডুবু খেয়েছি। হ্যাঁ, সেও তো এক সুখ ছিল, যদিও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী, যদিও তা ছিল মিথ্যে মায়া। এখন সেই সুখের প্রায়শ্চিত্ত করছি সিলিং ফ্যানের সাথে শাড়ির আঁচল বেঁধে, আমরা মরেছি হতভাগী, আমরা ডুবেছি।’

আহা তার দেয়া সেই অপমান সইতে পারিনি গো আমরা। সইতে পারিনি প্রেমিকের অবহেলা। তার উপেক্ষার আগুনে পুড়ে পুড়ে শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে চিতার আগুন আর এমন কী পোড়াবে আমায়? বড় বাড়ির উপযুক্ত বউ হতে পারিনি আমি, ছিলাম নিঃসঙ্গ, ছিলাম অসহায়। দমবন্ধ অন্ধকার ঘরে চকিত আলোর মতো এসেছিল সে। যখন অবসাদে ভেঙে পড়েছিল মন, যখন চারিদিকে ছিল অন্ধকার তখন তার আলোকচ্ছটার উপর নির্ভর করেছিলাম। শুধু তাকেই ভালোবেসে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা হয়েছিল। তার আর আমার সেই সম্পর্ক ছিল গোপন, একে প্রকাশ্যে আনতে চায়নি সে। তার হৃদয় নিংড়ানো সাজানো কথায় আমি ভুলেছিলাম আপন-পর, ভুলেছিলাম মান-অপমান, সব। কিন্তু একসময় যখন সেও আমাকে ভুলে সরে গেল দূরে, তখন বেঁচে থাকার ইচ্ছেগুলোও এক এক করে শেষ হয়ে গেল। বসন্ত না ফুরাতেই যেন শীত নেমে এল। বেলা না যেতেই যেন ঘুঁচে গেল সব খেলা। ২৫ বছর বয়সে আফিম আমাকে পৌঁছে দিল এই শান্তিময় ঘুমের রাজ্যে, এই বাড়িতে, আরো সব অতৃপ্ত সখীদের সাথে। যাদের সবার গল্পই এক, যারা সবাই এসে পৌঁছেছি এই অপেক্ষার ষ্টেশনে। যারা দিন রাত্রি নিজেদের কষ্টের গান গাই সমবেত কণ্ঠে, একই সুরে, একই কথায়। কত বছর গেল? একশ তিরিশ বছর চলে গেছে? এক হাজার, এক লাখ, এক কোটি তিরিশ বছর? এখনো কি কোমলাঙ্গি নারীরা ঝলসে যায় প্রতারণার আগুনে? এখনো তারা ভোলে তবে মায়ার ছলনায়? প্রেম ও বাসনার কুহকী মায়ায় তারা কি এখনো মৃত্যময় আচ্ছন্নতায় ভেসে যায়? ভাঙন আর বিচ্ছেদের যন্ত্রণা এখনো কি আকুল করে জগতের সরলা জটিলা তাবৎ নারীদের?

‘টুক, টুক, টুক, জেগে আছো?’

রাত দুপুরে হৃদয়ের দরজায় তাদের চুপি চুপি কড়া নাড়া।

‘তুমিও কী আমার মতো একা? তুমিও কি তৃষিত আমারই মতো?’

তাদের প্রশ্নের সামান্য টোকায় আমাদের ভঙ্গুর মন ঝরঝর করে ভেঙে পড়ে। ভেঙে পড়ে সব বাঁধ, ভেঙে পড়ে সব সংযম। কাঙাল হৃদয় নিয়ন্ত্রণ হারায়। 

‘ভালোবাসাহীনতা থেকে তোমার কাছে পালিয়ে আসি হে প্রেম। যদি ভালোবাসা নাই থাকে, শুধু একা একা লাগে, কোথায় শান্তি পাবো কোথায় গিয়ে, বলো কোথায় গিয়ে?’

‘আমাকে সুস্থ করো তোমার ছোঁয়ায়, আলিঙ্গনে, চুম্বনে, চুম্বনে...’

এলোমেলো হয়ে যায় ভাবনা। ছিড়ে যায় চিন্তার সূতা। বাতাসে কারা যেন বলে যায় তারা খুব ভালোবাসে, আকাশে কারা যেন লিখে যায় বিরহ অভিমান। যমুনার ঢেউ তাদের নিয়ে যায় এক নদী থেকে অন্য নদীতে। বিশ্বাস থেকে অবিশ্বাসের সাগরে। তারপর ধীরে ধীরে ভালোবাসা ম্লান হয়ে আসে, ঘন ঘোর ক্লান্তি নেমে আসে, তারপর স্তব্ধতা, সব শেষে থৈ থৈ অপরিসীম শূন্যতা। হায়, এক সময় আমাদের বেঁচে থাকার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। আত্মহনন ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকে না সামনে। মৃত্যুকামী বাতাস একান্তে ডাক দিয়ে যায়। কোথায় বিষপাত্র, কোথায় জমিয়ে রাখা ঘুমের ওষুধ? এসো, পান করি নিজেরই রক্ত। কম্পিত আঙুলে রক্ত দিয়ে লিখি সুইসাইডাল নোট। ‘আমার মৃত্যুর জন্য শুধু আমিই দায়ী।’ অথবা ‘দায়ী এই দু’কূল ভাসানো অপরিণামদর্শী প্রেম’। 

এক সুন্দর ভোরে মৃত্যুর হাতছানি একটা পেঁচার তীক্ষ্ম নখরের মতো চেপে ধরেছিল তাকে,  সংকুচিত করেছিল তার হৃদয়। ‘কেউ কি আছো কোথাও, যে আমাকে একটু বুঝতে পারো, যে আমাকে একটু ভালোবাসো’ তার মন চিৎকার করেছিল। তার মনে হচ্ছিলো, ভালোবাসায় সে অন্ধ হয়ে গিয়েছে। সন্তানদের অন্য একটা ঘরে রেখে নীরবে নিজে চলে এসেছিলেন রান্না ঘরে। হাঁটু গেড়ে বসলেন ওভেনের সামনে। ছেড়ে দিলেন গ্যাস। প্রথমবার অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় আর বিফল হননি। বললেন, আমি নিজেকে হত্যা করতে চাই। পালাতে চাই দায় দায়িত্ব থেকে। মাতৃজঠরের নিরাপদ নিশ্চিন্ত অন্ধকার তরলে, ফিরে যেতে চাই শোচনীয় হামাগুড়ি দিয়ে। বয়স তিরিশ না পেরুতেই তিনি কাঠের কফিনে শুয়ে চলে এলেন এই বিমর্ষ বাড়ির বাসিন্দা হতে। আমরা এখন কবিতার সুরে মৃত্যুগীত গাই। ‘পৃথিবীর বুকে মরে গেছে ভালোবাসার পিদিম। বাতাসের কান্নায় লেগে আছে বিরহের দাগ... ভালোবাসার করুণ মৃত্যুর মুখে, পৃথিবীও নুইয়ে পড়েছে অপেক্ষায়, ক্লান্তিতে, ব্যাথায়...’ বিষণ্নতার কালো ছায়া আমাদের ঘিরে নৃত্য করে।

আমাদের বাড়িটি আরো শীতল, আরো গাঢ় বিষাদাচ্ছন্ন হয়, যখন মায়াবী চোখের একটি অল্পবয়সী মেয়ে এসে যোগ দেয় আমাদের সাথে। সে বুক ভর্তি হাহাকার নিয়ে জানায়, সহবাস শেষে তাকে একা ফেলে রেখে প্রেমিক চলে গেছে অন্য নারীর কাছে। প্রেমহীন সন্ধ্যায় অখ- নিস্তব্ধতা আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিল সে, অজস্র অতৃপ্ত রাত্রির দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে, প্রচ- অবহেলায় বোবা পৃথিবীতে বেঁচে ছিল সে। ওরকম শব্দহীন জীবন্মৃত নিস্তরঙ্গ ঢেউয়ের মতো জীবন নিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় বেঁচে থাকাটাই ছিল আসলে অর্থহীন। ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে নিজেকে উদ্দাম বাতাসের বুকে ছেড়ে দিয়ে এ বাড়ির স্থবির সদস্য হয়েছে সে। চোখের সামনে নেমেছে পর্দা। মৃত্যুর হিম ঘুম চোখে এখন আত্মধংসের আনন্দে খলখল করে হাসে সে, হাসে প্রেতিনীর অশরীরি বিনাশী হাসি, আমাদের নির্জন বাড়িতে সেই ভয়ানক হাসি দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসে। আমরা বিকৃত মুখে কান্নার মতো করে সেই সম্মিলিত হাসিতে যোগ দেই, হাসি আর কাঁদি, কাঁদতে কাঁদতে হাসি, হাসতে হাসতে কাঁদি। গলা জড়িয়ে ধরে বলি, ‘ওরে তুই একা নোস। এ কষ্ট তোর একার নয়, এ আমাদের সবার কষ্ট...’

মৃত্যুর স্বাদ পেতে সাগরতটে ঝাঁক বেঁধে যেমন আসে পথভোলা নীল তিমির দল, যেমন চিরকালের মতো আটকে যায় সৈকতের ঝুরঝুরে বালিতে, তেমনি প্রেমে উদভ্রান্ত নারীদের দল ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ভরিয়ে দেয় এ বাড়ির প্রতিটি অন্ধকার বিষণ্ন কোণ।     

তবু প্রতিদিনই দ্বার রক্ষকদের উচ্চ কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পাই, ‘হুশিয়ার, সাবধান, আত্মহননের পথ ধরে সীমানার কাছাকাছি আসছে আরেকটি আধ পোড়া আত্মা, উড়ছে তার প্রাণ, উড়ছে অভিমান...’           

আমরা দেখি, জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি একটি স্নিগ্ধ মুখ বেদনার নীল হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে মৃত্যুর স্বরলিপি। তার চোখে দিন শেষের আঁধার। কাঙ্খিত শিকার পেয়ে হিংস্র হাসি হাসছে অগ্নি দেবতা, পুড়িয়ে দিচ্ছে সজীবতা, জ্বালিয়ে দিচ্ছে কোমলতা। বয়োজ্যেষ্ঠরা হতাশায় কপাল চাপড়ান। বলেন, ‘ওরে পোড়ামুখি, কোন পরাণে নিজের গায়ে তুই নিজেই আগুন দিলি?’

মুমূর্ষার আত্মা যন্ত্রণায় কাতরায়, ‘আগুন কি পোড়াবে আমায়? একাকী দহনে আমি তো আগেই পুড়ে ছাই, আমি নিঃস্ব, পত্রহীন বৃক্ষ, সে আমারে উপেক্ষা করে, আমাওে শূন্য করে কই চলে যায়, বলো, কার কাছে যায়...’

হায়, এই শূন্যতা তো আমাদের প্রত্যেকেরই। হয়তোবা আমরা ছিলাম নিরুপায়, হয়তোবা এটাই ছিল নিয়তির পরিহাস। ধারাবাহিক হতাশা, ব্যর্থতা ও অপমানের ইতিহাস আমাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। চারিদিকের বঞ্চনা আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে আমাদের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলো। হায়রে সংসার! তোর প্রতিও আস্থা হারালাম, নিজের প্রতিও আস্থা হারালাম, যখন ডুবে গেল পঞ্চমীর চাঁদ মরিবার হলো তার সাধ। সবাই দেখলো, মশারির ভেতরে শান্ত হয়ে শুয়ে আছেন তিনি। তার একটি হাত ছিল অন্য হাতের উপর। পাশের টেবিলে সব কিছু সাজানো গোছানো, পরিপাটি। মনে হচ্ছিলো, তিনি ঘুমাচ্ছেন, শুধু মুখের পাশে ফেনা ও রক্ত বেরিয়ে আসার মতো একটা কালো কষ্টের দাগ যেন বলছিলো সব কিছু স্বাভবিক নয়। আহা, ‘এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি! রক্তফেনা মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুজি...’। তার কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হলো কীটনাশকের বোতল ও একটি সুইসাইড নোট। ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক, মানসিক চাপের কারণে আত্মহত্যা করলাম।’ না, কেউ পাশে ছিল না আপনার। সম্পূর্ণ একা হয়ে, সম্পূর্ণ আশাহীন, উপায়হীন হয়ে আপনি একটা হত্যাকা- ঘটালেন। নিজেকে হত্যা করে সঁপে দিলেন মৃত্যুর হাতে। এখন আসুন আমরা মৃত্যু উদযাপন করি। আসুন বুকের মাঝে পুষে রাখা গোপন কষ্টগুলো এই বাড়িতে জমা হওয়া দুঃখ জোয়ারের জল স্রোতে ভাসিয়ে দেই।

‘অপবাদ দিছিলো গো পাড়ার লোকজন, খারাপ কথা কইছিলো গেরামের মানুষ। তাও না হয় সহ্য হইত, কিন্তু যখন দেখি চিরকাল ভালোবাইস্যা কাছে থাকার কথা দিছিলো যেইজন,  সেইজনও এক লহমায় অস্বীকার গেল সব, স্বপ্ন দেখায়া আবার সেই স্বপ্ন কাইড়া নিল। আমারে হিং¯্র বাঘের মুখে ফালায়া রাইখা নিজে পলাইলো, তখন সব হারানো মানুষ আমি কার কাছে গিয়া দাঁড়াই ? কার বুকে মাথা রাখি? গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া আর কি উপায় থাকে আমার? ওগো গাছ, তোমার কঠিন শাখায় আমারে ঝুলতে দেও। 

এমনই হয় গো তখন, কোন পিছুটানই আর বাঁধতে পারে না। পাশে শুয়ে থাকা নিজের শিশুদের মুখও আর মনে পড়ে না। জীবনের রূপ, রস, গন্ধের কোনো স্মৃতি থাকে না। নিজের চাওয়া, আর নিজের না-পাওয়ারেই বড় মনে হয়। বড় মনে হয় নিজের প্রবঞ্চনারে। পৃথিবীরে মনে হয় নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, পাষাণ। বাঁইচ্যা থাকার কোনো কারণই খুঁইজ্যা পাওন যায় না। অথচ কেউ যদি একবার বুঝায়া দিত যে কারণে মরলাম, তা কত তুচ্ছ ছিল। যদি কেউ একবার হাত ধইরা শুনাইত কিছু কথা, যদি একটু আশ্বস্ত করত, মাথায় রাখত হাত, কইতো- ‘আছি, তোমার পাশে আছি’।

ও বিষণ্ন সখী, ও ঝরা বকুল ফুল, আর বলো না। কেননা, এ সর্বনাশা গল্পের তো শুরু নাই, শেষও নাই। আদি নাই অন্ত নাই। শুধু ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি আছে। শুধু একই বৃত্তে অশরীরী আত্মাদের স্মৃতির জানালায় ঘুরপাক খাওয়া আছে। মৃত্যু পান করে আসা নারীদের আত্মারা কেউ-ই এখানে ঘুমায় না, এখানে কেউ জেগেও থাকে না। সকলেই শূন্যতার বর্ণহীন সাগরে সাঁতার কাটে। ঝরা পাতাদের মতো গন্তব্যহীন উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, অনুশোচনায় কাঁদে, কেউ কেউ পুনর্বার বেঁচে উঠতে চায়, আরেকবার জীবনের কাছে ফিরে গিয়ে পুরাতন ভুলগুলো শুধরে নিতে চায়। কিন্তু হায়, তারা জানে না, যেখানে তারা স্বেচ্ছায় এসেছে, সেখান থেকে ফেরার পথ নেই, উপশমের কোনো উপায় নেই, এই ঘুর্ণায়মান সময়ের কোনো সমাপ্তি নেই, এই ভাসমান অবস্থা থেকে তাদের কারুরই ক্ষমা নেই, মুক্তি নেই, পরিত্রাণ নেই। তাদের করুণ ধূসর দীর্ঘশ্বাসগুলো, অশ্রু আর হাহাকারগুলো, উপেক্ষা আর অপমানের স্মৃতিগুলো বাতাসের সাথে মিশে মহাশূন্যে বেদনার নীরব ফুল ফোটাতে থাকে। পৃথিবীর মানুষ হয়তো সেগুলোকে ‘তারা’ বলে ভুল করে।    

বন্ধুগণ, এই কুয়াশা বাড়ির বাসিন্দাদের একঘেয়ে শীতলতার গল্প অনেক তো হলো... তারচে’ চলুন, আজ এই গল্প শেষ করি একটি উজ্জ্বল দিনের স্বপ্ন দিয়ে, স্বপ্নটি হতে পারে এমন যে, একদিন কোনো এক হীরন্ময় মুহূর্তে এই অভিশপ্ত  বাড়িটি এবং এ বাড়ির বাসিন্দারা শুধু জীবনেরই আকাঙ্ক্ষা করে আর বন্ধ করে দেয় এখানে প্রবেশের সমস্ত দরজা। তবু আহত, প্রতারিত, অভিমানী আত্মারা এসে করাঘাত করে এই দরজায়। আর্তনাদ করে-

‘খোল, আমাকে আশ্রয় দাও। আমি নিজের কবর খোঁড়ার অবিরাম শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমার পুড়ে যাওয়া মনের গন্ধ পাচ্ছি। আমি এক ব্যর্থ আত্মা। আমাকে প্রবেশ করতে দাও। আমাকে গ্রহণ করো।’

কিন্তু শত কান্নাতেও দরজা খোলে না, দরজার কপাট থাকে অনড় নিশ্চল। দ্বার রক্ষকেরা সমবেত কণ্ঠে বলেন, ‘ফিরে যাও। তোমাকে যে ফিরতেই হবে। জীবন তোমারই। জীবনের অনন্ত স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দাও।’

‘না গো, ক্ষমা করো। আমার সর্বাঙ্গে লেগে আছে অসহনীয় লজ্জা ও অপমানের গ্লানি। জীবন আমাকে দেয়নি কিছুই শুধু প্রতারণা ছাড়া... আশাহীন, স্বপ্নহীন এই ব্যর্থ জীবন যাপনের যোগ্য নয়। এ দুঃসহ, দূর্বিসহ ...’ 

‘জীবনের প্রতি অভিযোগ করো না। না পাওয়ার কাহিনীকে কখনোই এতো বড় করে দেখো না। সব অপমান ও অবজ্ঞার উর্ধ্বে ওঠো নারী। খুঁজে নাও বেঁচে থাকার আলোয় উদ্ভাসিত জীবনের অনন্ত যাত্রাপথ। তোমার পৃথিবী অনেক সুন্দর। শুধু চোখ মেলো, শুধু খুঁজে দেখো কুয়াশার ভেতর থেকে নেমে আসবে অপরূপ আলো। বেঁচে ওঠো। জেগে ওঠো। আরেকবার  স্বপ্ন দেখো। হাসো। বাঁচো...’

তখন হেমন্তের ভোরে হাসপাতালের মলিন জানালা ভেদ করে কোথা থেকে এক টুকরো উজ্জ্বল স্নিগ্ধ  আলো এসে পড়ে। আর মৃত্যুকাঙ্ক্ষী বিবর্ণ নারীটি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। সেই চোখে গভীর মায়ার ছায়া। দূর মহাকাল থেকে ভেসে আসে অচেনা কোনো বাদ্যযন্ত্রের মিষ্টি সুরেলা ধ্বনী। মৃত্যু তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে, এবার জীবন তাকে দুহাত মেলে গ্রহণ করুক, স্নেহ ভরে বুকে টেনে নিক, নিয়ে যাক্‌  সামনে, অফুরান প্রাণের দিকে, আলোর দিকে। ওর জীবনে বৈশাখ আসুক। উজ্জ্বল রোদ, ঝড়ের দাপট আর উৎসবের আলো নিয়ে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মার্চ ২০১৮/তারা   

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়