ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের গল্প || পরাধীন দেশের স্বাধীন মানুষগুলো

মোজাফ্‌ফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৯, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধের গল্প || পরাধীন দেশের স্বাধীন মানুষগুলো

অলঙ্করণ : শতাব্দী জাহিদ

|| মোজাফ্‌ফর হোসেন || 

মজিদ বাতাসে গন্ধ শুঁকে শুঁকে সামনের দিকে এগোতে থাকে। পেছনের কারো চলার শব্দ আসে কানে। মজিদ থামে। ‘ভাই, আমার চোখ দুটো দেখেছেন? চোখ ছাড়া খুব অসুবিধা হচ্ছে চলতে।’ মজিদ জিজ্ঞাসা করে পেছনের অজ্ঞাত অনুসারীকে। কোনো উত্তর আসে না। মজিদের চোখজোড়া যখন মরচে পড়া চাকু দিয়ে তুলে নেওয়া হয় তখনই সে জ্ঞান হারায়। এরপর যখন জেগে ওঠে, সে জানে না মৃত-না-জীবিত। সে শুধু মনে করতে পারে বাড়ি ছাড়ার সময় কবুতরের খোপটা খোলা হয়নি। একটু থেমে আরও একবার জানতে চায় সে। উত্তর না পেয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘না দেখলে বলেন, হাঁটা শুরু করি। এভাবে গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকলে তো আর বাড়িতে পৌঁছাতে পারব না। কবুতরগুলো ছেড়ে আসিনি।’

‘মা কথা বলতে পারবে না। জিবটা কেটে নিয়েছে।’ পেছন থেকে এক কিশোরকণ্ঠ উত্তর দেয়। 

মজিদ কিছু বলার জন্য মুখটা কিঞ্চিত আলগা করে, আবার বন্ধ করে হাঁটতে থাকে সামনে।

‘আমরা অনেক পেছনে কয়েক জোড়া চোখ পড়ে থাকতে দেখেছি। তার ভেতর আপনার দুটো ছিল কিনা বলতে পারব না।’ ছেলেটি উত্তর দেয়।

‘পেছনে? থাক তাহলে। কবুতরের খাঁচাটা খোলা হয়েছে কিনা জানি না। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। পেছনে ফিরে আর সময় নষ্ট করতে চাই না।’ মজিদ দ্রুত পায়ে এগুতে থাকে সামনে। পেছনে পেছনে তাল দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে কিশোর আর কিশোরের মাঝবয়সী মা। কিশোরের মায়ের জিবটা কাটা হয়েছে গতকাল বা তার আগের দিন। মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে পড়তে গাল এবং চিবুকে শুকিয়ে কালো দাগ হয়ে আছে। যখন তাকে ধর্ষণ করা হচ্ছিলো তখন এত জোরে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল যে পেছন থেকে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক একজন কোচর থেকে চাকু বের করে আরও দু’জনের সহযোগিতা নিয়ে কেটে ফেললো। মুহূর্তেই তার চিৎকার বন্ধ। সেই থেকে কথাও।

‘নাম কী? কোন্ গাঁয়ের?’ হাঁটতে হাঁটতে মজিদ জিজ্ঞাসা করে।

‘আমার নাম সুরত। মায়ের নাম জেনে আর কি হবে! মা তো আর নাম ধরে ডাকলেই উত্তর দিতে পারবে না।’ ছেলেটি বলে।

‘তোমাকে খুব বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। কোন ক্লাসে পড়ো, মানে পড়তে?’ মজিদ জিজ্ঞাসা করে।

‘সেভেনে।’ ছেলেটি উত্তর দেয়।

‘কোন বাড়ির ছেলে?’

‘মনে পড়ছে না। মাথায় বেয়োনেট দিয়ে এমন করে খুঁচিয়েছে, মগজের অর্ধেকটা বের হয়ে গেছে, তারপর থেকে অনেককিছু মনে পড়ছে না। গাঁয়ের পথ, বাবার চেহারা, সঙ্গে ভাইবোন কেউ ছিল কিনা- কিছুই মনে করতে পারছি না। এই জন্য আপনাদের অনুসরণ করছি আমরা।’ সুরত বলে।

‘আর কেউ আছে পেছনে?’ জানতে চায় মজিদ।

‘আছে। সারি সারি লোক। যেভাবে আমরা গিয়েছিলাম সারি ধরে সেভাবেই ফিরছে সকলে।’ 

‘কেবল দেহটা ঠিক মতো নেই কারো।’ সামনে থেকে উত্তর দেয় একজন। এতক্ষণ তার উপস্থিতি টের পায়নি মজিদ। ফসলহীন খাঁ খাঁ মাঠ। চৈত্রের রোদে মাঝে মাঝে গোল পাকিয়ে ধুলো ওড়াউড়ির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ আসে না কানে। এইটুকুও টের না পেলে চোখের সাথে সাথে কান দুটোও গেছে বলে ধরে নিতে পারত সে।

‘আপনার বাড়ি কোথায়?’ সামনের জনকে জিজ্ঞাসা করে মজিদ।

‘গফুর। গফুরচাচা।’ সামনের জন উত্তর করে।

‘ওহ, চাচা! গলা শুনে চেনার জো নেই।’

‘আমি তো তোকে দেখেও চিনতে পারছি না।’ গফুর সামনে থেকে উত্তর দেয়।

‘নিশ্চিন্তপুরের আর কেউ আছে চাচা?’ মজিদ জিজ্ঞাসা করে। 

‘শরীর দেখে ঠাওর হচ্ছে না। তবে থাকার কথা।’ 

‘ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে যাচ্ছে।’ গফুর বলে। ‘নিশ্চিহ্নে।’ কিছুক্ষণ থেমে যোগ করে সে।

‘শুনলাম গাঁয়ে ওরা ক্যাম্প বসিয়েছে।’ অন্য একটা কণ্ঠ বলে।

‘যারা আমাদের সাথে আসেনি, ঘরের মায়া ছাড়তে পারেনি, ভেবেছিল কিছু হবে না, তাদের কাউকেই ওরা নাকি জ্যান্ত রাখেনি।’ আরেকজন বলে।

‘বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিয়েছে।’ কেউ একজন বলে।

‘আমাদের পালিয়েই কি এমন লাভ হলো, সেই তো ফিরে আসতে হচ্ছে।’ মজিদ বলে। 

‘লাভের লাভ এখন আর আমাদের কিছু হারানোর ভয় নেই।’ একটা নারীকণ্ঠ বলে। এরপর সে একটানা সুর করে বলেই চলে, ‘এখন আর আমাদের হারানোর কিছু নেই। এখন আর আমাদের হারানোর কিছু নেই।’ আরও কয়েকটা নারীকণ্ঠ তাল দেয়- ‘এখন আর আমাদের হারানোর কিছু নেই।’

এতক্ষণে নারীকণ্ঠ শোনে মজিদ। নিজের বোনের কথা মনে পড়ে তার। বউয়ের কথাও। মা এবং মেয়ের কথাও। পরিপূর্ণ সংসার ছিল তার। এখন সে ফিরে যাচ্ছে একাই। কিংবা এই ঘরে ফেরার লম্বা লাইনে হয়ত তারাও আছে কোথাও- মজিদের সামনে কিংবা পেছনে। একসঙ্গেই দলবেঁধে পাড়ি দিয়েছিল তেহট্টির সীমান্তের দিকে। একটা দুটো পরিবার তো নয়, শত শত পরিবার, হাজার হাজার মানুষ। গরু-ছাগলও সঙ্গে নিয়েছিল কেউ কেউ। রাতের অন্ধকারে পথ ধরেছিল। কিন্তু নিজেদের ভেতর কেউ একজন ইনফরমার ছিল, একজন কিংবা আরও কয়েকজন, তথ্যটা ফাঁস করে দিয়েছে। নৈঃশব্দে ঝলসে উঠেছে বারুদ- মানুষের চিৎকার আর গুলির শব্দ মিশে গেছে অন্ধকার আর শঙ্কা যেভাবে মিশে একাকার হয়ে ছিল। বৃদ্ধ মা, সেয়ানা বোন, স্ত্রী ও মেয়েকে তেহট্টির ওপারে শরণার্থী শিবিরে রেখে সংক্ষিপ্ত ট্রেইনিংটা শেষ করে যুদ্ধে অংশ নিতো মজিদ। মজিদের মতো আরও শত শত পুরুষ। কোথাও কোথাও মেয়েরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। নিজেদের ভেতর থেকে তথ্যটা ফাঁস করে দিলো কেউ।

‘শ্যালা নাফরমানের বাচ্চা নাফরমান। ট্রেইনিংটা শেষ করে আসতে পারলে আগে ওদের ঘাড় মটকাতাম!’ মজিদ চিৎকার করে বলে ওঠে। 

‘যারা পৌঁছাতে পেরেছে ওপারে, তারা ভালো আছে। আমার ভাই ও তার পরিবার ঠিক মতো পৌঁছানোর খবর পেয়েই আমরা রওনা হয়েছিলাম।’ একজন পাশ থেকে বলে।

‘সব্বাই ভালো নেই। মরণ ওখানেও আছে।’ এক নারীকণ্ঠ বলে।

‘জন্ম দিতে গিয়ে শিশুটা আটকে গেল। কোলের দুটো গেল কলেরাতে। ওদের নিয়ে আমিও ফেরার মিছিলে যোগ দিয়েছি।’ অল্পবয়সী এক নারীকণ্ঠ যোগ দেয় আলাপে।

‘শরণার্থী শিবির থেকে আর কেউ কি আছে দলে?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে গফুর। নিজে কয়েকদিন আগে বৃদ্ধ মা, ছেলের বউ ও নাতিকে রেখে এসেছিল নিজে। সেদিন রাতে আবার যাচ্ছিল বউ আর মেয়েকে রাখতে।

‘অনেকেই আছে। শত শত মানুষ আছে। এখন আর আলাদা করে কি হবে!’ নারীকণ্ঠ উত্তর দেয়।

‘আমার তো একটা পা নেই। একটুখানি বেঁধে ছিল এতটা পথ হাঁটতে হাঁটতে খসে পড়েছে। আর হাঁটতে পারি না; কেউ নেবে আমাকে?’ দূরে একটা কিশোর কাতরশূন্য কণ্ঠে বলে।

‘কাঁধ তো আর কারও খালি দেখছি না। আমার কাঁধে আয়। বয়স হয়েছে। তাও দেখি কতটা পারি।’ একটা মুরব্বি কণ্ঠ উত্তর দেয় কাছে গিয়ে।

‘আমার কবুতরের খাঁচাটা কি ছেড়েছিলাম? যদি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় তো ভালো। না দিলে দানা-পানি না খেয়ে এখনো বেঁচে আছে কিনা কে জানে?’ মজিদ বলে।

‘মানুষের জীবন নিয়ে টানাটানি, পশুপাখির কথা কে ভাববে? আমার গোয়ালের গরুগুলো মতির মা আগের দিনই মাঠের ভেতর ছেড়ে দিয়েছিল। মুরগি ছাড়ার কথা ভুলে গেল। সারা রাস্তা সেই কথা বলতে বলতে এসেছে- মুরগিঘর খোলা হলো না। মুরগিঘর খোলা হলো না। এখনো বলছে কিনা কে জানে।’ অচেনা এক কণ্ঠ বলে।

‘এই ভ্যাদা গাঁয়ের কী অবস্থা?’ গফুর চেঁচিয়ে ওঠে দূরে ঝোঁপের আড়ালে অস্ত্র হাতে একদল বাঙালি তরুণকে দেখে। ভ্যাদা গফুরের ছোটভাই। গাঁয়ের ছেলেদের সাথে অপরিচিত কয়েকজন শহুরে ছেলেও আছে। একটা মেয়েকেও দেখা যাচ্ছে ছেলেদের মতো শার্ট-প্যান্ট পরা। ভ্যাদাকে ফের ডাকে গফুর। ওদিক থেকে কোনো সাড়া আসে না। ওরা ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে কিংবা অপেক্ষা করছে অন্ধকারের। ভ্যাদাকে দেখে শূন্য বুকটা ভরে ওঠে গফুরের। নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে দেখে সে, নাড়িভুঁড়ি এমনভাবে বের করে দিয়েছিল হাঁটার সময় কতগুলো অভুক্ত কুকুর টান দিয়ে সব বের করে নিয়েছে।

‘চারিদিক এখন শেয়াল-কুকুর আর নেকড়েদের দখলে। ওরা আসছে! সব আবার আমাদের হয়ে যাবে।’ ভ্যাদাদের দেখিয়ে সকলকে উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে বলে গফুর।  

গ্রামে পৌঁছে যায় ওরা। প্রতিদিনই কেউ না কেউ ফিরছে। কিছু মানুষ আগে থেকেই ছিল গাঁয়ে। কারো শরীর আগুনে ঝলসে যাওয়া। কেউ বেয়োনেটের খোঁচায় এফোঁড়-ওফোঁড়। যুদ্ধ আসন্ন হলে ওরা ঘর ছেড়েছিল নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। এখন ফিরে আসছে যুদ্ধের মাঝে। এখন আর ওদের হারানোর কিছু নেই।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়