ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ছোটগল্প || বীণার তিনকাহন

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২১, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || বীণার তিনকাহন

অলঙ্করণ : শতাব্দী জাহিদ

|| হাসান মাহামুদ ||

পরপর তিনবার কলিং বেল বেজে শব্দ থেমে যাবার পর দরজা খুলতে গেল বীণা। এতক্ষণ সে সোফায় বসে ছিল, কারণহীন। ড্রয়িং রুমের এই সোফাটি তার প্রিয়। এখানে বসে জানালার পর্দা সরালে সামনের পুরো মাঠ আর পাশ ঘেঁষে আসা বাসার রাস্তাটা দেখা যায়। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিনের মতো ফ্রেশ হয়ে কফির মগ হাতে নিয়ে বসা হয়নি তার। সামনের টি-টেবিলে ব্যাগটা রেখেই বসে পড়েছিল সোফায়। সাংঘাতিক রকম বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষণ ফ্লোরের কার্পেটে পায়ের আঙুল ঘঁষেছে। এরপর কখন যে আনমনা হয়ে গেছে খেয়াল করেনি। কলিং বেলের শব্দে সংবিত ফেরে তার। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে সম্পার টিচার নিপা দাঁড়িয়ে আছে। নিপা হাসিমুখে সালাম দেয়। সালামের নিষ্প্রভ জবাব দিয়ে বীণা নিপাকে ভেতরে আসতে বলে।

সম্পা খাটে শুয়ে আর পারভিন ফ্লোরে বসে টেলিভিশন দেখছিল। বীণা রুমে এসে সম্পাকে বলে, ‘যাও, তোমার টিচার এসেছে।’

সম্পা একবার মায়ের দিকে তাকায়, আবার টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে বিছানায় উঠে বসে। পারভিন খাটের পাশে আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা ব্যাগ নিয়ে প্রস্তুত হয়। দুজন একসঙ্গে ড্রইং রুমে এসে বসে।  

আগে টিচার এলে সম্পার হাজারো বায়না শুরু হতো। বীণা আদর করে অনেক বুঝিয়ে কোলে নিয়ে সম্পাকে টিচারের সামনে বসিয়ে দিত। ইদানিং বীণার মানসিক অবস্থার তরঙ্গ যেন ওর ছোট্ট হৃদয়টিতেও পৌঁছেছে। বায়নার উপলক্ষ ফুরিয়েছে। চঞ্চলতাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। চুপচাপ পড়তে যায়। একেবারে পড়া শেষ করে উঠে আসে। অথচ আগে পড়তে বসে, ‘হিসু করবো’, ‘আব্বুর সঙ্গে কথা বলবো’, ইত্যাদি নানান অজুহাতে এক ঘণ্টায় কয়েকবার উঠে বীণার কাছে চলে আসতো। বীণা পুনরায় ওকে কোলে নিয়ে টিচারের কাছে দিয়ে যেত। তখন বাম হাত দিয়ে বীণার একটি আঙুল ধরে রাখতো সম্পা। এখন কোনো অজুহাতই সে তোলে না।

গত বছরের ঠিক এই মাসের তিন তারিখ থেকে বীণার সংসারের সকল ধরনের হিসাব-নিকাশ উলটপালট হয়ে গেছে। যদিও এর আগের দেড় বছর ধরেই চলে আসছিল এই ভাঙ্গা-গড়া। অনেক ধৈর্য্য ধরে সংসারটা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল বীণা। শেষ রক্ষা হয়নি। আবিরের অদ্ভুত নব্য সভ্যতায় সমৃদ্ধ বহুগামী কালচারের কাছে হার মানতে হয়েছে বীণাকে। গত জানুয়ারিতে আবির সাফ জানিয়ে দিয়েছে- আর একসঙ্গে থাকছে না সে।

তারপর থেকে বীণার প্রতিটি পদক্ষেপই যেন ক্যামেরায় ধরা। এখানকার আবাসিক এলাকায় প্রমোটার, সরকারি চাকুরে, অধ্যাপক, কালোবাজারি, দুঁদে রাজনীতিকের সাম্যবাদি সহাবস্থান। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিচিত্র রুচির, বিচিত্র মানসিকতার মানুষগুলো অতীতকে ফেলে এসে নতুন জীবন সাজানোর চেষ্টা করছে। কিছু লাভ, কিছু লোকসান নিয়ে। সবাই যেন একই সঙ্গে দৌড় আরম্ভ করেছে। সম্পর্কের শীতলতা কাটতে যাদের প্রথম প্রজন্ম কেঁটে যায়। যদিও এর মধ্যে কিছু একাকিনী আছেন, আলোচনা আর কৌতূহলের বিষয়বস্তু হয়ে। বীণা তেমনই একজন। গত বারোটি মাসে এ উপলদ্ধি প্রতিনিয়ত ছুঁয়ে গেছে বীণাকে। নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে করে সে ক্লান্ত, একাকিনী।

জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুটা তার অন্য একশটি মেয়ের থেকে রঙিন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী আবিরের সঙ্গে চুটিয়ে তিন বছর প্রেম করে নিজেদের ইচ্ছায় বিয়ে। পরিবার থেকে অমত না থাকলেও চাল-চুলোহীন আবিরের বিষয়ে কিছুটা দ্বিমত ছিল বাবা-মায়ের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে- এই যুক্তি দিয়ে বাবা-মায়ের সম্মতি আদায় করেছিল বীণা। বিয়ের দ্বিতীয় বছরেই আবিরের ইচ্ছায় সংসারে নতুন অতিথি আসে। দুজনে পছন্দ করে নাম রাখে ‘সামিয়া’। চার বছরের মাথায় ‘সম্পা’। পলকেই কেটে গেছে দাম্পত্য জীবনের ছয় বছর। যখন তখন আবিরের কাছে আসার বায়না, শীতকালে গ্যাসের চুলো কমিয়ে রেখে পানির পাতিল বসিয়ে ঘুমাতে যাওয়া, বীণার বিকেল বেলার অফিস দাম্পত্যের জোরে কামাই করানো, রুটিন করে সপ্তাহান্তে থিয়েটার। এ রকম অসংখ্য অনুষঙ্গে কেটেছে পুরোটা সময়।

শুরু থেকে বীণাই সংসারের পুরো দায়িত্ব পালন করে আসছিল। বিয়ের আগে থেকেও। কাজি অফিসে বিয়ে করতে সঙ্গে দুজন সহপাঠীসহ পাঁচ হাজার টাকা এনেছিল আবির। ধার করে আনা এই টাকাও পরে বীণাকেই শোধ করতে হয়েছে। বিয়ের দ্বিতীয় মাসে মামাকে বলে তাঁর ট্রাভেল এজেন্সীতে আবিরের চাকরির ব্যবস্থা করে বীণা। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে শুধু মিষ্টি নিয়ে বাসায় এসেছিল আবির। মন খারাপ করে বলেছিল, ‘ধার শোধ করতেই বেতনের সব টাকা শেষ হয়ে গেল, তোমার জন্য কিছু কেনা হলো না’। এই কথাতেই খুশি হয়ে বীণা সেদিন খুশিতে কেঁদে উঠে আবিরকে জড়িয়ে ধরেছিল। এরপর আর কোনো মাসেই ধার শোধের চক্র থেকে বের হতে পারেনি আবির, বীণার জন্য কখনো কিছু কেনাও হয়নি তার।

সরকারি চাকরির সুবাদে ফ্ল্যাট পাওয়ায় রক্ষা। বীণার পুরো টাকাই সংসারে ব্যয় হতো। তবে প্রতি মাসে আবিরের জন্য নতুন নতুন জামা আর প্যান্ট কিনতে ভুল হতো না তার। এক সময় আবিষ্কার করা গেল, বীণার নতুন কোনো শাড়িই নেই। মাঝে মাঝে জামা বানানো হলেও শাড়ি কেনা হয়নি তার। ততদিনে আবির ট্রাভেল এজেন্সীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে শেয়ার ব্যবসায় মন দিয়েছে। পুঁজির যোগান দিতে মায়ের দেয়া বীণার খুব শখের হাতের দুটো বালা বিক্রি করতে হয়েছিল। কিন্তু তিনমাসের বেশি শেয়ার বাজারে সূচকের উঠানামা পছন্দ হয়নি আবিরের। বীণার গলার সীতাহার বিক্রি করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম খুলেছে আবির। পাঁচ বছর যাবত এই ফার্মেই আছে সে। ইভেন্ট অর্গানাইজ করতে গিয়ে আবিরের পরিচয় হয় মিসেস জয়ার সঙ্গে। ব্যবসায়িক সর্ম্পক এক সময় বন্ধুত্বে, তারপর তা অভিসারের সঙ্গীর পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বীণা এর কিছুই আঁচ করতে পারেনি। বরং বিয়ের চার বছরের মাথায়, বীণার বাইরে থাকা, অফিসে সেজে যাওয়া, বাসায় আবিরের কোনো বন্ধু এলে সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলা প্রভৃতিতে সন্দেহভরা প্রশ্ন তুলতো আবির। এক সময় এই সন্দেহ বীণার শরীর পর্যন্ত নিয়ে আসে আবির। বীণা আশ্চর্য হতো, আর প্রতিনিয়ত নিজেকে মনে মনে শাসনের মধ্যে রাখতো। ছয় মাস রাতের ভালবাসা নড়বড়ে অবস্থায় চলার পর আবির জানালো, বীণাকে আরো শুকাতে হবে। ডায়েট করতে করতে দেড় মাস পর ধরা পড়লো, বীণার গ্যাস্টিক বেড়ে আলসারের পর্যায়ে এসে গেছে। তখন আবির বীণাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে বাহির-গমনের প্রসঙ্গ তুলে বসে। বীণার সম্মতি ছাড়াই এর বৈধতাও আদায় করে নেয় আবির। এতেও বীণার বাধা ছিল না। যদিও সপ্তাহ-মাসে নিজের নারীত্বের অস্তিত্ব মাথাচাড়া দিলে আবিরকে জড়িয়ে ধরতে চাইতো সে। এতে আবির বিরক্ত হয়ে বীণার অপক্কতার কথা শোনাতো।

বীণার, নিজেতে আর নিজের পরিবারকে নিয়ে থাকার অভ্যেসকে পুঁজি করে একসময় আবির তার পরিবারের কাছেও বীণাকে ‘অসামাজিক’ হিসেবে সাব্যস্ত করে। নিজেকে ছোট করা হবে ভেবে কখনোই কিছু বাবা-মা বা অন্যকে জানায়নি বীণা। নিজের মধ্যেই সব চেপে রেখে থেকেছে। ক্রমাগত নিজের অযোগ্যতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে, না পেলে নিজের থেকে একটি অযোগ্যতা দাঁড় করিয়ে তার সংশোধন করেছে সর্বোচ্চ মানদণ্ডে। তবুও আবিরের সহানুভূতি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে সে। বরং শত অত্যাচার করেও সবার কাছে আবির ভালো পাত্র হিসেবে সমৃদ্ধি পেয়েছে। সেপারেশনের পর বীণার মুখে আবির সর্ম্পকে নতুন কথা শুনে অনেকেই তাই সহানুভূতির পাশাপাশি উল্টো প্রশ্নও তুলেছে।

জয়ার বিষয়টি জানতে পারাটা যেন অপরাধ ছিল বীণার। প্রথম প্রথম অভিযোগ এবং পরে প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর আসেনি আবিরের কাছ থেকে। বরং এতদিন অগোচরে হয়ে আসা আবিরের বিভিন্ন কার্যক্রম ঘোষণা দিয়ে সম্পন্ন করার অনুষঙ্গ সৃষ্টি হয়। এরপর ছয় মাস নিজেকে ‘নারী’ ভাবাটাই বাদ দিয়ে রেখেছিল বীণা। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই নিজের দোষ ঢাকতে বীণার রুচি আর চরিত্রের বিষয়ে আবির ক্রমাগত প্রশ্ন তুলে গেছে। যা সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে বীণাকে। এরপর বিচ্ছেদটা সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র।

বীণা কখনো বিনা ছাতায় ভিজতে চায়নি। যদিও একাকিনী মহিলা হয়ে প্রতিপদে হোঁচট খেতে খেতে আবার সামলে দাঁড়িয়েছে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি বা দৃষ্টিতারল্য, প্রতি মোড়ে মোড়ে দৃষ্টিগোচর হয়েছে বীণার। একসময় এসব কিছু মানিয়ে নেয় সে। গত একটি বছর তার কেটেছে আত্মসম্মোহনে। উচিত-অনুচিত, অভাব-প্রাপ্তি, অনেক অনুভূতির ঐক্যতানে। এরপর ইতিহাস এবং বর্তমানের অর্থ তুলনায় এনে ভবিষ্যতের লক্ষ্য স্থির করার সময়ে এসে সে আবিষ্কার করল, জীবনটা অনেক সমস্যার জটিল পাটিগণিত হয়ে গেছে।

বীণার ফ্ল্যাটের উল্টো দিকে থাকেন মিসেস শিরিন আজমল। আজমল সাহেব কাজ করেন আয়কর বিভাগের উঁচু পদে। আজমল সাহেবের বেশভুষা আর এই চল্লিশেও মিসেস শিরিনের গালের লালিমা দেখে তাদের সংসারের প্রাচুর্য সহজেই চোখে পড়ে। পরিবারটির সঙ্গে বীণাদের সামাজিক আত্মীয়তার সর্ম্পক সেই প্রথম থেকেই। তবে মিসেস শিরিনের বীণার সম্পর্ক ঠিক কিসের গত পাঁচ বছরেও আবিষ্কার করতে পারেনি বীণা। ভালোবাসার নাকি ঘৃণার? প্রতিবেশীসুলভ নয়, এ কথা ঠিক ঠিক জানে বীণা। আবিরের সঙ্গে বিকেলের পর বিকেল দাঁড়িয়ে গল্প করলেও বীণার সঙ্গে সামাজিক দুয়েকটি কথা ছাড়া আর কোনো বাক্য বিনিময় হয় না। ইদানিং তা বন্ধ হয়ে গেছে কোনো এক অদৃশ্য কারণে। তবে স্ত্রীর আচরণের তুলনায় সম্পূর্ণ বৈপরিত্য এসেছে আজমল সাহেবের। গত একটি বছর অনেক সাহস জুগিয়েছেন তিনি বীণাকে। অকাতরে আইনি পরামর্শ দিয়েছেন। বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, ‘বীণার এখন হালছাড়া ডিঙার বিপদ’। আবার এটাও বুঝাতে চেয়েছেন, ‘জীবন কিন্তু আইনের ধারা উপধারা নয়, শুধু জটিল সমীকরণের ধাঁধা নয়।’ কিছু ক্ষেত্রে তিনি বুঝাতে সক্ষম হলেও, বীণা ইচ্ছে করেই কখনো বিজ্ঞের সংকেত দেয়নি। এ সময়ে স্বল্প পরিচিত বা হঠাৎ পরিচিত অনেকের কাছ থেকেও অনেক পরামর্শ পেয়েছে বীণা। এসব দেখে দেখে অনেক দেরিতে হলেও সে বুঝতে পেরেছিল, কত অচেনা বন্দর বেয়ে একই জল বয়ে যায়; রং বদলায়, গতি বদলায়। নানান জনের বুদ্ধি শুনে শুনে সে বুঝেছে, ‘গদির ব্যবসায়ী, দোকানের মালিক, বোদ্ধা প্রকাশক, একটি ব্যাপারে সবাই সাম্যবাদী- তুমি একাকিনী, আমার অর্থ আছে; দরকার নম্র সহচরী। তবে অলিখিত চুক্তির আভাস।’

আজমল সাহেবের পরামর্শেই মামলায় গিয়েছিল বীণা। অর্থ বা ভরণপোষনের জন্য নয়, নিজের প্রথম সন্তান সামিয়াকে কাছে পেতে। কিন্তু কদিন পরেই সে বুঝেছিল, ব্যাপারটা এত সহজ নয়, চাহিদার অনুভূতি যেখানে নানা বাঁকের ধাক্কায় গতিহীন। আইন শুভঙ্করীর চেয়েও জটিল, গাধার পান করার আগের ঘোলা জল। সময় এগিয়ে গেছে, সমাধান আড়ালেই থেকে গেছে। রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা এসব মোকাবেলা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। যেন অভিব্যক্তিগুলো নিজেরাই নিস্তেজ হয়ে গেছে। দিনের পর দিন মাথার ওপর আদালতের সিলিং ফ্যান খটখট আওয়াজে ঘুরেছে, অথচ বীণার কোনো বিরক্তি আসেনি। এখন আবিরকে দেখেও ঘৃণা নেই। কোনো অনুভূতিও হয় না। দাম্পত্যজীবনটা স্বাভাবিক নিয়মে তার কাছে এখন যেন ফ্রেমে আঁটা ছবি হয়ে গেছে। তার তিনকাল এখন একই সুরে বাঁধা তান-স্মৃতি, নিছক হেয়ালী; একাকিত্ব, করুণাময়; পদক্ষেপ, যন্ত্রণাবিদ্ধ।

আজ আদালতের চূড়ান্ত রায় শুনে এসেছে বীণা। সামিয়াকে আর পাচ্ছে না সে। বেডরুমের মতো আদালতেও বীণাকে টেনে রাস্তায় এনেছিল আবির। ভরা মজলিসে অপমানজনক কথাগুলো শুনে যেন কাঠ হয়ে গিয়েছিল সে। দাম্পত্য জীবনটাকে অন্যের হাসির খোরাক করতে চায়নি বলে আবিরকে শেষবারের মতো বাজারি হিসেবে উপস্থাপন করেনি বীণা। তাই নীবর থেকেছে। বিফল হয়ে বিকেলে বাসায় ফেরার পরও কিছুতেই ভুলতে পারছে না, তার চোখের দিকে তাকিয়ে জড়তাহীন আবির মিথ্যে অপবাদ দিয়ে গেছে তাকে।

তারপর থেকেই পৃথিবীটা ঘুরছে বীণার কাছে। সবকিছু মনে হচ্ছে বিরক্তিকর। কতক্ষণ যে চুপ করে খাটের কিণারে বসে ছিল সে বুঝতেই পারেনি। সম্পা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরায় চিন্তার আকাশ ছুটি নেয়। টিচার চলে গেছে। দরজা বন্ধ করার শব্দ পায় সে। সামনে তাকিয়ে দেখে কফির মগ টেবিলে রাখা। পারভিন কখন দিয়ে গেছে খেয়ালই করেনি সে।

বসা থেকে উঠে সম্পাকে নাস্তা বানিয়ে খাওয়ায়। সম্পাকে খাইয়ে দিতে গিয়ে উপলদ্ধি হয়, গতকাল সন্ধ্যে থেকে সে কিছুই খায়নি কয়েক মগ কফি ছাড়া। পরে নুডুলস খেতে গিয়ে বমি হয়েছে। তখন থেকে নিস্তেজ শরীরে খাটে পড়ে আছে বীণা।

রাত আটটার দিকে বিনা নোটিশে আজমল সাহেব কলিং বেল বাজায়, বিনা কারণে তৈরি করা উসিলায়। পারভিন দরজা খুলেছে। নেতিয়ে পড়া শরীর টানতে টানতে ড্রয়িং রুমে এসে বসে বীণা। আজমল সাহেব অপ্রয়োজনীয় আলাপ জুড়ে বসে। ‘মিসেস দুপুরে কোথায় যেন বেরিয়েছেন?’ ‘সময় কাটছে না?’ ‘মামলা সম্বন্ধে জরুরি কিছু আলোচনা আছে। আপনাকে জানানো দরকার।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

বীণার বুঝতে বাকী থাকে না, একাকিনী মহিলা মানেই যে নিতান্তই অসহায়া। এক এক বছরে অনেক কিছুর অভাববোধ হলেও জ্ঞান বিতরণ করা মানুষের অভাব হয়নি তার। যত দিন যাচ্ছে যেন তার হিতাকাঙক্ষী বাড়ছে। হাউজিং-এর সেক্রেটারি, ডাক্তার সাহেব, তিনতলার মেধাবী ছাত্র শিশির, এমনকি গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মোজাম্মেলও। তবে তাদের তুলনায় আজমল সাহেব একটু কাছের। দীর্ঘদিন আইনি পরামর্শ দেয়ার সুবাদে কিছুটা আলোচনার জড়তা কেটেছে। যদিও আজমল সাহেব স্ত্রীর চোখ বাঁচিয়ে যতটা সম্ভব, ঠিক ততটাই সহানুভূতিশীল; অত্যন্ত ভদ্র পরিশীলিত মানুষের কাছে যতটা ভদ্রতা আশা করা যায়। অহেতুক কৌতূহল থাকলেও মাপকাঠি মেপে চলা বোদ্ধাবিশেষ মানুষ। তবে কোনো একটা দ্বন্দ্বে যে আজমল সাহেব ভুগছেন, বীণা নারীসুলভ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বেতারে বুঝতে পারে। বুঝতে পারলেও পাত্তা দেয় না। কারণ তার যথেষ্ট আত্মসম্মান আছে, সে অহেতুক কৃতজ্ঞতাবোধের পীড়নে জীবনকে আর জটিল করতে চায় না।

সোফায় আরাম করে বসতে বসতে অভিভাবকসুলভ ভঙ্গিতে আজমল সাহেব বলেন, ‘কী ঠিক করলেন মিসেস বীণা?’

‘আর মামলায় যেতে চাইছি না আমি। কোনো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।’

‘তার মানে, মেয়ের আশা ছেড়ে দিবেন?’

‘ছেড়ে তো অনেক কিছুই দিয়েছি। সৃষ্টিকর্তা চাইলে মেয়েকে ফিরে পাবো, আর কি করার আছে?’

‘এখনো অনেক কিছু করার আছে। আমি আপনাকে সাহায্য করবো।’

আজমল সাহেবের কথায় শুধু সহানুভূতি নয়, ষোড়শী বালিকাকে মানানোর স্বরও যেন উথলে পড়ে। কোমল-নিচু স্বরে কথা বলেন আজমল সাহেব। বীণার একবার আজমল সাহেবের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়।

‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না। যা হওয়ার তা-ই হবে। আমার হাতে তো সব সমাধান না!’

‘এরকম ভাবে ছেড়ে দেয়া নৈতিক অপরাধ। তাছাড়া তোমার সারাটা জীবন পড়ে আছে। একটু ভেবে দেখো!’

হঠাৎ করে ‘তুমি’ সম্বোধনে বীণা অবাক হয় না। বাঘবন্দির খেলায় এরকমই হয়, প্রত্যাশিত। প্রথমে ভদ্রতা, পরে অন্তরঙ্গ, অনুষঙ্গ; আরও পরে...। আর ভাবতে পারে না বীণা। কল্পনার চরমে ভূমিকম্প, কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। মস্তিষ্কের সব বার্তা অনুভূতির দরজায় থামিয়ে দেয়। চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে সে।

বীণার নীরবতা আজমল সাহেবের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষায় যেন ধাক্কা খায়। দৃষ্টি সহজ ও বার্তাবহ স্বরে কিছু বলতে গিয়ে হাত এগিয়ে দেন আজমল সাহেব। বীণার হাঁটুতে হাত রাখেন। নিমিষেই বীণার পৃথিবী থমকে যায়। বোবা দৃষ্টি নিয়ে আজমল সাহেবের দিকে তাকায়। আজমল সাহেব যেন চোখ-মুখের ইশারায় সব সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। এতদিনের আশঙ্কা হঠাৎ সত্যি হয়ে সামনে এসে দাঁড়ানোর ধাক্কায় বেসামাল হয়ে পড়ে বীণা। চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না। এক ঝটকায় দৌড়ে রুমে এসে খাটে উপুড় হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে।



 রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়