ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ছোটগল্প || গল্পটা আগেই লেখা হয়েছিল

অলাত এহ্‌সান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩০, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || গল্পটা আগেই লেখা হয়েছিল

|| অলাত এহ্‌সান ||


আমার নেয়া একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে বিতর্ক চূড়ান্তে উঠলে শহরটা একেবারে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। এমন সময় আমার বহু পুরনো একটা স্ট্যাটাসের স্কিনশট সাহিত্য বোদ্ধাদের ওয়ালে ওয়ালে ঘুরছিল: ‘দৈনিকের সাহিত্য পাতাগুলো এখন গ্রুপ লিটল ম্যাগাজিনে পরিণত হয়েছে আর অনলাইন পোর্টালের সাহিত্য পরিণত হয়েছে ব্যক্তিগত ব্লগে। আর গোটা সাহিত্য পরিসর আটকে গেছে একটা ক্রিমিনাল সিন্ডিকেটে।’ সাহিত্য করতে আসার আগে এমন বিক্ষুব্ধ স্ট্যাটাস লিখে উঠতি সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে সাহিত্য পাতায় লিখতে গিয়েই গোল বাঁধল। সেদিনের সব সুহৃদরাই আজ লেগেছে আমার পেছনে। ব্যাপারটা এমন- হয় জনসম্মুখে গণপিটুনি দিয়ে মারবে, নয়তো ঘৃণা আর উপেক্ষায় ডুবিয়ে দেবে। তখনই ভেবেছিলাম কয়েকদিনের জন্য হলেও আমাকে ঢাকা ছাড়তে হবে।
বন্ধু এফতুন বলল, নরসিংদীতে নাকি নতুন একটা রিসোর্ট হয়েছে, ‘ক্লে-হাউস’ নামে, খুবই ঘরোয়া পরিবেশ। আমার প্রিয় মাটির ঘরকেই ওরা গেস্ট রুম করেছে।

নরসিংদী ঢাকার খুব কাছেই। একদিনের ভ্রমণের জন্য সুপার! এই জেলার নদীর নামগুলো ভীষণ টানে। কিন্তু ব্যাপারটা যেহেতু একদিনের না, রীতিমতো শরীরের গন্ধ মুছে ফেলার মতো, তাই আমাদের দূরে কোথাও ভাবতে হবে। এফতুনই তখন প্রস্তাব ঘুরিয়ে; খানিকটা রহস্যজনক ভাবেই শ্রীমঙ্গলের কথা বলল। আমার প্রিয় পাহাড় আছে সেখানে এবং তা সবুজ চা-গাছে মোড়া।

টঙ্গী স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠার আগে ও আরেক প্রস্থ রহস্য উন্মোচন করল- আমাদের সঙ্গে রিনি যাচ্ছে।

বিরক্তিকর একটা মেয়ে। অতিমাত্রায় নেচারিয়ালিস্ট। তার ওপর অতিপ্রাকৃতে ওর অধিক বিশ্বাস। এ কারণেই আমাকে ছেড়ে ফাঁকে থাকে। এফতুনের দিকে চোখ ঘুরাতেই প্রায় আত্মসমর্পণ করল- রিনির বাড়ি শ্রীমঙ্গল, ইন্টার্নিতে কয়েক দিনের ছুটি পাওয়ার পর বাড়ি যাচ্ছে। সুতরাং তাকে ফেরাই কী করে? কিন্তু ট্রেনে যে একই কামড়ায় উঠবে তা এফ্তুনের অপেক্ষা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।

ট্রেনে উঠেই রিনি পড়লো আমার নেয়া সাক্ষাৎকার নিয়ে। ‘হুমায়ুন আজাদ কী করে বললেন, বাঙালির আত্মজীবনী হচ্ছে শয়তানের লেখা ফেরেশতার আত্মজীবনী। এর মানে কী?’

‘মানে যদি না-ই বুঝো তা নিয়ে তর্ক জুড়ে দেয়ার কি দরকার ভাই! দলবাজি-তলবাজি না করে আগে বুঝ, তারপরে না হয় তর্ক।’

‘তাহলে এ কথার কাউন্টারে আরেক লেখক কী করে বলেন যে, তাকে কখনো কোনো জ্ঞানী মানুষ মনে হয়নি!’ একেবারে খুনসুটি নিয়ে পড়লো।

এফতুন যে তখনো ঘুমায়নি তার নাক ডাকা থেকেই বুঝতে পারছিলাম। আমাদের তর্ক চূড়ান্তে পৌঁছানোর আগে ও যাত্রা দলের বিবেকের ভূমিকায় সাবধান বাণী নিয়ে আবির্ভূত হলো- ‘ওই, তোরা তর্ক করিস না, ঘুমা। শ্রীমঙ্গল গিয়ে পাহাড় দেখবি না, এখন ঘুমা।’

এর মধ্যে আমি রিনিকে জিজ্ঞেস করেছি, সে নিশ্চিত বাড়ি যাচ্ছে তো? উত্তরটা আশ্বস্ত হওয়ার মতো হওয়ায় বললাম, ‘ওটা হুমায়ুন আজাদের স্বভাবসুলভ প্রহেলিকা, কৌতুকবোধ। ওই কথার আগেই তো তিনি লিখেছেন- আত্মজীবনী লেখার জন্য সততা দরকার হয়। সেই সততা যদি থাকে, তাহলে মানুষের জীবন আবার ফেরেশতার মতো হয় কী করে! সেই ফেরেশতার ইমেজ ভরা জীবন লিখতে গিয়ে পাঠকের কাছে মজাদার করা কী করে?’

রিনির ভয় লেখকের ওই প্রহেলিকা নিয়ে। এই নিয়ে ওর সঙ্গে লাগালাগি। তারপর থেকেই ফাঁক দিয়ে চলে। ও কোথায় থেকে জেনেছে লেখকরা চতুর্কালদর্শী। লেখক অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ দেখতে পান বলে যে প্রচার আছে, তা তো মিথ্যে নয়। কিন্তু ওর কথা হচ্ছে, এসবের বাইরে একটা ঘটনা কী হতে পারতো তা-ও লেখক দেখেন। আর তা লিখেই নাকি মানুষের ভবিষ্যৎ কী হবে তা-ও নির্ধারণ করে দিচ্ছেন।

ও কোথা থেকে এই বিশ্বাস পেয়েছে কে জানে! ওর ধারণা একজন লেখক দুনিয়াতে ‘প্রেরিত পুরুষের’ ভূমিকা পালন করছেন। কিন্তু আমি যে তা নই, সেটাও ওর বোঝা উচিত। ধ্যানের হোক আর জ্ঞানের হোক, আমি কখনোই গল্পের শিল্পিত উপস্থাপন অস্বীকার করি না। আর যৌনতাকে অনুসরণ করলেই এই সমাজের স্বরূপ উন্মোচন সম্ভব বলে মনে করি। তবু রিনির সঙ্গে আমার বেঁধে গেল। ‘লেখকের জীবনই যেখানে চাপাতির নিচে ধুকছে, সেখানে প্রেরিত পুরুষ হওয়ার সুযোগ কোথায়? আর ঈশ্বর হচ্ছেন তিনি, পেছন থেকে তাকে যিনি লেখকের কল্লা বেছে দেন।’- আমি ক্ষোভের সঙ্গে বললাম।

মাঝে মাঝে এফতুন চুলার ওপর শিক-কাবাবের মতো নিজেকে উল্টে-পাল্টে ঘুমিয়ে নিচ্ছিল। ওর উচ্চকিত নাক ডাকার শব্দ কখনো কখনো ট্রেনের শব্দকেই চ্যালেঞ্জে ফেলে দিচ্ছিল। ট্রেন যখন লোহার সেতু পার হচ্ছিল তখনই কেবল পেরে উঠছিল। শ্রীমঙ্গলে থাকার জায়গা ঠিক হয়ে যাওয়ায় ওর ঘুমে জোর বেঁধেছে।

আমরা যাচ্ছি বন্ধু লেওনের বাবার ছোট্ট টি-গার্ডেনে। লেওনই দেখাশোনা করে। ছোটখাটো ভূ-স্বামী আরকি। এর আগে কোথায় যেন একটা গেস্ট হাউস কাম পার্ক করতে গিয়ে গচ্চা খেয়েছে। তারপর আইনি ঝামেলায়ও গড়িয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাকায়ই সব মুশকিল আছান করেছে। লেখক মানুষের এ রকম এক-দুইটা বন্ধু থাকার ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য। রেওয়াজও যেন বা। উর্দু সাহিত্যিক মুলক রাজ আনন্দ তো প্রায়ই তার টি-স্টেটের মালিক, ভূ-স্বামী বন্ধুদের আতিথেয়তা নিয়েছেন, সেখানে বসেই অনেক সাহিত্য রচনা করে তাদের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। পঠন-পাঠন না হোক, লেখক-কবিদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে সাহিত্যের উষ্ণতায় বাড়িটা সেঁকে নেয়া আরকি। এ দিক দিয়ে আমাদের লেখকরা উদার হস্ত। কাউকে সাক্ষাৎ দিয়ে সম্মানিত বোধ আর সান্নিধ্য দানের যুগপদ পুলক গ্রহণ করেন। আমার ব্যাপারটা যেহেতু বিতৃষ্ণা নিয়ে আত্মগোপন, তাই এ সব কিছু ভেতরে জাগছিল না। রিনির সঙ্গে তর্ক এড়ানোর জন্য আসার সময় কেনা একটা অনুবাদ গ্রন্থ বের করলাম। অনুবাদক আমার পরিচিত আর পছন্দের বলেই এনেছিলাম। সেখানে বিখ্যাত গল্পকারের সঙ্গে নোবেলজয়ীদের গল্প স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে চৈনিক সাহিত্যিক মো ইয়ানের গল্পটা চোখে পড়ল। সদ্য সাহিত্যে নোবেল পাওয়ায় তার লেখা বেশ অনুবাদ হচ্ছে। ‘শেন্ বাগান’ একটা প্রেমের গল্প।

গল্পে এক জুটির মধ্যে অভিমানী মেয়েটা গো ধরেছে- শেন বাগানে যাবে, সেখানে ছাড়া কোথাও যাবে না। অথচ বেইজিং শহরে ওই নামে কোনো বাগানই নেই। ধারে কাছে যা আছে তা ইউয়ানমিং বাগান। ছেলেটা সেখানে নিয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই সেখানে যাবে না। ট্যাক্সি ড্রাইভার নানা পথ ঘুরে শেষে ইউয়ানমিং বাগানের গেটেই নামিয়ে দিল। বৃষ্টি হচ্ছিল, তবু বাগানের পরিবেশ মেয়েটার মন গলিয়ে দিল। অভিমান গিয়ে ভালোবাসা ফিরে এলো। তারা ইউয়ানমিং বাগানকেই শেন্ বাগান মনে করতে শুরু করল। এমনকি তখন পায়ের তলায় ব্যাঙাচিগুলো মারতেও দুঃখ হচ্ছিল। তাই গাছের একটা ডাল দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে করতে তারা পার্কের উঁচু টিলার উপর  দাঁড়িয়ে ছিল।

আমাকে স্মিত হাসতে দেখে রিনি প্রায় প্রতিশোধ নেয়ার মতো বইটা টেনে নিল। তারপর পড়তে শুরু করল। মাঝ রাত পেরিয়ে আমরা বাগানে পৌঁছলাম। বাগান ম্যানেজারের কটেজে আশ্রয়। তিনজনের জন্য একটাই রুম, খাটও একটা। কেয়ারটেকার মহাবিরক্তি নিয়ে বললো, একটাই রুম, আর নাই। রিনির জন্য আলাদা কিছু মিললো না। ওকে খাটের অর্ধেকটা ছেড়ে আমরা উল্টো দিকে পা দিয়ে হেলে পড়লাম। ঘুম ভাঙতেই সকাল দশটা পেরিয়ে গেল। কেয়ারটেকার দরজা চাপড়ে যাচ্ছেন- ‘নাস্তা চইল্যা গ্যালে কইলাম আর পাইবেন না’। তিনি চলে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছিলেন আসার খবর না দিয়ে। তারপর হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুললাম।

‘আপনারা একখাটে শুইছিলেন!’- টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বিরক্তি নিয়ে বলছিলেন তিনি।

‘হ্যাঁ, একখাটে। তাহলে একজন কি খাটের তলায় থাকবে নাকি?’ এফতুন প্রায় বিদ্রূপ করে বললো।

‘না, একখাটে আরকি!’-  স্বগতোক্তির মতো বললেন লোকটা।

‘আপনি তো আরেকটা রুম ব্যবস্থা করে দেন নাই’ ব্যাপারটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করলাম আমি।

রিনি শুয়ে মিটমিট করে হাসছিল। বোঝা গেল রাতের গল্পটা ওর মুড ফিরিয়েছে। বলল, ‘আমরা আজ শেন্ বাগান দেখতে যাবো।’ এফতুন বুঝতে পারছিল না কথাটা।

‘ওটা মো ইয়ানের গল্প, কাল রাতে ট্রেনে পড়েছে, তাই কপচাচ্ছে।’ আমি সহজ করি।

‘তা-ও ভালো তোরা বই পড়েছিস, নইলে কী কী যে ঘটাতি, খোদাই মালুম। যাক্ বই পড়ে মুড ফিরেছে, নইলে আমার ভাই সাধ্য ছিল না ফেরাবার।’ এফতুন শ্লেষ দিয়ে বলল। এর মাঝে বন্ধু একবার ফোন করে জানলো ঘুম ভেঙেছে কিনা। সে ব্যস্ত আছে, রাতে একবার দেখা করবে।

সেদিন আমরা চা বাগানের শেন্ বাগানের মতো ঘুরলাম। রিনির সব সময়ই একটা ছাতা সঙ্গে রাখার উপকার পেলাম হালকা বৃষ্টি নামার পর। কিন্তু তারপরই চা গাছের গোড়া থেকে চিনে জোঁকগুলো বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। ওদের স্বাভাবিক নড়াচড়া দেখে রুমে ফিরে এলাম। যেহেতু কয়েকদিনের সফর, তাই বাইরে যাওয়ার বেশি তাড়া ছিল না। আমি রুমে ফিরে টেবিলের ড্রয়ার চাপা পরা একটা ঈদ সংখ্যা আবিষ্কার করলাম, যা গত রাতে খেয়াল করা হয়নি। শহরের রোগে-শোকে অসুস্থ রকম মোটা মানুষগুলোর মতো ঈদ সংখ্যাগুলোও পৃষ্ঠায় মোটা হওয়া ছাড়া কোনো দৃশ্যমান দিক নেই। প্রায় ভক্তি উঠে গেছে। পাতা উল্টাতে লাগলাম। ক্লিশে রকম লেখায় ভরে গেছে। একটা গল্পে চোখ আটকাল। এ সময়ের লেখিকা। মানুষের নৈতিক অবক্ষয় আর প্রকৃতির সংযোগ নিয়ে লিখেন। এ গল্পটাও তেমনি। আমার এতটা ক্ষোভ হচ্ছিল যে, ইচ্ছে করছিল গল্পটা পুনরায় লেখি। একটা সম্ভাবনাময় গল্প এভাবে প্রবণতা চাপিয়ে মেরে ফেলার কি আছে! অবশ্য এক গুরু লেখক বলেছিলেন, বয়স আর চিন্তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি নৈতিকতার অবক্ষয়কেই দুনিয়ার প্রধান সংকট হিসেবে মনে হয়।

রিনি ফিরে যাচ্ছে না দেখে এফতুন গিয়েছিল শহরে প্লাস্টিকের জুতা কিনতে। কটেজের জানালা দিয়ে ওর ফিরে আসার রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এসময় চোখ গেল কটেজের বাইরে ফুলবাগানে পরিচর্যা করতে থাকা কেয়ারটেকারের ওপর। প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল তিনি আমাদের অবজ্ঞা করছেন, তার চেয়ে অধিক আমাদের ওপর নজর রাখছেন তিনি। বিকেলে চা নাস্তাও দিয়ে গেলেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। কাঠের হাতল দেয়া মস্ত কাঁচি দিয়ে পাতা বাহারের আগা ছাটছিলেন, তখনও বিরবির করছিলেন আর নজর রাখছিলেন আমাদের দিকে। ব্যাপারটা রিনিই প্রথম খেয়াল করেছে।

সন্ধ্যার পর এফতুন আর লেওন একসঙ্গে এলো। সঙ্গে চা শ্রমিকদের তৈরি মদ ‘চুঁই’, কিন্তু মাংসের ব্যবস্থা করা যায় নি। ‘চুঁই’য়ের সঙ্গে বরফ মেশানোর চিন্তা থেকে দুপুরে পড়া গল্পের কথা মনে হলো। কিন্তু চুঁইয়ে বরফ মিশিয়ে খেতে হয় না, খেতে হয় ঝাল দিয়ে। এ নিয়ে কিছুক্ষণ ঠাট্টা হলো আমাকে নিয়ে- লেখক হয়েও মদের ব্যাপারে ভুলভাল বকছি। রিনি বলতে দ্বিধা করলো না, এখানকার কেয়ারটেকার যেন কেমন, মনে হয় আমাদের ওপর নজর রাখছে।

‘হুম’ লেওন শ্বাস ফেলল, ‘ও একটু এমনই। তবে খুব সৎ। বাবার সময় থেকে কাজ করছেন। আগে নরসিংদীতে আমাদের ইকোপার্ক কাম রিসোর্টে কাজ করতেন। সেখানে একটা এক্সিডেন্টের পর সবাইকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। শুধু তাকে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে।’ ও প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, ‘তা, এখানে কিছু লিখবি না আমাদের জন্য।’

আমি দুপুরে পড়া গল্পটার জন্য ক্ষোভ ঝারলাম। একটা সম্ভাবনাময় গল্পকে এভাবে মেরা ফেলার কি মানে হয়। গল্পটা খুব সাধারণ। তবে অসাধারণ হতে পারতো।

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবক সবুজ চাকরির প্রথম বেতন পাওয়ার পর গোপন ইচ্ছেটা চরিতার্থ করতে বন্ধু প্রীতমকে নিয়ে উপস্থিত মধুপুর বনের ভেতর গড়ে ওঠা একটা রিসোর্টে। শীতের রাতে বারান্দায় বসে চাঁদ দেখতে দেখতে স্কটিস হুইস্কি শিবাস রিগাল খাবে আর কবিতা আউড়াবে- এই পরিকল্পনা। কিন্তু বেতনের টাকা থেকে এক বোতল হুইস্কি কেনার পর মধ্যবিত্তের সেই বৃত্ত- দ্বন্দ্ব, দ্বিধা, পিছুটান মন থেকে যাচ্ছিল না কোনো মতেই। এর মধ্যে উপস্থিত প্রীতমের মেডিকেল পড়ুয়া বান্ধবী শায়লা। অনুভূতিটাই মাঠে মারা যাওয়ার জোগার তার। একাই কয়েক চিপ মেরে যখন ঠিক জমছিল না, তখন প্রায় ঝাপসা চোখে কেয়ারটেকারকে খুঁজতে গেল কয়েক টুকরো বরফ আনার জন্য। কিন্তু কেয়ারটেকার না থাকায়, তার অবর্তমানে শীতের রাতে ময়লা কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে থাকা দাড়োয়ান লোকটাকে ডেকে তুলল সবুজ। কিন্তু লোকটা জেগে ওঠার পর দেখল আসলে সে তার বাবা, এখানে দাড়োয়ানগিরি করে। কিন্তু সে জানতো তার বাবা অন্যকোনো জেলায় চাপরাশির চাকরি করেন, যদিও ঠিক কোথায় তা সে জানতো না। মদ ভাঙা চোখে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, তার বাবা এখানে খেটে মরছে আর সে কিনা বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে মাস্তি করতে এসেছে। ব্যাস।

‘আমি এই গল্পটার রিমেইক করতে চাই।’- প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলাম। ‘একজন শিক্ষিত, বাবার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল যুবক জানে না, তার বাবা কোথায় কাজ করে, এটা খুব স্বাভাবিক না। জানে তো না-ই, শেষে তাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে নৈতিকতার জট পাকানোর কোনো মানে হয়!’ ক্ষুব্ধ সমালোচকের মতো আমি বললাম। ‘এটা তো সেই গ্রামে শীতের রাতে ঘরের পেছন দাঁড়িয়ে রাস্তার লোকের কাছ থেকে আগুন চেয়ে বিড়ি জ্বালানো লাল আলোয় আবিষ্কার করা যে, ওই লোকটা তার বাবা কি দাদা। তারপর দৌড়ে পালানোর মতো ব্যাপার।’ এক দমে বললাম কথাগুলো।

‘তুই কী রকম ভাবছিস?’ লেওন জিজ্ঞেস করল।

ওই রকম একটা গেস্ট হাউসে তিনজন যাওয়া পর্যন্ত ঠিক আছে। তাদের ঘরে একটা রেফ্রিজারেটর ছিল, কিন্তু তা খোলা যাচ্ছিল না। ফলে বোতল খোলার আগে কয়েক টুকরো বরফের জন্য কেয়ারটেকারকে ডাকলে সে বলবে, ভাই ফ্রিজ খোলা যাবে না। কারণ এর আগে ওই রুমে তাদের মতো তিনজন এসেছিল। তারা যাওয়ার পরের দিন দেখা গেল ফ্রিজের ভেতর একটা নবজাতকের লাশ রেখে গেছে। তাই পুলিশ ফ্রিজ সিলগালা করে দিয়েছে। একথা শোনার পর সারা রাত ওরা পরস্পর সন্দেহ আর অস্বস্তির মধ্যে কাটাল।

‘কী বিভৎস চিন্তা তোমার!- রিনি প্রায় ঘৃণা উগড়ে দিচ্ছিল।

‘এটা নিশ্চয় বিভৎস, কিন্তু অসম্ভব তো নয়, এমনটাই তো ঘটে। ভ্রণ হত্যার সংখ্যা একবার হিসাব করেছো কখনো!’ আমি কৈফিয়ত দেয়ার চেষ্টা করলাম, ‘তাছাড়া একটা গল্প লিখতে গিয়ে তুমি বর্তমান অবস্থা লিখতে পারো, ভবিষ্যৎ লিখতে পারো, স্বপ্ন-বিভ্রম লিখতে পারো, কিন্তু বর্তমানে বসে অতীতের মানসিকতা লিখতে পারো না নিশ্চয়ই। বিভৎসতা ওই বাস্তবতার অসহনীয়তাকে তুলে ধরে, বদলের তাগিদ তৈরি করে।’- আমি সহমর্মী হওয়া চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ দরজার দিকে চোখ ফেরাতে টের পেলাম একটা ছায়া দরজার এপাশ থেকে ওপাশে গেছে। আড়াল থেকে কেউ আমাদের কথা শুনছে।

‘এই দাঁড়া দাঁড়া।’ লেওন সব থামিয়ে দিল। চমক দেখানের মতো দরজার ওপাশ থেকে কেয়ারটেকারকে ডাকল। ‘নরসিংদীতে আমাদের গেস্ট হাউস কেন বন্ধ করে দিতে হয়েছিল, আপনি বলতে পারেন তো?’

লোকটা একবার মাথা ঝোকালো। ‘স্যার গল্পের ওই পর্যন্ত ঠিকই আছে, দুইটা ছেলে আর একটা মেয়ে, কিন্তু ঘটনা একটু আলাদা।’ ঈদ সংখ্যা রাখা টেবিলে কোমর ঠ্যাক্ দিয়ে বলতে শুরু করলো লোকটা: ‘তখন আমাদের পুরো সিজন, জোড়ায় জোড়ায় লোক আসে। সেইবার তিনজন এল। দুই যুবক, এক যুবতী। এক রুমই ভাড়া নিল। তাদের মেলামেশায় কোনো বিরোধ ছিল না। তারা দারুণ গাইছিল, আদর করছিল, চুমু খাচ্ছিল। তারা আনন্দের সঙ্গে রাত কাটাল। পরদিন সকালে একজন কাউন্টারে গিয়ে টাকা পরিশোধ করে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে এল। আমাদের যত্ন-আত্তির প্রশংসা করল, আবার আসার প্রতিশ্রুতিও দিল। আমরা ঘর গোছগাছ করে নতুন অতিথির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তারা বেরিয়ে যেতে না যেতেই আবার তিনজন অতিথি এল ওই রুমে থাকার জন্য, তাদের সঙ্গেও একজন নারী। সন্ধ্যায় তারা রুমের ফ্রিজ খুলতে না পেরে কাউন্টারে এলো বরফ চাইতে। কিন্তু চাবি নিয়ে দেখলাম আগের লোকগুলো হয়তো ভুলভাবে ফ্রিজ লক করে গেছে। কিন্তু চবির স্থানে মোম দিয়ে আটকানো। অনেক কষ্টে তা সরান হলো। কিন্তু খোলার পর দেখা গেল...।’ কথা বন্ধ হয়ে আসছিল কেয়ারটেকারের। ‘স্যার’, মাথা নিচু করে বলল, ‘স্যার, মহিলার মাথাটাও নেই।’

‘তারপর অনেক পুলিশি ঝামেলার পর পার্ক কাম রিসোর্ট বন্ধ করে দিতে হয়েছে। সবাই বিদায় করে এই কেয়ারটেকারকে এখানে আনা হয়েছে।’ অবস্থা গুমোট হয়ে যাওয়ার আগেই জানাল লেওন-‘সেদিনের কাণ্ডে তিনজন ছিল বলে তোদেরকেও বোধ হয় সন্দেহ করছিল, তাই না?’
কেয়ারটেকার কোনো কথা বলছে না, থরথর করে কাঁপছে। তখন রিনি প্রায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ‘মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় কী করে!’ কিছুতেই ওর উতলা কান্না থামানো যাচ্ছিল না। আমরা শেন্ বাগান, হুমায়ুন আজাদের ‘প্রবচনগুচ্ছ’, লেখকের মন্তব্য, আমার নেয়া সাক্ষাৎকারের আলোচিত-সমালোচিত হওয়া, ওর চতুর্কাল দর্শন, আমাদের দূরত্ব ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। মাঝ রাত পেরিয়ে কথার পর পরিস্থিতি খানিকটা শীতল হলো। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে রিনিকে আর কটেজের কোথাও খুঁজে পেলাম না।



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়