ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের গল্প || ক্ষত

ইভান অনিরুদ্ধ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধের গল্প || ক্ষত

ইভান অনিরুদ্ধ

অন্ধকারে পথ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। তবু আমার চিনতে অসুবিধা হয়নি। হেমন্তের রাত। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। বাড়িটার আশপাশের  দুই-তিন ঘরে মানুষজনের সাড়া শব্দ নাই। গ্রামজুড়ে অদ্ভুত নীরবতা। যুদ্ধ শেষ হয়েছে একমাস হলো। কিন্তু এই নীরবতাটুকু আমার কাছে যুদ্ধের ভয়াবহতার চেয়েও বেশি মনে হচ্ছে।

যুদ্ধের নয়মাস আমি কেবল রাহেলার কথা মনে করেই বেঁচে ছিলাম। জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে পাকিস্তানি নরপশুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। যুদ্ধ শেষ করে এখনো তার জন্যেই বেঁচে আছি। যখন রাজুরবাজারের যুদ্ধে বাঁ হাতের কবজিতে গুলি খেলাম তখনো আমি রাহেলার মুখটা মনে করার চেষ্টা করেছি। আজ নয়মাস পর আবার রাহেলাদের বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়িয়েছি কেবল তার জন্যই।

খুব আস্তে করে ঘরের টিনের দরজায় আওয়াজ করলাম কয়েকবার। ভেতরে কেউ একজন দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে ঘা দিয়ে কুপি বাতি ধরালো। কে হতে পারে মানুষটা? রাহেলা নাকি চাচী? যুদ্ধে চলে যাবার সপ্তাহ দুয়েক পরেই জেনেছিলাম, রাহেলার বাবা আবু চাচাকে মিলিটারি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে ইদ্রিস মেম্বারের লোকজন। লাশের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমি ছিলাম রাহেলার জায়গীর মাস্টার। এই বাড়িতে থেকেই  রাহেলাকে পড়াতাম। যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন রাহেলা ক্লাশ নাইনে পড়ে।

চাচী আর আবু চাচা আমাকে নিজের সন্তানের চেয়ে আপন ভাবতেন। তাদের ইচ্ছে ছিল রাহেলা ম্যাট্রিক পাশ করলেই আমার সাথে তার বিয়ে দেবেন। এই কথাটা আমি জানতাম, রাহেলাও জানতো। কিন্তু আমি যুদ্ধে চলে গেলে সব পরিকল্পনা থেমে যায় । মরচে ধরা দরজার কব্জায় একটা অদ্ভুত আওয়াজ হলো। চাচী কুপি বাতিটা নিয়ে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আমি কাছে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। কুপি বাতির অন্ধকারে তিনি আমার মুখটা  ভালোমতো ঠাহর করতে পারেননি।

তুমি ক্যালা?

চাচী, আমি ফরিদ।

আমার কথা শুনেই তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। আমাকে জড়িয়ে নিলেন বুকের সাথে।

বাবারে, আল্লাহ আমারে বাঁচাইয়া রাখছে তোর মুখটা দেহনের লাইজ্ঞিয়া।

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। হেমন্তের ঠান্ডা হাওয়া কুপির শিখা উড়িয়ে নিতে চাইছে। কিছুক্ষণ পর সাদা রঙের একটা বিড়াল করুণ আওয়াজ করে চাচীর পায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। তিনি কিছুটা উবু হয়ে বিড়ালটাকে পরম মমতায় কোলে তুলে নিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ফরিদ, বাজান আমার, তুই কি বিলাইডারে চিনছস? এইডা কিন্তু তোরে ঠিকই চিনছে। এরা সহজে কেউরে ভুলে না। আমি চাচীর কথায় এখন সব মনে করতে পারছি। সব কিছু আমার চোখের সামনে ভাসছে।

রাতের বেলা রাহেলা যখন আমাকে টেবিলে খাবার দিতো তখন এক দৌড়ে এই সাদা বিড়ালটা আমার পায়ের কাছে এসে মুখ ঘষতো। আমি ভাতের প্রথম নলাটা বিড়ালকে দিয়ে খাওয়া শুরু করতাম। তা দেখে রাহেলা মজা করে বলতো, ফরিদ ভাই,বিলাইডা কি আফনের শালা-সমন্দি লাগে? এইডারে আফনে যে আদর করুইন, তার অর্ধেক আদর যদি আমারে দিতাইন। এই কথা বলে রাহেলা মুখ টিপে হাসে। আমি ভাতের নলা মুখে দিয়ে বলি, ভালোভাবে ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা পাশ করো। তারপর আমার সব আদর-ভালোবাসা তোমাকে দেব সারা জীবনের জন্য।

আমার কথায় রাহেলা পাল্টা প্রশ্ন করে- পরীক্ষায় ফেল করলে কি আফনে অন্য কেউরে এই আদর ভালোবাসা দিবাইন?

তার কথায় আমার গলায় ভাত আটকে যায়। আমি বিষম খেয়ে ফেলি। এক ঢোঁক পানি খেয়ে বলি, দিতেও তো পারি। আমাদের দুজনের এই কথার মাঝখানে রান্নাঘর থেকে চাচী রাহেলাকে ডাকেন- অ্যাই ছেরি, ফরিদরে এক গেলাইস দুধ দে। রাহেলা আমার জন্য দুধ ভর্তি গ্লাস এনে টেবিলের উপর রাখে। সেই দুধ থেকে খানিকটা আমি বিড়ালটাকে খাওয়াই। বিড়ালের জন্য আমার এই দরদ দেখে রাহেলার হাসি আর থামে না। তার হাসি দেখে আমিও ভাত খাওয়া বন্ধ রেখে হাসি।

বারান্দা থেকে উঠে আমি আর চাচী ঘরের ভেতরে যাই। কুপি বাতিটা টেবিলের এক কোণায় রেখে তিনি আমার জন্য ভাতের থালা ধুতে থাকেন। নরম গলায় বলেন, ফাইতলার ভিত্রে দুইলা ভাত-ছালুন রইছে। তুই হাত মুখ ধুইয়া খাইয়া ল বাজান।

আমি তাকে বললাম, খিদে নেই। রাতে না খেলেও চলবে। চাচী তবু আমার জন্য ভাত আর তরকারি পাতিল থেকে থালায় তুলে দেন। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। যেদিকে তাকাই কেবল রাহেলার মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এই বুঝি রাহেলা আমার সামনে এসে এক্ষুণি বলবে, ফরিদ ভাই, আজকে আর বইয়ের পড়া পড়বো না। আফনে আমারে একটা গান গাইয়া শোনাইন। আমি রাজি না হলে সে হাত ধরে আমাকে তার ঘরে নিয়ে যেত। রাহেলার আবদার আমি উপেক্ষা করতে পারতাম না। খালি গলায় নিচু স্বরে গাইতাম- ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা...’।

রাহেলা তন্ময় হয়ে আমার বেসুরো গলার গান শুনতো আর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতো। আমি গান থামিয়ে তার হাত ধরে বলতাম, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি রাহেলা। তোমাকে ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কিচ্ছু চাই না। সে আমার গাল টেনে বলতো- এইতা  কি আফনের মনের কথা নাকি মুখের কথা?

আমি ফিসফিস করে বলতাম- মনের কথা। একেবারে হৃদয়ের গভীরের কথা।

ভাত খাওয়া শেষ হলে আমি চাচীকে বললাম, রাহেলার কথা তো আপনি কিছুই বলছেন না। আবু চাচার খবর জানি। কিন্তু রাহেলার কথা আমি কিছুই জানি না। এই কথায় তিনি অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন, বাজানরে, আমার দুঃখের শেষ নাই। আল্লায় যদি আমার মরণ দিতো তাইলে এই যন্ত্রণা থাইক্কা মুক্তি পাইতাম। চাচী কিছুটা দম নিয়ে বলতে থাকেন- তোর চাচারে মাগরিবের আজানের ওয়াক্ত মিলিটারি ধইরা লইয়া গেছে। ইদ্রিস মেম্বর মিলিটারির সাথে আছিন। হেই ক্যাম্পে গিয়া কইছে তোর চাচা অইলো মুক্তিবাহিনীর লোক। আর তুই যে মিলিটারির বিপক্ষে যুদ্ধে গেছস, এই খবরও ইদ্রিস মেম্বর কুত্তার বাচ্চাগো কইছে।

আমি অধৈর্য্য হয়ে চাচীকে জিজ্ঞেস করি- রাহেলার কী হয়েছিলো?

চাচী পানের বাটা একপাশে সরিয়ে রেখে বলতে থাকেন- তোর চাচা মারা যাওনের তিন দিনের মাথায় ইদ্রিস মেম্বর আমার কাছে আইছে। সে পাঁচগণ্ডা পান, এক পোয়া সুপারি, আর এক কেজি বাতাসা লইয়া আমার সামনে হাজির। তারপর হাসতে হাসতে কইলো, এতদিন আমি আফনেরে ভাবীসাব ডাকতাম। আইজ থাইক্কিয়া আফনে অইলেন আমার শাশুড়ি। আমি কইলমা পইড়া রাহেলারে বউ কইরা ঘরে তুলবার চাই।

আমি নির্লিপ্তভাবে জিজ্ঞেস করি-তারপর?

আঁচল দিয়ে চোখ মুছে চাচী বলেন, আমি এই কথায় কেবল একটা চিক্কর দিয়া মাছ কাটারদা’ডা তার মুখের সামনে ধরছি। সে শয়তানের লাহান একটা হাসি দিয়া আমার হাত থাইক্কিয়া দা লইয়া রাহেলার দিকে আগাইয়া গেছে। ভাবীসাব, আফনে যদি আমার প্রস্তাবে রাজি না অইন, তাইলে আইজ রাইতের মধ্যে রাহেলারে মিলিটারি ক্যাম্পে লইয়া যাইয়াম। মিলিটারি আফনের কচি মাইয়াডারে ফালা ফালা কইরা দিবো। আর আমার কাছে যদি তারে তুইল্লিয়া দেইন, তয় সারা জীবন সুখে থাকবো। আমার আর কোন কথা কওনের নাইরে ফরিদ, কওনের নাই।

চাচী দুই হাতে কপাল চাপড়িয়ে আহাজারি করতে লাগলেন। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আসলেই আমার ভাগ্য খারাপ। আপনাদের কোনো দোষ নাই। চাচী আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, বাজান তুই আমারে মাফ কইরা দে। আমি তোর লাইজ্ঞিয়া কিছুই করতে পারলাম না। না পারলাম রাহেলারে রক্ষা করতে, না পারলাম তোর জীবনডারে সুন্দর করতে। এই যুদ্ধই সব শ্যাষ কইরা দিছে, সব শ্যাষ কইরা দিছে। আমি চাচীর দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে বললাম, জীবনে সব হারাইছি। কিন্তু একটা স্বাধীন বাংলাদেশ তো পাইছি। এরচেয়ে বড় সান্ত্বনা আর কী আছে আমার!

চাচী আমাকে দুই হাতে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ম্যালা রাইত অইছে বাজান, শুইয়া পড়। তোর কথাই ঠিক বাজান। একটা স্বাধীন দেশ পাইছি আমরা। চাচীর কথা মতো চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাবছি রাতটা কোনোভাবে রাহেলাদের বাড়িতে কাটিয়ে খুব সকালে চলে যাবো এখান থেকে। কোথায় যাবো জানি না। আপন বলতে কোথাও আমার কেউ নেই। থাকার মধ্যে কেবল রাহেলাই ছিল আমার সব। বেঁচে থাকার  একমাত্র স্বপ্ন, ভালোবাসা। এখন  যেহেতু রাহেলা নেই, তাহলে কেন আমি এই বাড়িতে পড়ে থাকবো? রাহেলা তো পরিস্থিতির শিকার হয়ে ইদ্রিস মেম্বারের ঘর সংসার করছে। এখন সেই সংসার তছনছ করে দিলে আমি কি রাহেলাকে আমার মত করে পাবো? পাবো না। তারচেয়ে সে সুখে থাকুক, শান্তিতে থাকুক। যদিও আমার খুব ইচ্ছে করছে আগামীকাল সকালে ইদ্রিস মেম্বারের বাড়ি গিয়ে রাহেলার মুখটা এক নজর দেখে আসতে। ইচ্ছে করছে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে সর্বস্ব দিয়ে!

হায়রে!দেশ স্বাধীন করেছি লড়াই করে, কিন্তু রাহেলাকে রক্ষা করতে পারলাম না। তাকে হারালাম সারা জীবনের জন্য। এই আক্ষেপ নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। সান্ত্বনা এই, আমার রাহেলা অন্তত বেঁচে আছে, হোক সে ইদ্রিস মেম্বারের বউ। অথচ তার মত কত হাজার, লক্ষ রাহেলা দেশের সম্মান বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। পাকবাহিনী, রাজাকারের হাতে সম্ভ্রম দিতে বাধ্য হয়েছে।  কিন্তু রাহেলা আমার অস্তিত্ব জুড়ে আছে এবং আমৃত্যু থাকবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়