ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

গ্রামীণ বৈশাখী মেলা : যে স্মৃতি এখনো আনন্দের উৎস

আহমদ রফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৭, ১৮ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গ্রামীণ বৈশাখী মেলা : যে স্মৃতি এখনো আনন্দের উৎস

ছবি : মোহাম্মদ আসাদ

|| আহমদ রফিক ||
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে বিশালাকায় অশ্বত্থ গাছের নিচে এসেছে বৈশাখী মেলা, বাংলা নববর্ষের শুভ উদ্বোধন। হালকা অশ্বত্থ পাতাগুলোতে কী চঞ্চলতা! তাতে গুমোট কমে না, গরমও কমে না। কিন্তু কে তা গ্রাহ্য করে? শিশু, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, মধ্যবয়সী পুরুষ ও সামান্যসংখ্যক গৃহবধূ মেলায় এসেছে। বিনোদন ও কেনাকাটা দুটোই একসঙ্গে। রকমারি খেলনা, রঙিন বেলুন, টানা ঢোল, পুতুল, রঙিন ফিতা ও অলঙ্কার এমনকি শাড়ি- কী নেই এ মেলায়।

শিশুদের ঝোঁক বাঁশি, বেলুন, টানা ঢোল, রঙিন পেন্সিল ইত্যাদির দিকে। জাপানি খেলনা ও পেন্সিল থেকে ছোট ধারালো জার্মান ছুরি ও বিলেতি রঙের বাক্স ও বইখাতা- যার যেমন পছন্দ, কিনে নাও। বড় দোকানগুলোতে তাঁবুর মতো করে শাদা কাপড়ের সামিয়ানা টানানো বৈশাখী রোদ থেকে রক্ষা পেতে। টানা ঢোলের ড্যাং-ড্যাং আওয়াজের সঙ্গে বাঁশির পো-পো, বাতাসে ওড়া বেলুন আর সেই সঙ্গে শিশুদের কলকাকলিতে মুখর মেলাপ্রাঙ্গণ। বয়স্কদের দেখা যায় পরস্পরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি কাজের কথা, হালচাষ ও বীজবোনার কথা বিনিময় করতে। মেলার এই চরিত্রে রয়েছে এক ধরনের সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য যা সম্প্রদায়-নির্বিশেষ।

হয়তো এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ তার একাধিক লেখায় বছরের বিভিন্ন সময়ে দেশব্যাপী মেলা অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বলেছেন, মেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রয়োজন ও বিনোদনের চেয়েও অধিক, আর তা হলো পরস্পরের সঙ্গে চিত্তবিনিময়, শুভেচ্ছা বিনিময় সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির একটি সেতু। এ ভাবনা ভুল ছিল না। এখনো ভুল নয়।
 


রবীন্দ্র-ভাবনার অনুসরণে বলা যায়, মেলা শব্দটির মধ্যে রয়েছে মিলনের সুবাতাস ও অনুষঙ্গ। রয়েছে একদিকে হৃদয় খুলে দেওয়া এবং অন্যদিকে হৃদয় ভরে নেওয়া, এক কথায় উদার মানবিক চেতনার মর্মবস্তু। মেলার উৎসবে-আনন্দে সেই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এক কালে বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পয়লা বৈশাখের মেলায় উল্লিখিত আনন্দ উৎসবের প্রকাশ ঘটেছে। চৈত্রসংক্রান্তি অর্থাৎ শেষ চৈত্রে ব্যবসা কেন্দ্রে হিসাব-নিকাশ শেষে পয়লা বৈশাখ হালখাতা (হাল সনের খাতা খোলা) উপলক্ষে দেনাপাওয়া শোধ ও মিষ্টিমুখ ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ। বৈশাখী মেলায় তারই ভিন্ন প্রকাশ। আমার স্মৃতিতে সেই বৈশাখী মেলার চিত্র এখনো ধরা রয়েছে। সে আজকের কথা নয়, সাত-আট দশক আগেকার ঘটনা যার কিছুটা সাধারণ ছবি আঁকা হয়েছে এ রচনার সূচনাতেই। নববর্ষের এক দু’দিন আগে থেকেই আমার বয়সী শিশু-কিশোরদের মনে চাপা উত্তেজনা; মেলায় যেতে হবে কিছু কেনাকাটা করতে, আর সে জমজমাট মেলার দৃশ্য দু’চোখ ভরে দেখতে, যদিও কেনাই মুখ্য উদ্দেশ্য।

পয়লা বৈশাখের ভোরেই ঘুম ভেঙে অপেক্ষা, কখন মেলা শুরু হবে, কখন শোনা যাবে ঢাকের বাদ্য আর বাঁশির আওয়াজ। আর তখনি ভোরের বাতাস গায়ে মেখে দুই ভাইবোন মিলে মেলায় যাওয়া। অশ্বত্থতলা তখনো বেশ চওড়া, অনেক দোকান, অনেক লোক তার মধ্যে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা বোধ হয় বেশি। গাছের ছায়া কম হলেও ভোরের কাঁচা হলুদ রোদ তেমন একটা গায়ে লাগে না। একটা টানাঢোল তো কিনতেই হবে, অন্ততপক্ষে একটা জাপানি বাঁশিও তারপর দেখেশুনে কেনাকাটা। সারা বছর জমানো পয়সায় অনেক কিছু কেনা। বুবুর ঝোঁক- রঙিন ফিতা, নানা রঙের কাচের চুড়ি, আর বিশেষ করে পোড়ামাটির তৈরি ঘোমটাপরা ছোট্ট বউ আর বর-বউয়ের জোড়ামূর্তি। তাছাড়া পছন্দ হলে দু’এক জোড়া কানের দুল সোনালি রং হলেই ভালো, ওটাই তার পছন্দ।

শৈশবে-বাল্যে একদিনের সেই মেলা, বছর-ধরে প্রত্যাশিত মেলা ছোটদের জন্য যেন এক স্বপ্নের ভুবন। বিচিত্র সরঞ্জামে ঠাসা সেই মেলা সকাল থেকেই হাতছানি দিয়ে ডাকে বিশেষ করে ছোটদের। বেলা বাড়ছে, তবু কেনাকাটা শেষ হচ্ছে না। অনেক কিছু কেনা নয়, দেখেশুনে কেনা, তাই দেরি। বেশি দেরি হলে মায়ের বকুনি খেতে হবে। এদিকে রোদের তাপও বাড়ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাই একসময় ঘরে ফেরা। কিন্তু মন পড়ে থাকে ওই মেলা প্রাঙ্গণে। দুপুরের পর এ মেলাটি চলে যায় পাশের গ্রাম নাসিরাবাদের বটতলায়। দুই গ্রামে মিলে সমঝোতার ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা। তখনকার গোলমাথা বিশাল চেহারার বটগাছটির নিচে মেলা বসে। তখনকার প্রকৃতি এমনই ছিল যে প্রায় বছরই দুপুর শেষে বা বিকেলে কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডব দেখা দিতো। তখন দোকানিদের কী যে তাড়াহুড়া, দোকানের জিনিসপত্র গুটিয়ে নেয়ার। বাতাসে শাদা কাপড়গুলো উড়ছে নদীতে ফুলে-ফেঁপে ওঠা পালের মতই। চারপাশে ছোটবড় গাছ-গাছালির মাথায় বাতাসের এলোমেলো ঝাকুনি দেখতে মন্দ লাগে না। তবু দোকানিদের আহাজারি।

দুই

গ্রামের বৈশাখীমেলার এমন ধরনের ছবি স্মৃতিতে ধরা। সেকালের গ্রাম এখন রাজধানী এবং শহর ও জনপথের (হাইওয়ের) মতোই বৃক্ষ নিধন সমারোহের শিকার। তবু গ্রাম এখনো নিজের মতো করে বেঁচে আছে। অর্থনৈতিক মন্দায় ধুঁকছে গ্রাম। তাই সে মন্দা সারাতে গ্রাম উঠে আসতে চাইছে রাজধানীতে। শুধু চাইছে বলা ঠিক নয়, আসছেও জোরকদমে। পোশাক শিল্পকারখানায় কর্মরত তরুণীদের প্রায় সবাই গ্রামের বাসিন্দা। একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে রাজধানীতে এসে প্রায়শ বিপদের সম্মুখীন। সেসব কথা থাক। বৈশাখী কথকতায় এটা সত্য যে, ওই উৎসব-আনুষ্ঠানিকতা একদিনের হলেও এর মূল্য গ্রামবাসীদের জন্য যথেষ্ট আর এ সম্প্রদায়-নির্বিশেষ ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রকাশ দেখা যায় গ্রামাঞ্চলের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে। বিশেষ করে বাংলা সন তারিখ পালনে, আচার-অনুষ্ঠানে। এখানে লোক সংস্কৃতির প্রকাশ, যা সম্প্রদায়-নির্বশেষে চরিত্রের।
 


জরিপ ও পরিসংখ্যান প্রমাণ দেবে গ্রামীণ আচার-অনুষ্ঠানগুলোর ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্র। সেখানে আড়ম্বরের চেয়ে আন্তরিকতাই প্রধান। বৈশাখী নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষেও একই কথা খাটে। এ পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এমন অভিযোগ ওঠেনি যে বৈশাখী নববর্ষের অনুষ্ঠান ইসলাম-বিরোধী। উঠলে মুসলমান প্রধান গ্রামগুলোতে বৈশাখী মেলা জমজমাট প্রকৃতির হতে পারতো না, তাতে সব সম্প্রদায়ের ব্যাপক অংশগ্রহণও দেখা যেতো না।

যত সমস্যা শহরে শিক্ষিত শ্রেণীর সংকীর্ণ ও রক্ষণশীল চেতনার নাগরিকদের নিয়ে। সেই সঙ্গে যুক্ত রাজনীতিকদের কায়েমি স্বার্থ, যা প্রায়শ সাম্প্রদায়িক চরিত্রের প্রকাশ ঘটায়। একালে তা শহর-নগর থেকে গ্রামাঞ্চলে সঞ্চারিত হতে শুরু করেছে। তাতে সমাজের সাংস্কৃতিক চরিত্র পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সময় এগিয়ে চলেছে, বাংলাদেশের রাজধানী মহানগর থেকে বন্দরনগর ঘিরে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে ঠিকই, তবে তা পুঁজিবাদী, শিল্প-বাণিজ্যবাদী উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সমৃদ্ধিকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলছে। গ্রাম ঝুঁকছে, যেমন ঝুঁকছে নগরের নানা ধারার শ্রমজীবী শ্রেণী ও বস্তিবাসী জনতা।

পয়লা বৈশাখের স্মৃতিচিত্র রচনায় এসব কথা অবান্তর মনে হলেও এর বাস্তবতা অনস্বীকার্য। তাই প্রাসঙ্গিক সূত্রে গ্রাম-নগরের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের বিষয়গুলো উঠে আসে। এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বৈশাখী নববর্ষের আনুষ্ঠানিক উদযাপনেও। গ্রাম নগরের পার্থক্য সেখানে প্রকট। সত্যি বলতে কি স্বাধীন বাংলাদেশে বৈশাখী নববর্ষ উঠে এসেছে রাজধানী ঢাকায়। আর তার প্রকাশ মহানাগরিক আড়ম্বরের বৈচিত্রে, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশে।

তিন

জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে এখনো পয়লা বৈশাখে বা বিশেষ কোনো কারণে কখনো সেসব স্মৃতিচিত্র নিয়ে ভাবতে গেলে অবাক হই, কী আবেগ, আর কী সম্প্রীতির পরিবেশই না ধরা ছিল তখনকার গ্রামীণ বৈশাখী মেলা প্রাঙ্গণে। আরো অবাক হই ভেবে যে, দূর প্রত্যন্ত গ্রামের বৈশাখী মেলায় কীভাবে মিলতো সুন্দর সুন্দর রকমারি বিদেশী পণ্য উপকরণ। বিশেষ করে সুদর্শন খেলনা বা সুন্দর হারমোনিয়াম বাঁশি কিংবা গলা-চ্যাপ্টা শোডাওয়াটার বোতল। তবে সেখানে দেশী পণ্যেরই ছিল আধিক্য। বাঁশ বা বেতের তৈরি, রং করা কারুকার্যখচিত কুলা, হাড়ি-কলসী, চালুনি থেকে গৃহস্থালির জিনিসপত্র যা গ্রামীণ সংসারের প্রয়োজন মিটিয়েছে, আবার এর শৈল্পিক দিক ক্রেতার সাংস্কৃতিক তৃপ্তিরও কারণ হয়ে উঠেছে। এসবের কিছু কিছু ঘরে ঝোলানো বাহারি সিকায় তুলে রাখতেও দেখেছি কোনো কোনো সম্পন্ন কৃষক পরিবারে।
 


যেমন মৃৎশিল্পীদের তৈরি পোড়ামাটির রঙিন ছোটবড় নর-নারী বা প্রাণী বা পাখির মূর্তি। কাঠের তৈরি নানা ধরনের মূর্তিও দেখা গেছে মেলায়। এককথায় মৃৎশিল্প থেকে চারু ও কারুকর্মের বহু উপকরণ মেলার একটি কোণ ভরে তুলেছে। এগুলোর বেচাকেনাও ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। গ্রামীণ শিল্পীরা তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে অপেক্ষা করতেন মেলাগুলোর জন্য, বিশেষ করে বৈশাখী মেলার জন্য কারণ শেষোক্ত ক্ষেত্রে এগুলোর বিকিকিনি হতো অধিক পরিমাণে। বিক্রেতা শিল্পী হোক বা দোকানি হোক, ক্রেতা ছোট-বড় যে বয়সের হোক, নারী-পুরুষ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার জন্য পয়লা বৈশাখের মেলা প্রাঙ্গণ আসলেই ছিল মিলন মেলা। হোক তা একদিনের, এর আনন্দ-আস্বাদই আলাদা। প্রয়োজন ও বিনোদন দু’দিক থেকে এ মেলার সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ছিল সর্বজনীন চরিত্রের। এখনো বিক্রয় নিয়ে স্মরণ করি, ঘোমটা-টানা গ্রামীণ কৃষক গৃহবধূদের মেলায় উপস্থিতি। নিজে দেখেশুনে পছন্দ করে কিছু কিনবে বলে মেলায় আসা। এদিক থেকে ব্যতিক্রম গ্রামের সম্পন্ন পরিবারের মহিলারা।

এখন সে গ্রাম নেই, মেলার চারিত্র বৈশিষ্ট্যও বোধ হয় তেমন নেই। আগেই বলেছি স্বাধীনতা-উত্তর কালে রাজধানীতে জমজমাট, বর্ণাঢ্য বৈশাখী নববর্ষের অনুষ্ঠানের কথা। লক্ষণীয় যে, এটা একান্তভাবে শিক্ষিত মধ্য ও বিত্তবান শ্রেণীর সন্তানদের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রূপ পরিগ্রহ করেছে। একসময় আমিও এতে যোগ দিয়েছি, দীর্ঘদিন থেকে আর যাই না। কিন্তু এ বৈশাখী মেলার জমজমাট সমাবেশে ও বর্ণাঢ্য মিছিলে আমার অভিজ্ঞতায় রাজধানীর শ্রমজীবী শ্রেণী বা বস্তিবাসী সদস্যদের যোগ দিতে দেখিনি। এমন কি এ উপলক্ষে আয়োজিত পণ্য মেলায়ও ওইসব শ্রেণীর কাউকে দেখা যায়নি। এসব একান্তভাবেই উল্লিখিত শ্রেণী বিশেষের। আমার মনে হয়, ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ বৈশাখী নববর্ষের মেলার শুদ্ধ চরিত্রটি হারিয়ে গেছে। হয়তো সময় ও ইতিহাস-সংস্কৃতির অমোঘ নিয়মে, আর্থসামাজিক পরিবর্তনের প্রভাবে। যে-প্রভাব শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণীস্বার্থের পক্ষে গড়ে ওঠে। গণসংস্কৃতি ও জনবান্ধব রাজনীতি এর যথার্থ মোকাবিলা করতে পারে।

লেখক: রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ এপ্রিল ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়