ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ইলেকশান ফিলেকশান পার্ট-টু || শরীফ আতিক-উজ-জামান

শরীফ আতিক-উজ-জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২১, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইলেকশান ফিলেকশান পার্ট-টু || শরীফ আতিক-উজ-জামান



   ‘ও নবা কাকা, এ কী কামডা করলে? সক্কালবেলায় আসে আমার কুশোরির ক্ষেতের গুড়ায় ঢালতিছ? কুশোরগুলো কেবল ফাপ ছাড়তিছে, মুটা আর তেজি হয়ে উঠতিছে, এর মদ্যি আসে এই করলে? তুমার ওই এক ফাপের কুশোরিরতে যে নুনতা রস বারোইছে তাতে তো সারা কুশোরির ক্ষ্যাতের গুড়া ভিজে চপচপে হয়ে গেছে! কুশোরতো এবার সব নুনতা হয়ে যাবেনে। আমি ওগুলো এবার চেনির কলে পাঠাবো, না লবণের মিলি দেব? তয় তুমার যদি মধুমেহ থাহে তালি আর অসুবিধে নেই। ঘরের ডুয়ায় মুতে খিয়াল করে দেহিছ, আধঘণ্টা পর মুতির জাগায় পিঁপড়ে লাগে কি না? পিঁপড়ে লাগলি তুমার মুতি চেনি আছে। বালডা, আমার কুশোরির ভুঁই কি সবার হাগা-মুতার জাগা?’   

   আঁটসাঁট রংচটা জিন্সের প্যান্ট, ঢোলা গেঞ্জি, পায়ে কেডস, হাতে বয়লা পরা যে যুবক এক নাগাড়ে নবা নামের বয়সী লোকটাকে কথা শোনাচ্ছিল সে তাকে খুব পাত্তা দিচ্ছিল না। প্রচণ্ড বিরক্তি মাখা মুখে উঠে দাঁড়িয়ে কুলুপের ঢেলাটা জোরে ছুঁড়ে মারে, আর সেদিকে তাকিয়ে ছেলেটি বলে ওঠে, ‘ও কাকা, কুলুপির ঢেলাডাও আমার ভুঁই’র মদ্যি চালে মারলে? তুমার ভুঁই হলি সহ্য করতে? আমি তো কিছু কচ্ছি না।’

   ‘বাদওতো দিচ্ছিস নারে সালু,’ এতক্ষণে নবা কথা বলে, ‘আজকে তুরা ভারি সাহেব হইছিস, এই সেদিনওতো তোগের বাড়ির বিটা-বিটিরা ফুয়াত হওয়ার আগেই বদনায় পানি ভরে নিয়ে পগারে দোড়োতো। আজকে বাড়ি এটটা পায়খানা বসায়ে সব ভদ্দরনোক হয়ে গিছিস। কাউরে বাইরে মুততি দেখলিও রাগ হচ্ছে!’

   ‘কাকা, উল্টোপাল্টা কয়ে না। তুমি মুরুব্বি, সম্মান করি। উল্টোপাল্টা কলি কিন্তু মাথা গরম হয়ে যাবেনে।’ বিচিত্র ঢঙে কাটা চুলের ভিতর আঙুল চালাতে চালাতে বলে সালু। এক কানের পিছন থেকে ঘুরিয়ে আরেক কান পর্যন্ত মেশিন দিয়ে চুল চেঁছে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মাথার উপরে এক বোঝা চুল। সেটা দেখে হলুদ দাঁত বের করে হেসে ফেলে নবা। তারপর ওকে শুনিয়ে বলে, ‘হোলের উপর বালের থুপা। ও কিরম চুল কাটিছিস রে মনি! ও, তুইতো আবার মুস্তান। চুলির ওইরম তেড়ি না থাকলিতো মানাবি নানে, কী কইস?’

   ‘কাকা, কলাম না বাজে বকে না। মিজাজ এমনিই তিরিক্ষি হয়ে আছে।’ সালু মাটিতে লাথি মারে।

   ‘তাতো থাকপি। নেতা এমপিগে পিছনে পিছনে ঘুরিস। ওগের পাদের গন্ধ শুকলিও কইস আতরের মতো লাগতিছে। তহন মিজাজ খারাপ হয় না।’ নবা ঝামটা মেরে মেয়েদের মতো ঝগড়া করে। সালু কিছু বলে না, কী মনে করে সুরটা নরম করে ফেলে, নবার কাছে এসে বলে, ‘আচ্ছা কাকা, আমার জাগায় তুমি হলি কী করতে? রাগতে না? কুশোরির ভুঁই বানাইছি কয়ডা পয়সা আসপে সেই জন্যইতো, তা সবাই যদি ওর গুড়ায় হাগে-মোতে তাহলি কুশোর গাছ থাহে? ওই দেহো, আরেকজন ছাওয়াল হাগায় নিয়ে আসতিছে।’ আঙুল দিয়ে সামনের দিকে দেখায়। সেদিকে তাকিয়ে নবা দেখে ৩০-৩২ বছর বয়সী একজন মহিলা ৫-৬ বছরের একটি ন্যাংটো ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। তারা কাছে আসতে শোনা গেল ছেলেটি তার মাকে প্রথম ক্রিমিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে, ‘দানিথ মা, আমাল পাথায় না সাপ হইথেল।’

   মহিলা ঠাস করে তার পিঠে এক চড় বসিয়ে দেয়, আর ছেলেটি চড়ের শব্দের চেয়েও জোরে কেঁদে ওঠে। ওর মা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে বলে, ‘চুপ কর। সাপ হইছেল। শয়তান কুহানের যেন।’

    ‘ও সালেহা বু, ছাওয়ালডারে আমার কুশোরির ভুঁইতি হাগালে! আর কোনো জাগা পাওনা তুমরা।’ সালু বলে বটে কিন্তু তার মুখে আগের মতো অত রাগ নেই। সালেহা তার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ছেলের হাত ধরে হন হন হেঁটে চলে যায়। আর সালু ও নবা সেদিকে চেয়ে থাকে। তার গুরুনিতম্বের ডান-বাম নৃত্য নাকি ছেলেটির বিচিত্র কান্নার সাথে মাকে উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য গালিগালাজ তাদের দীর্ঘক্ষণ ওদের গমনপথের দিকে চেয়ে থাকতে বাধ্য করে সেটা কেবল তারাই জানে। ওরা চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলে সালু যেন সম্বিত ফিরে পায়। নবার দিকে চেয়ে দেখে সে জুলজুল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ঢাকার প্রচেষ্টায় সে বলে ওঠে, ‘ও কাকা, এই যে এনজিওগুলো অল্প টাহায় এত পায়খানা বসালো, তা তুমি এটটা নিতি পারলে না?’

     ‘তুমার কাছে অল্প টাহা, আমার কাছেতো ম্যালা। ক্যা, গেলবার ইলেকশানের সুমায় কইছিলে তুমরা জিতলি আমাগে ঘরে ঘরে পাকা পায়খানা বসাবা, তার কী হলো?’

    ‘‘ক্যা, দিলামতো। ‘সুখি হাগো আরামে মোতো’ পোরকল্পেরতে আমরা কত পায়খানা দিলাম। পোথম দিন আমাগের নেতা আসে চাড়ি বসায়ে উদ্বোধন করল। তুমি পাওনি?’’

   ‘তুমি পাওনি?’ ভেংচি কেটে বলে নবা, ‘আমার কথা কি তহন তোর মনে ছেল? ভোটের আগে কত মিঠে মিঠে কথা কলি। ভোট দিলাম, তারপর ভাগে গিলি। এহন বাগানে আসে মুতার জন্যি ধরিছিস। ক্যা, এটটা পায়খানাতো আমারে দিতি পারতিস।’

   ‘আমি কী অরে জানব যে তুমি পাওনি। কত মানষি নিয়ে গেল।’ সালু বলে।

   ‘কত মানষি পালো তয় এহনো এতো লোক পগারে যায় কেনরে?’ নবা ক্ষেপে গিয়ে জানতে চায়।

   ‘খাসিলত, কাকা, খাসিলত। ওগের বিলি হাগে খালে ছুচতি না পারলি শান্তি হয় না।’ 

   ‘হ, তুমিতো তাই কবা। ঢাকেঘিরে হাগতি পারলি লোকে পাছা দেহাতি যাবে কেন রে? তোগের নেতারা তো সব চিয়ারে বসা পায়খানায় হাগে। চিয়ারম্যানের বাড়ি দেহিছি। আমরা তো আর সেগুলো চাচ্ছি না।’

   ‘হাহাহা, তুমি কমোডের কথা কচ্ছো, কাকা। ওগুলোর দাম জানো? এক লাখ, দেড় লাখ। তয় কি জানো, দেড়লাখ টাকার কমোডে বসে দেড়ঘণ্টা ধরে কুতাকুতি করে দেড়খান ছাগলের নেদি ফেলতি ওরা ঘামে নায়ে ওঠে। আর তুমরা দোড়োয়ে আসে আমার কুশোরির ভুঁইতি বসে দেড়মিনিটি পেট ঝাড়ে ধুয়ে যাও। কী আরাম!’

   ‘আমারে এটটা পাতেবসা পায়খানা দিতি পারলি না। বেশ, পায়খানার কথা ছাড়, একটা পানির কলতো আমারে দিতি পারতিস? সরকার বাড়ির কলেরতে পানি আনতি গিলি মাঝে মাঝে ওরা খ্যাকখ্যাক করে, হ্যান্ডেলে তালা মারে রাহে,’ নবা বলে।

   সালু যেন সুযোগ পেয়ে যায়। কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, ‘কাকা, ভালো কথা মনে করাইছ। এইবার যদি আমাগের নেতা আহাদ মুন্সী জেতে তাহলি তুমারে পায়খানা কল না, আরো ম্যালা কিছু দিবানি। তুমি ভাবতিও পারো না।’

   ‘বাল দিবিনি,’ নবা ঠোঁট উল্টোয়ে বলে, ‘ভোট হয়ে গিলি তোগের ছায়া দেহা যায়রে হারামজাদা! আর তোগের নেতারাতো ৫ বছরের মদ্যি এমুহো হয় না। কালো কাঁচ ঘিরা গাড়িতি চড়ে মাঝেমদ্যি আসলিও টের পাওয়া যায় না।’ নবা ক্ষেপে যায়।

   সালু দাঁত বের করে বেহায়ার মতো অনেকক্ষণ হাসে। বোঝাতে চায় নবার কথা সে গায়ে মাখেনি। বন্ধুর মতো তার কাঁধের ওপর হাত রেখে হাঁটতে থাকে, বলে, ‘কাকা, তুমারে কিছু দিইনি সত্যি, তয় যাগের দিছি তারাওতো আরো চায়। কেউতো খুশি না। নাপিত যেরাম টাকো মানষিরে চুল কাটে সন্তুষ্ট করতি পারে না, আমাগের অবস্থাও সেইরম। যতোই দ্যাও, আরো চায়। খালি চায়।’

   নবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, কারণ সালুর কথা সে মানতে পারে না। গরিব মানুষের স্বার্থচিন্তা একই রকমের। জীবনে ছোটখাট চাহিদার জন্য যাদের দীর্ঘজীবন অপেক্ষা করতে হয়, না পাওয়ার হতাশা তাদের অনেক বড়। আক্ষেপগুলো কুরে কুরে খায়। হঠাৎই সে ক্ষেপে গিয়ে ঝাড়ি মেরে সালুর হাত কাঁধ থেকে ফেলে দেয়। রাগে তার রুগ্ন ঘাড়ের রগ ফুলে ওঠে, ঢেলা বেরুনো চোখ দুটো লাল দেখায়, খোঁচা খোঁচা দাড়িতে তার মুখে অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। মুঠো পাকিয়ে উচ্চস্বরে বলতে থাকে, ‘তোগের ওইসব নেতাগের আর চিনতি বাকি নেই। এই গিরামের কালকের চোখ ফুটা মুস্তান আর পরশুদিনির ধোন ফুটা নুচ্ছগের নাম ওগের মুখস্ত, কিন্তু এটটা ভালো মানষিরে চেনে না। ওইসব শয়তানগুলোরে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যেমন তুই ঘুরিস। তোগের পালতি পুষতিতো টাহা লাগে। তোগের প্যাটই ভরে না! আমারে কী দিবিনি তা জানি।’

   ‘কাকা, আজুড়ে প্যাঁচাল পাড়ে নাতো। নেতা কইছে, এবার জিততি পারলি গিরামের মানষির জন্যি ম্যালা কিছু করবে।’

   ‘হ, গেলবার নিজির জন্যি করিছে, এবার মানষির জন্যি করবে। এবার নিজির জন্যি আর করার দরকার হবে নানে।’

  ‘ওইযে কাকা, আবার বাজে কথা কচ্ছো। শোনো, এবার গিরামে ‘এক কিষক এক বিঘে জমি এক বাড়ি’ পোকল্প নেওয়া হবে। কিসির সেইসুমায় ধরে পায়খানা আর কল করতিছ। তুমারে যদি এইডে পাওয়ায় দি ওইসব লাগবেনে? কও? লাগবেনে?’

   সালুর এই কথায় নবা বেশ ঠান্ডা মেরে যায়। বিড়বিড় করে কী যেন বলে। একবার সালুর দিকে তাকায় আরেকবার  আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকায়, তারপর বলে, ‘তুই যা কচ্ছিস তা কি সত্যি! একখান বাড়ির সাথে এক বিঘে জমি!’ নবার চোখ বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়।

   ‘তয় আর কচ্ছি কী!’ সালু ফিসফিস করে এমন ভঙ্গিতে বলে যেন অন্যে জেনে গেলে খুব সমস্যা যদিও কাছাকাছি দূরত্বে তেমন কেউ নেই। ‘শোনো, আমাগের নেতারে এবারো জিতেতি হবে। ওইসব ধুনফুন শোনবো নানে। আমাগের নেতার বিপক্ষে বশির মণ্ডল দাঁড়াচ্ছে। একবার ভাবোতো বশির মণ্ডল জিতলি কী পাবানে? সে কি এই এলেকার লোক? ঢাকায় ব্যবসা করে, ঢাকায় থাহে। আমাগের নেতাতো জেলাসদরে থাহে। সে না আসলিও আমরা তো দরকারে দোড়োয়ে যাতি পারি। সে জিতলি কি ফসফস দোড়োয়ে ঢাকা যাওয়া যাবেনে? আর তুমি তারে ভোট দিলিও কি বিশ্বাস করবেনে? তাই আমি যা কই শোনো। এবারো আমাগের নেতারে জিতেতি হবে। তার কথায় নবা তাৎক্ষণিক কিছু না বললেও সে যে টোপটা প্রায় গিলেছে তা বোঝা যায়। কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে সে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে।

     ‘নেতার হাতটা কী নরম দেহিছিস? এক্কেবারে তুলোর মতন।’ পাশে দাঁড়ানো যে লোকটির দিকে তাকিয়ে নবা কথাটা বলে তার পরনে তার মতোই ময়লা গেঞ্জি ও আধছেঁড়া লুঙ্গি। কালচে দাঁত বের করে সে প্রশস্তির হাসি হাসছিল। তা দেখে লোকটির কেমন যেন রাগ হয়ে যায়। খ্যাচম্যাচ করে ওঠে, ‘শোন নবা, নরমতো হবেই। সে কি শিঙখুঁচা চোর, নাকি তোর আমার মতো চাষা। শাপল-কুদাল-নাঙ্গল চালালি কি আর ওইরম নরম হতো? তুই যেরম গলে পড়তিছিস তাতেতো মনে হচ্ছে মাই টিপার মজা পাইছিস।’

   তার কথায় নবার হাসি বন্ধ হয়ে যায়। বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘তোর ফাজিল কথা কওয়ার অভ্যাস আর গেল নারে সলেমান। একখান কথা কলি দুইখেন কাজানি থাহে তার মদ্যি।’

   ‘কাজানি কি আর সাধে আসে? ভোট হয়ে গেলে এগের ছায়াও দেহা যাবে নানে। এহন আসে কয় হ্যান দিবানি, ত্যান দিবানি, পরে আর কথা কয় না।’

   ‘হ, তাতো। কিন্তুক আমাগের মতো গরিব মানষির আর কি করার আছে ক?’ 

   ‘চল, এহেনে দাঁড়ায়ে থাহে নেতার চিহারা দেখলিতো আর পেটে ভাত যাবে নানে।’ তাকে একপ্রকার টানতে টানতে নিয়ে আসে সলেমান। ওদিকে ‘গণসংযোগ’ করতে আসা নেতা ঠেলাঠেলি ভিড়ের মধ্যে হাত মেলাচ্ছে। নিজে মেলাচ্ছে বলা চলে না, বগলে ফোড়া হলে যেভাবে যে ভঙ্গিতে কেউ হাত উঁচু করে থাকে অনেকটা সেইরকম ভঙ্গিতে হাত উঁচু করে নেতা দাঁড়িয়ে আছেন। আর যে যেভাবে পারছে তার হাত ধরছে। কেউ ধরে ঝাঁকি মারছে, কেউ চাপ দিচ্ছে, কেউ কোনোরকমে ছুঁয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ সেটুকুও না পেরে আফসোস করছে। গজদাঁত বের করে হাসতে থাকা নেতাকে সেইমুহূর্তে তাদের দাঁতাল বন্যশুকরের মতো মনে হয়।

   সলেমান ও নবা হেঁটে যেই বড় রাস্তায় উঠতে যাবে তখনি সামনে এসে একটা মটরসাইকেল ব্রেক কষে দাঁড়ায়। চাপাচাপি করে বসে থাকা তিনটে ষণ্ডামার্কা ছেলে নেমে ওদের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সিগারেট টানতে থাকা একটা ছেলে ওদের মুখের ওপর ধোঁয়া ছাড়ে। ধোঁয়া আর ওর মুখের দুর্গন্ধে নবা-সলেমানের দম বন্ধ হওয়ার যোগাড়। ছেলেটি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলে, ‘ও কাকারা, ভোটতো আসে গেল, এবার কী ভাবতিছ?’

   ‘কী ভাববো?’ নবা বলে।

   ‘যদি কিছু না ভাবে থাহো, তালি ভোট কিন্তুক এবার বশির মণ্ডলরে দিতি হবেনে। পেত্তেকবার ওই শালারে দ্যাও ক্যা?’ আঙুল দিয়ে ‘গণসংযোগ’ চালাতে থাকা আহাদ মুন্সিকে দেখায়। নবা ও সলেমান কিছু বলে না। খানিকটা বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটি মুখের সিগারেটে ঘনঘন কয়েকটা টান মেরে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিঁপড়ে পেষার ঢঙে আগুন নেভায়। তারপর কাছে এসে বলে, ‘আচ্ছা কাকা, ওই শালা তুমাগের কি দেছে? একবার আমাগের নেতারে জিতেয় দেহো। আমরা কিছু দিতি পারি কিনা। সালু বানচোতের চেয়ে আমাগের খেমতা কত বেশি সেডা একবার পরখ করে দেহো। ওগের কাছে চালিতো ওরা তুমাগে সরকার দেহায়। বশির মণ্ডলের যে টাহা তা গুনতি গিলি তুমাগের দুইজনের মুখির ছ্যাপ শুকোয়ে যাবে। গিরামে কিছু করতি গিলি সরকার লাগে? ওতো বশির মণ্ডলের দুই ঘণ্টার আয়।’

   নবা ও সলেমান কিছু বলছে না দেখে মটর সাইকেলের ওপর বসে থাকা ছেলেটি বেশ খরখরে গলায় বলে ওঠে, ‘শোনো কাকা, এবার যদি ভোট না দ্যাও, এবার বশির ভাই যদি হারে যায় তাহলি খবর আছে। আমাগের এট্টা মানসম্মান আছে না! নেতার সামনে মুখ দেহাবানি কীরম করে?’   

   ‘তুমাগের মুখ তুমরা দেহাবা না নুকোয়ে থুবা তা আমরা কী জানি।’ সলেমান বলে ওঠে। একটা ছেলে ঘাড় ব্যাকা করে বলে ওঠে, ‘শোনো কাকা, আলাং-ফালাং কয়ে না। বশির ভাই হারলি এবার খবর করে দিবানি। ভোট বশির ভাইরে দিবা, এই হলো শেষ কথা। এই চল।’ মটর সাইকেলের চালকের আসনে বসা ছেলেটার পিঠে থাবা দিয়ে সে বলে। বাইক চলার সাথে সাথে ওদেরও মুখ চলতে থাকে। তার কিছু নবা-সলেমানের কানে আসে কিছু আসে না। ওরা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে নবার দিকে তাকিয়ে সলেমান বলে, ‘কী অরবি? এবার মণ্ডলরে ভোট দিবি? যেরাম ভাব দেহালো তাতেতো মণ্ডল না জিতলি ঘাপান খাতি হবেনে মনে হচ্ছে।’

   ‘কিন্তুক সালু কি ছাড়বেনে?’ নবা বলে। আসলে সে ঘোরের মধ্যে আছে। সালুর টোপটা সে ভালোই গিলেছে। বাড়ি আর জমির লোভ তাকে ভালোই কব্জা করেছে। ফলে সে আর হেলবে বলে মনে হয় না। বরং সলেমানের ভোটটা যেন সালুর নেতার বাক্সে যায় সেজন্য সে পীড়াপীড়ি করেই চলে।

   ‘আরে কাইলকের ছিমড়াগের অত ভয় পালি চলে? উরা কি ছিঁড়তি পারে? আমরা কি সব ত্যানকা নাহি। এই গিরামে আমাগের নাড়ি পুতা রইছে। অত গাঢ় খুচানু চলবে নানে।’

   তার কথায় খুব ভরসা পায় না সলেমান। সে কিছুটা ভয় পেয়েছে বলে মনে হয়। আবার না পাওয়ার ক্ষোভ থেকে বর্তমান এমপি আহাদ মুন্সীকে তার ভোট না দেওয়ার ইচ্ছা। তাই চুপ করে থাকে। সে কিছু না বলায় নবা তাকে সাহস দেওয়ার জন্য বলে, ‘শোন, মুস্তান বশির মণ্ডলের আছে, আহাদ মুন্সীর কম নেই। বেশি বাগাড়বাই করলি সালুরে কয়ে ওগের ভাঙে ছাড়বানি। তুই দোমোনা করিস নে।’

   আজ দু’মাস হলো সালুরে কোনোভাবেই ধরতে পারছে না, নবা। বাড়ি গেলে বলে নেই। পথে দেখা হলে মটরবাইকের ওপর থেকে হাত উঁচু করে ‘কাকা, পরে কথা কবানি’ বলে সটকে পড়ে। ইলেকশানের আগে তার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া ‘এক কৃষক এক বিঘা জমি এক বাড়ি’ পাকা আসন করে নিয়েছে। কোনোভাবেই সেই ভাবনা থেকে সে বেরুতে পারছে না। সালুর টোপ গেলার পর বড়শিটা এখন তার গলায় আটকে গেছে। টানাটানি করে ছাড়াতে পারছে না। আজ সকালে সে একেবারে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে যে বড় রাস্তায় ওঠার মুখে সে যে করেই হোক সালুর মটর সাইকেল আটকাবে। বেশ সকাল থেকে এসে বসে আছে কিন্তু সালুর দেখা নেই। চেনাপরিচিত যারাই পথ দিয়ে গেছে সবাই তাকে প্রশ্ন করেছে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে কোনো উত্তর দেয় নি। আজ ধনুভাঙা পণ করে এসেছে যে সালুকে সে ধরবেই। বারবার টালবাহানা সে সহ্য করবে না। বারবার ভোট দেবে কিছু পাবে না। এবার তা হবে না। ভাবতে ভাবতেই সে দেখে ধুলো উড়িয়ে মটরবাইকে চড়ে সালু আসছে। সে উঠে দাঁড়ায়, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুহাত উঁচু করে সালুকে থামানোর ইশারা করে। আজ আর সালু পাশ কাটিয়ে যায় না। ব্রেক কষে দাঁড়ায়। তারপর প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে খ্যাচম্যাচ করে ওঠে, ‘ও  কাকা, কী পাইছডা কী? রোজ রোজ আমার রাস্তা আগলাও ক্যা?’

   ‘আমারে সেই তা দিবি নে, বাপ?’ নবা একবারে গলে নরম সুরে বলে।

   ‘কী?’ সালু বিরক্ত স্বওে জানতে চায়।

   ‘ওই যে কইছিলি, জমি আর ঘর।’ কথাটা বলে নবা উৎসুক হয়ে সালুর দিকে চেয়ে থাকে।

   ‘ইচ্ছেতো ছেল, তয় তুমিতো কথা রাহোনি, কাকা। বেঈমানি করিছ।’ সালুর কণ্ঠ বেশ রূঢ় শোনায়। তার এ কথায় থতমত খেয়ে যায়। তোতলাতে তোতলাতে বলে, ‘মানে? কিসির বেঈমানি?’

   ‘তুমিতো আমাগে ভোট দ্যাওনি।’ সালু বলে। তার কথায় ক্ষেপে ওঠে নবা।

   ‘মানে, কী কচ্ছিস তুই।’

   ‘ঠিকই কচ্ছি। তুমি বশির মণ্ডলের লোকজনের কাছেরতে মাল খাওনি? ভোটের আগে ফুরকান, লুকমান আর কাসেম তুমারে মাল দেছে। কত দেছে তাও জানি। তুমরা ঠিকঠাক মতো ভোট দিলি আহাদ মুন্সী আরো বেশি ভোটে জেতত।’

   তার এই কথায় নবা আকাশ থেকে পড়ল। সে গলা চড়িয়ে সালুকে বলতে থাকে, ‘গেলবার ভোটের পর কলি, দিলি পাবানে। কিন্তুক পালাম না। আর এবার কচ্ছিস ভোটই দিই নি। সব হলো তোগের না দিয়ার ফিকির।’ সালুর দিকে হাত উঁচিয়ে তেড়ে যায় নবা। আর এই ফাঁকে পাশ কাটিয়ে বাইক নিয়ে সটকে পড়ে সালু। তার দিকে ঘুসি পাকিয়ে কিছুদূর ছুটে যায় নবা। কিন্তু ধরতে না পেরে নানারকম খিস্তিখেউড় আওড়াতে থাকে। হঠাৎই তার পাশে আরেকটি বাইকে ফোরকান, লোকমান ও কাসেম এসে দাঁড়ায়। নবার দিকে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে কাসেম বলে, ‘ও কাকা, কী হলো? দেলো না তুমারে জমি আর ঘর! বশির ভাইরে ভোট দিলি ভোটের আগেও মাল পাতে, পরেও পাতে। এহন আম-ছালা দুই-ই গেল। যাও, বাড়ি যায়ে... চোষোগে যাও।’ বুড়ো আঙুল মুখের মধ্যে দিয়ে অশ্লীল ভঙ্গি করে।

   নবা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ছেলেগুলো মটরবাইক নিয়ে ফুররররর করে বেরিয়ে গেল। প্রচণ্ড গতিতে সেটা চোখের আড়ালে চলে গেল আর পেট্রোল পোড়া কালো ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে উড়ে এসে নবার নাক-চোখ-মুখে লাগল। ধোঁয়ার ঝাঁজে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে আর খকখক করে কাঁশতে থাকে। হঠাৎই শুনতে পায় একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় একটি ছেলে আহাদ মুন্সীর বিজয়োত্তর জনসভার প্রচারণা চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে একক কণ্ঠে শ্লোগান দিচ্ছে, ‘আহাদ ভাইয়ের দুই নয়ন, গরিব-দুঃখীর উন্নয়ন’, ‘আহাদ ভাই চায় না, গরিব-দুঃখীর কান্না।’ অটোরিকশাটা তার সামনে দিয়ে চলে যায় আর নবা সেদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।         

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা  

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়