ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বই-বইমেলা-বঙ্গদেশ

সৈকত হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০২, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বই-বইমেলা-বঙ্গদেশ

ভেবে গোপন আনন্দ অনুভব করি যে, একুশে বইমেলা আর আমার বয়স প্রায় সমান। দেখতে দেখতে আমাদের বয়স বেশ বেড়ে চলেছে। তফাতটা হচ্ছে, একসময় আমি থাকব না, কিন্তু বইমেলা থাকবে; হয়তো সৃষ্টি ও প্রযুক্তিবৈচিত্র্যে আরো ঝলমলে হয়ে উঠবে। যেহেতু সৃজনরোগ আছে, দু-চারটে নগণ্য বইপত্রও বার হয়েছে, এমন দুরাশা মনে স্বস্তি আনে যে, সশরীরে না থাকলেও বইয়ের ভিতর দিয়ে আমিও হয়তো বইমেলায় থাকব।
আসলে মানুষের জীবনে তো ভাষাই ব্রহ্ম বা ব্রহ্মাণ্ড; অক্ষর, বিশেষত ছাপার হরফের ভিতর দিয়ে এক মহাজগৎ তৈরি করেছে মানুষ। আর সবই সে ধরে রেখেছে বইয়ের মধ্যে। বিস্মিত হয়ে দেখি, মানুষের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার গণিত ও সঙ্গীত। গণিতের ভেতর দিয়ে সে খুঁজে পেয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের ভাষা আর সঙ্গীতের ভেতর দিয়ে আবিষ্কার করেছে নিজের ভেতরের ব্রহ্মাণ্ড। অন্যদিকে মানুষের সবচেয়ে সেরা উদ্ভাবন বর্ণমালা। এই বর্ণমালার কল্যাণেই অতীত ও আগামীর সংযোগসেতু তৈরি করতে পেরেছে সে। এরও প্রধান বাহন বই। কাজেই বই বড় ক্ষমতাবান বস্তু কিংবা তাবৎ ক্ষমতাকাঠামোর বাহন। তার দৌড় আসমান থেকে পাতাল পর্যন্ত। পৃথিবীতে নিরক্ষর মানুষ এখনো অসংখ্য, কিন্তু বইহীন কোনো মানুষ নেই, বরং বলা যায় সবাই গ্রন্থনিয়ন্ত্রিত। কেননা ধর্মের বিধান থেকে রাষ্ট্রের আইন; ইতিহাস, পুরাণ থেকে লোকজীবন- সবই কোনো না কোনোভাবে, দৃশ্য বা অদৃশ্যরূপে গ্রন্থিত/গ্রন্থভুক্ত। তাই মানুষ যত না ভূতগ্রস্ত, তারচে বহু গুণে গ্রন্থগ্রস্ত; বরং বলা যাক, বর্তমান সহস্রাব্দের মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে হয়ে উঠছে আরো বেশি প্রাচীন-নবীন গ্রন্থশাসিত/তাড়িত।

২.
বইয়ের হাত ধরে অনেকটা পথ চলে গেছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হলো, সংবাদপত্রের অক্ষরগণিতের কথা, সেখানে মাপা শব্দে বোধের চাপ থেকে মুক্ত হতে হয়। তাই এবার ‘সরাসরি’ বইমেলায় যাওয়া যাক। দেখছি, বইমেলার সঙ্গে আমার সংযোগ প্রায় বছর-পঁচিশের। দেখার বয়স হিসেবে খুব কম নয়। এর মধ্যে মেলার যেমন রূপবদল হয়েছে, আমারও ভূমিকাবদল হয়েছে। শুরু হয়েছিল উৎসাহী দর্শক-ক্রেতা হিসেবে। এরপর ছোটকাগজ-সংস্কৃতি-গ্রন্থ কর্মী; লেখক, সম্পাদক ও সাংবাদিক; এখন আবার যুক্ত হয়েছে প্রকাশক-পরিচয়। এসবের মধ্য দিয়ে লাভ করেছি বিচিত্র অভিজ্ঞতা, দেখেছি নানা পক্ষের বহু চরিত্রের ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-সংগঠন। সেসব বিস্তারিত বলার পরিসর এটা নয়। সেজন্য একটু ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যাব।
বাহাত্তর সালে চিত্তরঞ্জন সাহার চটবিছানো বই প্রদর্শনীর আজকের যে বৈচিত্র্য ও বিস্তার, সঙ্গে ভাষা-শহীদদের সম্মানে মাসজুড়ে বইমেলা, বিপুল বই-মানব-মিডিয়ার সঞ্চরণ- এ সত্যি বিস্ময়কর! কিন্তু যে চেতনা থেকে বইমেলা সে দিকটির হাল কী? দুঃখজনক যে, আমরা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি বলে গর্ব করলেও সার্বিকভাবে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা কোনোটিই তৈরি করতে পারিনি; ফলে বৈশাখে একদিনের পান্তাখোর বাঙালি হওয়া আর ফেব্রুয়ারিজুড়ে মাতৃভাষা-প্রেমিক হওয়ার মধ্যে দরদের চেয়ে কপটতা, দেখানেপনা বা বাজারি-মানসিকতা বেশি। এটি রাষ্ট্রসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান-গণমাধ্যম সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। লেখক-প্রকাশক সবাই মিলে যেভাবে বই প্রকাশের সংখ্যার গুরুত্ব প্রচার করেন, বইয়ের সার্বিক মানের ব্যাপারটা তেমন কল্কে পায় না। অন্যদিকে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকাও প্রশ্নযোগ্য। বহুকাল ধরে আমাদের পত্রপত্রিকায় সত্যিকারের বই-সমালোচনা বা ভালো বইয়ের খবর দুর্লভ বস্তু। অন্যদিকে টিভি ও ই-মিডিয়া যেভাবে হরেদরে প্রচারের বন্যা বইয়ে দেয় তাতে বাংলাভাষা বা প্রকৃত লেখকদের কী উপকার হয় বোঝা কঠিন। দেশের কোনো টেলিভিশনেই বইকেন্দ্রিক ভালো অনুষ্ঠান নেই। অথচ ফেব্রুয়ারিতে ‘লাইভ’ ও অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি-মহামারী, কিন্তু কোন মান বা স্ট্যান্ডার্ড তারা অনুসরণ করেন এটি গবেষণার বিষয়। সেখানে লেখক-অলেখক-ছদ্মলেখক-সিজনাল লেখক সবারই সমান সুযোগ। উদাহরণ হিসেবে বছর দু’য়েক আগে ‘চ্যানেল আই’কে বলা কথাটাই ফের বলি: ‘রবীন্দ্রনাথ যদি তাঁর উচ্চতা আর সৈকত হাবিব যদি তার নিম্নতা নিয়ে নিজ নিজ মূল্য না পেয়ে সমান প্রচার-সুযোগ পান, তাহলে সাধারণ মানুষ কী করে বুঝবেন রবীন্দ্রনাথ কত বড় আর সৈকত হাবিব কত ছোট!’ মিডিয়া অনেক সময়ই এক্ষেত্রে মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেয় না। অন্যদিকে আমাদের ‘মহামেধাবী’ লেখকদের অনেকেই প্রতি বছর ন’টি না ছ’টি নাকি ছত্রিশটি বই প্রকাশ করলেন এটা প্রচারে যত মনোযোগী, কী লিখলেন সেটা প্রচারে ততটা অমনোযোগী। আবার লেখকদের মধ্যেই পাঠের অভ্যাস খুব কম। যে দেশে লেখকরাই পাঠবিমুখ, সে দেশে পাঠকদের বিরুদ্ধে বই কম পড়ার অভিযোগ কতটা বৈধ! দেশে প্রচুর প্রকাশনা তৈরি হলেও বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মানসম্মত বইয়ের প্রকাশক এখনো হাতে গোনা। এভাবে সব দিক বিচার করলে বই বা প্রকাশনার বহিরঙ্গিক দিক, যেমন ছাপা-বাঁধাই-প্রচ্ছদ-অলংকরণ-সজ্জার বেশ দৃশ্যযোগ্য উন্নতি হলেও, বিষয় বা টেক্সটের মান-সম্পাদনা-শুদ্ধতার প্রশ্নে এখনো পেশাদারিত্ব কম। আবার অনেক ‘বিশিষ্ট’ লেখক আছেন যাঁরা মেলায় বই দ্রুত আনার জন্য প্রকাশককে অস্থির করে তোলেন। এই অতি-আত্মবিশ্বাসী লেখকের দল মনে করেন, তাঁরা এত সহি-শুদ্ধ লেখেন যে সম্পাদনা-সংশোধন সময়ের অপচয়। বরং যে কোনোভাবে সুন্দর প্রচ্ছদে বেরোলে পাঠক একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। এসব ‘লেখক-প্রাণী’র কাণ্ডজ্ঞান-যন্ত্রটা খুব ভঙ্গুর, হাস্যকর। এই দেশ যেমন জনসংখ্যাবহুল, তেমনি লেখকবহুল। সে তুলনায় পাঠক বড় অপ্রতুল। বিষয়টি নিয়ে সর্বস্তরে দায়িত্বশীলভাবে ভাবা দরকার।


বৃহৎ বঙ্গজুড়ে বাংলা প্রকাশনার ঐতিহ্য যেমন দীর্ঘ, তেমনি বিচিত্র। আমাদের বহু লেখকেরও আছে প্রকাশক-পরিচয়। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ থেকে জসীমউদ্‌দীনসহ অনেকেই প্রকাশক হিসেবেও মর্যাদাবান। কারণটি কেবল বাণিজ্যিক নয়, বরং অনেকের কাছেই গ্রন্থনির্মাণ বা নিজ হাতে বই প্রকাশও সৃষ্টিশীলতার আরেক মাধ্যম। ছাপাখানার শব্দ বা বাঁধাইখানার কাঁচা বইয়ের ঘ্রাণ অনেককেই মোহগ্রস্ত করে। এ কারণেও অনেকে আগুনের আকর্ষণে পতঙ্গপতনের মতো প্রকাশনায় ঝাঁপ দেন; অনেক সময় নিঃস্বও হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে লেখকদের অপ্রাপ্তি-বঞ্চনার ইতিহাস যতটা মহিমান্বিত, প্রকাশকদেরটা ততই অপ্রকাশিত। কেন, কে জানে! কৈশোর থেকেই ছোটকাগজের সঙ্গে জড়িয়েছি বলে ছাপাখানার ভূত মাথায় চেপেছিল। ফলে একটা গোপন ইচ্ছে সবসময়ই প্রবহমান ছিল। আট বছর আগে কয়েকজন লেখক-সাংবাদিক বন্ধুর সহযোগিতায় ‘প্রকৃতি’ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে শুরু হয় সেই ইচ্ছেযাত্রা। কিন্তু বাণিজ্যের চেয়ে বেশি ছিল জেদ। আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম যে, নির্ভুল-সুসম্পাদিত বই প্রকাশ করতে হবে। কারণ লেখকের কাজ লেখা কিন্তু এর সংশোধন-সম্পাদনার দায় প্রকাশকের। তাই লেখা যেমনই হোক বইটি যেন নির্ভুল হয় এটি ছিল আমাদের ভাবনার কেন্দ্রে। সেই চেষ্টাটা এখনো করছি। নতুন ও ভিন্নধরনের বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-চালিয়ে যাচ্ছি। কম দামে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শনসহ নানা ধরনের আকর্ষণীয় সিরিজ বই প্রকাশ করছি। সারা বছরই সামর্থ্য অনুযায়ী  ভালো বই প্রকাশের  চেষ্টা করছি। আমাদের স্বপ্ন, ‘প্রকৃতি’ যেন বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে একটি নতুন পথ তৈরি করতে পারে। কিছু সাফল্য এবং সুনামও কপালে জুটেছে। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন বড় হলেও সামর্থ্য কম আর বাজারও বড় সংকীর্ণ। সেক্ষেত্রে লড়াইটা দীর্ঘ।
যেহেতু অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি, লেখক-পাঠকদের সহায়তা ও ভালোবাসা নিয়ে নিশ্চয়ই আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে পারব। কারণ মানুষ তো স্বপ্নের জন্য কিংবা স্বপ্ন নিয়েই বাঁচে। স্বপ্নের জয় হোক।
 

লেখক: কবি, সম্পাদক ও প্রকাশক

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়