ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বৈশাখের স্মৃতিগদ্য || হাসান আজিজুল হক

হাসান আজিজুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৩, ১৫ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৈশাখের স্মৃতিগদ্য || হাসান আজিজুল হক

হাসান আজিজুল হক, ছবি : মোহাম্মদ আসাদ

|| পয়লা বৈশাখ উদযাপনে আরও পরিবর্তন হবে ||

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম যবগ্রাম। সেখানেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছেলেবেলার বৈশাখের স্মৃতি বলতে সেই গ্রামের স্মৃতিই আমার প্রথমে মনে পড়ে। আমাদের গ্রামে মুসলিম পরিবার ছিল সব মিলিয়ে দশ থেকে বারোটি। বাকি সবই হিন্দু পরিবার। তারা একই বর্ণের ছিল না যদিও; নানা বর্ণের হিন্দু। পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমাদের গ্রামে খুব একটা উৎসব হতো এমন নয়। বৈশাখের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকার মতো অবস্থা আমাদের ছেলেবেলায় ছিল না- সেটা আমি এখন দেখতে পাচ্ছি।

আমাদের বেলায় যা হতো, একত্রিশে চৈত্র এবং পয়লা বৈশাখে আমাদের পাশের গ্রামে এক দেবীর পীঠস্থান ছিল। আমরা বলতাম যুগান্ত দেবীর (দুর্গারই আরেক রূপ) পীঠস্থান। সেই পীঠস্থানে মাসব্যাপী মেলা হতো। আমরা সাধারণত বৈশাখের প্রথম দিন ওই মেলায় যেতাম। সেদিন ভিড় বেশি; জাঁকজমক বেশি হতো। কাজেই আমরা নিজেদের গ্রাম পাড়ি দিয়ে ওই গ্রামের মেলায় চলে যেতাম। মেলায় যাওয়া মানে সেখানে গিয়ে টকি দেখা হবে। টকি মানে সিনেমা দেখা। তারপর সার্কাস দেখা হবে। জাদু দেখা হবে। সেজন্য আমরা দুপুর থেকে উন্মুখ হয়ে থাকতাম।

দৃষ্টি রাখতাম আকাশে, দেখতাম আকাশটা কী রকম আছে। ধরা যাক, হঠাৎ মেঘের কোণে এক টুকরো কালো মেঘ দেখা দিল। আমরা বলতাম যে, ও মেঘ চলে যাবে। কিন্তু কিছু সময় পরে দেখা যেত মেঘটা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। এবং বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আমাদের তো তখন মন ভীষণ খারাপ হয়ে যেত। আবার কখনো কখনো ঝড়, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মেলার দিকে ছুটে যেতাম কিশোরের দল।

আমাদের ছিল দিগ্বিদিক সীমানা। অল্প বয়সী কিশোর বা ছেলেরা একসাথে বের হতাম। আর বর্ধমানে এক একটা শূন্য ও বিরাট মাঠ ছিল সেখানে দৌড়ে বেড়াতাম। কখনো বাড়ির বড়দের সাথে দোকানে চলে যেতাম হালখাতা খেতে। বড়দের কাছে পহেলা বৈশাখ মানে ছিল হালখাতা। গ্রামের মুদি দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধারে সবকিছু কেনা হতো। ব্যবসায়ীরা সারা বছরের যে পাওনা সেই টাকা তোলার জন্য হালখাতা করতো। ওই দিনকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীদের একটা প্রস্তুতি থাকতো, আবার যারা ধারে ক্রয় করতো তাদেরও একটা প্রস্তুতি থাকতো। আর একটা কথা, পহেলা বৈশাখে বর্ধমানের মহারাজার মন্ত্রী হাতি নিয়ে আসতেন। ওই হাতিটা বর্ধমান থেকে হেঁটে ওই হীরক গ্রামে এসে হাজির হতো। ওই দিন আমরা দলবেঁধে হাতি দেখতে যেতাম। একটা, দুটো পয়সা মাটিতে রাখতাম, হাতিটা শুঁর দিয়ে আশ্চর্য কৌশলে সেই পয়সা মাটি থেকে তুলে নিত।

একটা কথা আজও খুব মনে পড়ে। আমাদের গ্রামের এক মাইল দূরের গ্রামের নাম ছিল হীরক গ্রাম। সেই গ্রামে মহারাজার কাটা দিঘি ছিল। বিশাল দিঘি; দেড় মাইলের মতো লাম্বা আর এক মাইলের মতো চওড়া। তাতে প্রচুর পরিমাণে শ্যাওলা ভাসত। দিঘির এক কোণে ছিল কালচে চকচকে, টলটলে জল। সেখানে পদ্মফুল ফুটতো। সেই দৃশ্য বিশেষভাবে মনে পড়ে এবং পয়লা বৈশাখে আমরা যখন মেলায় যেতাম, ফেরার সময় ওই দিঘিতে নামতাম। যেমন করেই হোক একটা, দুটো পদ্ম নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। কোনোবারই পদ্ম নিয়ে আসতে ভুল হতো না। পদ্ম গন্ধ নাকে লেগে থাকতো। এই পদ্ম যতোক্ষণ পর্যন্ত পুরোপুরি নেতিয়ে না পড়তো, শুকিয়ে না যেত ততক্ষণ পর্যন্ত ফেলতাম না। চোখে চোখে রাখতাম, বেশিরভাগ সময় হাতে রাখতাম। কয়েকদিন ওই পদ্মফুল ঘিরে জীবন ঘুরতো। ঘুরেফিরে বিস্ময় দৃষ্টিতে সেই ফুল দেখাই ছিল একটা কাজ। সব মিলিয়ে পয়লা বৈশাখে মেলায় যাওয়াটা একটা বড় ব্যাপার।

বৈশাখী মেলার সব স্মৃতি এখন আর মণিকোঠায় সযত্নে নেই।

তবে হ্যাঁ, একটা স্মৃতি বেশ মনে পড়ে। যুগান্তদেবীর পীঠস্থানের কথা বলেছি। সেখানে প্রচুর পাঠা বলি হতো। বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজন আসতো। যারা সন্তানের মাথার চুল মানত করতো তারা আসতো। একদিকে নাপিত বসে থাকতো, সে বাচ্চাদের মাথা কামিয়ে দিতো। অন্যদিকে একের পর এক পাঠা বলি হতো। যুগান্তদেবী সম্পর্কে একটা কথা চালু ছিল যে, তিনি মহিষ পুষতেন। ফলে একটা মহিষও বলি দেওয়া হতো। এই মহিষ বলি দেওয়াটা ছিল ভয়ঙ্কর ব্যাপার। মহিষটাকে এমনভাবে প্রস্তুত করা হতো, যাতে এক কোপে কাটা যায়।

পয়লা বৈশাখে আমাদের ওখানের স্কুলগুলোতে অনুষ্ঠান হতো। আমাদের যবগ্রাম মহারাণী কাশেশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের সামনে তোরণ নির্মাণ করা হতো। বেলের ডাল, নিমের ডাল, পাতাসহ ফুল দিয়ে তৈরি সেই তোরণ হতো চমৎকার! ছোট্ট পরিসরে হলেও গানের আসর বসত। গামছা দিয়ে হারমোনিয়াম গলায় বেঁধে গান করতো কেউ কেউ। একজন সামনে আর কয়েকজন তার পেছনে পেছনে গান গেয়ে গ্রাম পরিভ্রমণ করতো। যারা গান বাজনা করতো তারা সবাই স্থানীয়। বাইরে থেকে শিল্পী নিয়ে আসার কোনো বিষয় ছিল না।

আমি এই যে কথাগুলো বলছি, এগুলো এখনও হয়তো হয়। সত্যি বলতে হতে হবে বলে এখন অনেক কিছুই হচ্ছে কিন্তু তার মধ্যে হৃদয় নেই, সবুজ নেই। গ্রামগুলোই কি আর গ্রাম আছে? গ্রামগুলো মরে গেছে। চেহারায়, আদলে, মানুষের আচরণে, মানবিক সম্পর্কে গ্রাম এখন মৃত। কোথাও কোথাও মুমূর্ষু। গ্রাম দরিদ্র হয়েছে নাকি ধনী হয়েছে সেটা বড় কথা নয়, আমার তো মনে হয় মানুষ আরো দরিদ্র হয়েছে। কারণ আমাদের ওই এলাকায় মানুষের আরও অন্যান্য অভাব ছিল। কিন্তু চাল, ডালের অভাব ছিল না। প্রত্যেকটা পরিবারকে মনে হতো স্থায়ী, মনে হতো সুন্দর। এখন গ্রামের বাড়িগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, পরীযায়ী পাখির মতো। গ্রামে আমরা যেসব বাড়ি থেকে অভ্যস্ত সেসব বাড়ি নেই। আমরা দেখেছি মাটির বাড়ি। আমাদের গ্রামে সব বাড়ি ছিল মাটির একতলা বা দুইতলা ঘর। দেখতে সুন্দর, অসাধারণ সেইসব বাড়ি একশ বছর টিকে আছে। এখন গ্রামের ঘর মরেছে, সংস্কৃতি মরেছে যা শহর থেকে যায় তাই গ্রামে হয়।

শুধু কি তাই! বৈশাখে স্কুলের সামনে পাপড় ভাজা, চিনির নানা রকম মন্ডা, কদমা তৈরি করা এগুলো তো ফুরিয়ে গেছে। মানুষ এখন মিষ্টিও আগের মতো খায় না। এখন আর হারমোনিয়াম নিয়ে গান গাইতে গাইতে কাউকে গাঁ পাড়ি দিতে দেখা যায় না। গায়েনের পেছনে পেছনে ছেলেমেয়ের দল ছুটে বেড়ায় না। তাই আমাদের দেখা পয়লা বৈশাখ, আর সেই সব চরিত্রের সাথে এখনকার কিছু মিলবে না।

বৈশাখ উদযাপন একেবারে পাল্টে গেছে। হালখাতার সেই সৌন্দর্যের বালাই নাই। গ্রামের চেয়ে এই উৎসব বেশি ছড়িয়ে গেছে শহরে। এখন যখন পহেলা বৈশাখে রাজশাহী শহরে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, দেখি বেশ জমজমাটভাবে পালিত হচ্ছে দিনটি। ওই দিনটিতে গ্রামেও বের হয়ে দেখেছি, কই কোথাও তো আত্মার স্পন্দন মেলে না। দুটো একটা জায়গাতে দেখেছি একটু-আধটু জিলাপি ভাজা হচ্ছে। একটা দীর্ঘ সময় চলে যেতে দেখেছি তো! মানুষের পরিবর্তন হয়েছে মনে ও আত্মীয়তায়। সম্পর্ক অনেক কিছু ঠিক করে দেয়। এখন সব কিছুতেই তাড়া। আমার তো মনে হয়, পয়লা বৈশাখ উদযাপনে আরও পরিবর্তন হবে, এই ড্রাম-ট্রাম বাজবে, ডিজে পার্টি, রেস্টুরেন্টে খাওয়া এসব হবে। মানুষে মানুষে বন্ধন না থাকার দিনে এসব দিয়ে কিছু বলে মনে হয় না। বন্ধন যে ফিরবে কিসে তাও বলা মুশকিল। এই উৎসবে যখন প্রাণ থাকবে তখন এটি সর্বজনীন হতে পারে। প্রাণের সঞ্চার থাকতে হবে। প্রাণ নেই, সবই শুকনো। সবুজ নেই, পাতাগুলো মৃতপ্রায় চোখের সামনে ঝরে পড়ছে। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় উন্মাদনা। পৃথিবীব্যাপী একই সমস্যা। এটি কেবলমাত্র বাংলাদেশের সমস্যা নয়। পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। কাকে দায়ী করবো- সরকারকে, দেশের আইন শৃঙ্খলাকে, মানুষের আচরণকে? সমাজ-সংগঠন, রাষ্ট্র সংগঠন,বিশ্ব সংগঠনগুলোর এ থেকে পরিত্রাণ চাইতে হবে। না হলে এই আতঙ্ক, এই রক্ত ঝরা থামবে না।

অনুলিখন : স্বরলিপি



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়