ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর সাক্ষাৎকার

এমদাদ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৫, ১৩ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর সাক্ষাৎকার

[গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস আমাদের মায়েস্ত্রো, মহাদেশের নিঃসঙ্গতার কথক; পাঠক তাকে জানেন এবং আজকের শুধু নয়, আগামী প্রজন্মের পরিশ্রমী পাঠকও যদি না তাকে ভুলে যায়, তাহলে 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' উপন্যাসটি তারা পড়বে। বাংলা ভাষার পাঠকের কাছেও মার্কেস এখন আর অপঠিত নন, অপরিচয়ও দূর হয়েছে; তার প্রায় সমস্ত সাক্ষাৎকারও অনূদিত হয়ে গেছে পূর্ব-পশ্চিম দু’বাংলায়, প্রায় সমস্ত গল্পেরও অনুবাদ হয়ে গেছে, ইতিমধ্যে প্রায় সমস্ত উপন্যাসও অনূদিত হয়েছে! সাক্ষাৎকারভিত্তিক 'পেয়ারার সুঘ্রাণ' বইটিও পাঠকপ্রিয়। তবুও তো কিছুই হয় না শেষ, কোনও কোনও বই ফিরে ফিরেও পড়তে হয়, লেখককে খুঁজে বের করতে হয় বিস্তৃত সব সাক্ষাৎকারের ভিতর থেকে; মার্কেসের প্রতি এক অমোঘ প্রেম থেকে, তীব্র এক টান থেকে, 'পেয়ারার সুঘ্রাণ : গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে কথোপকথন' বইটিকে আবারও ফিরে পড়তে গিয়ে নতুন করে চমকালাম! মার্কেসের দীর্ঘদিনের বন্ধু, সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক প্লিনিও অ্যাপুলেইও মেন্দোসার নেয়া এই সাক্ষাৎকারগুলোতে কত মাণিক্য আর কত যে অমৃতবাণী লুকোনো! মনে হলো এখনও অনাস্বাদিত। এবার শুধু ফিরে পড়লাম না বইটি, প্রিয় কিছু আলাপের অনুবাদ করলাম আগ্রহী পাঠকের জন্য; যে-সময়ে সত্যিই যেন মার্কেস-উন্মাদনা কিছুটা কমে এসেছে, এখন আর যেন বিস্ময়ের, আবিষ্কারের কিছুই নেই। সত্যিই কি নেই? সে বিচারের ভার পাঠকের ওপর, কেননা গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এমন এক লেখক, যাকে কিছুতেই পাঠ্যতালিকার বাইরে রাখা যায় না, তার অসামান্য গল্পগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে হয়, পাঠের আনন্দের জন্য, লিখতে শেখার জন্য, তেমনই তার সাক্ষাৎকার পাঠও হয়ে ওঠে ঋদ্ধ অভিজ্ঞতার অংশ।]

: আপনার পাঠক জানেন যে, হলুদই হচ্ছে আপনার প্রিয় রং? কেমন ঘনত্ব থাকে সে রঙে?

: একথা আগে একবার কোথায় যেন বলেছিলাম যে, সে রঙে বেলা তিনটার রোদে জ্যামাইকা থেকে ক্যারিবিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকলে যেমনটা দেখায়, ঠিক সেরকম!

: প্রিয় পাখি?

: ক্যানারি পাখির কথা আগেও বহুবার বলেছি। আমার প্রিয় কমলা রঙের ক্যানারি পাখির ঝাঁক।

: প্রিয় সুরকার?

: তিনি হচ্ছেন- বেলা বারটোক

: প্রিয় চিত্রকর?

: গোয়্যা

: প্রিয় নির্মাতা?

: 'দি ইমমর্ট্যাল স্টোরি' চলচ্চিত্রটির জন্য ওরসন ওয়েলস্, আর অবশ্যই কুরোসাওয়া; তার 'রেডবিয়ার্ড' ছবিটি এমন এক আশ্চর্য নির্মাণ যা আমাকে বিধস্ত করে দেয়!

: একবার বলেছিলেন, পুরো একটি পৃষ্ঠা টাইপ করার পর একটিমাত্র ভুলের কারণে পুরো পৃষ্ঠা আবার লিখতে শুরু করেন! এই ব্যাপারটি কি বদভ্যাস কিংবা কুসংস্কার?

: পৃষ্ঠা সম্পর্কিত আমার বদভ্যাস হিসেবেই দেখতে হবে ব্যাপারটিকে! নির্ভুল মনে করে টাইপ করা একটি পৃষ্ঠায় একটিমাত্র ভুল খুঁজে পাওয়া আর সে কারণে যে কাটাকুটি, এই ব্যাপারটি আমার স্বভাব-বিরুদ্ধ। এখান থেকে এ বদভ্যাসের জন্ম। ভুলের কারণে পৃষ্ঠাটি সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে অপাঙক্তেয়। অন্যদিকে, আমার ভিতরে একটি ভয়ও জেগে উঠতে থাকে, মনে হতে থাকে প্রথম পৃষ্ঠাটি লিখবার পর আমি হয়তো আর কখনওই দ্বিতীয় পৃষ্ঠাটি লিখতে পারব না... তাই, বানান ভুলের অজুহাতে প্রথম পৃষ্ঠাটিকে আমি আবারও লিখি, নতুন করে টাইপ করি। আঃ! সমুদ্রের গভীর আনন্দে নিজেকে নৌকোর মতো ভাসিয়ে দেয়ার মতো লাগে ব্যাপারটিকে আমার। এভাবেই আমি হারানো বিশ্বাস ফিরে পেতাম, মনে হতো- লিখতে পারব।  

: কীভাবে কখন বুঝতে পারেন যে একটি লেখা শুরু হতে চলেছে?

: বহু লেখককে বলতে শুনেছি যে, তাদের লেখার জন্ম হয় একটি বিশেষ আইডিয়া থেকে, আমার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমার একটি লেখার জন্ম হয়ে যেতে পারে কোনও একটি দৃশ্য (ভিসুয়্যাল ইমেজ) থেকে। 'মঙ্গলবারের সিয়েস্তা', আমার অত্যন্ত প্রিয় এই গল্পটির জন্ম হয়েছিল ঠিক তখনই যখন দেখেছিলাম এক মহিলা আর একটি ছোটো মেয়েকে, দু'জনেই কালো পোশাক পরা, কালো ছাতায় মাথা ঢেকে তীব্র রোদে হেঁটে চলেছে জনশূন্য ও বন্ধুহীন এক শহরের রাস্তা ধরে; 'পাতার ঝড়' গল্পটির জন্ম হয়েছিল যেদিন এক বৃদ্ধকে দেখেছিলাম তার মৃত পৌত্রকে কোলে তুলে নিয়ে চলেছেন গোরস্তানের দিকে। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া মেঘলা দিনের গোরস্তান। 'কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না' লিখবার সময় আমি ভেবেছি বয়োবৃদ্ধ সেই মানুষটির কথা, প্রতিদিন বিকেলের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে বারানকিয়ার বাজারে একা একা অপেক্ষা করতেন  লঞ্চটি কখন তীরে ভিড়বে! বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষটির ভিতরে অপেক্ষার এক নিশ্চুপ প্রতীক্ষা লক্ষ্য করতাম আমি। বহু বছর পর, প্যারিসেও, চিঠির অপেক্ষায় আমিও এভাবে বসে থাকব, এমনই নৈঃশব্দ্যে, এমনই প্রতীক্ষায়!       

: আমরা জানি, 'গোত্রপিতার হেমন্ত' উপন্যাসটি আপনি লিখতে শুরু করলেন; আর তখন লিখতে থাকা 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' উপন্যাসটি লেখাও বন্ধ করে দিলেন! কেন এমন করলেন? একটি বই লিখতে থাকা অবস্থায় অন্য একটি লেখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের লেখকদের তেমন নেই মনে হয়।  

: হ্যাঁ, তখন 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' লেখাটিকে সরিয়ে রাখতে হয়েছিল, কারণ এতদিন ধরে যা লিখছিলাম সে সম্পর্কে আমার ধারণা তেমন পরিষ্কার ছিল না; মনে হচ্ছিল লিখছি ঠিকই কিন্তু কীভাবে কী হবে তার সম্পর্কে কোনও ধারণা আমার নেই। এই বইটি, 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর', ছিল বেশ পুরোনো লেখা, বহু বছর ধরে লিখে চলেছিলাম, মাঝখানে বেশ কয়েক বছর থেমেও গিয়েছিল লেখাটি, যতক্ষণ না খুঁজে পাচ্ছিলাম সেই ধাঁধার উত্তরটি। কথন-ভঙ্গিই হচ্ছে সেই ধাঁধা। আর, একটি লেখা লিখতে লিখতে অন্য লেখায় চলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যে এর আগেও আমার হয়নি, তাও নয়; একাধিকবার হয়েছে, 'অশুভ লগ্ন' বইটিকে প্যারিসে বসে লিখতে লিখতে হঠাৎ লিখতে শুরু করে দিই 'কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না', সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা বই; বিষয়টি মাথায় ঢুকে পড়েছিল, আর বারবার ভিতর থেকে তাড়িত করছিল লিখবার জন্য, অন্য কিছুতে মন দিতে বাধা দিচ্ছিল। পাঠকের সঙ্গে লেখক হিসেবেও আমার দারুণ মিল আছে। লিখতে লিখতে কোনও বিষয় থেকে যদি কখনও মন চলে যায়, তখনই বিরতি নিই লেখাটি থেকে, সাময়িকভাবে দূরে সরে যাই। আর আমি তো এটা ভাল করেই জানি যে আবারও সেই মোক্ষম মুহূর্তটি আসবে, যখন আবারও অসমাপ্ত সে লেখাটি আমাকে শেষ করতে বসতে হবে।     

: তিন বছর ধরে কিউবাকে নিয়ে একটি বই লিখতে লিখতেও শেষ পর্যন্ত লেখাটা বন্ধ করে দিলেন!

: হ্যাঁ, সেটা বেশ বড় একটা লেখা ছিল, অন্তত পরিকল্পনাটি একটি বৃহৎ পরিসর নিয়েই ছিল, কিন্তু প্রতিবারই কিউবায় গিয়ে বুঝতে পারছিলাম যে, লেখাটি খুব দ্রুত পুরোনো হয়ে যাচ্ছে! দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছিল কিউবা তখন, সে গতি ও পরিবর্তনের সঙ্গে কিছুতেই যেন তাল মিলাতে পারছি না আমি। এক সময় মনে হলো, পরিবর্তনের শেষটুকু না দেখা পর্যন্ত না লেখাই বোধ হয় ভাল; পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কাজটি স্থগিত রাখাই মনে হয় সঠিক সিদ্ধান্ত।    

: আবারও, আপনার লেখার জগতে ফিরে আসি, আপনার বন্ধুরা বলেন যে 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' উপন্যাসে একটি পরিবারের মধ্য দিয়ে আপনি লাতিন আমেরিকার সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে এনেছেন। 

: এ উপন্যাস লাতিন আমেরিকার ইতিহাস নয়, এই মহাদেশের মেটাফর (রুপালঙ্কার, রূপক)!

: উপন্যাসে আপনি ছ'টি প্রজন্মকে মাকোন্দ'র পটভূমিকায় এঁকেছেন, যে মাকোন্দ স্রেফ এক জাদুবাস্তব দুনিয়ার গ্রাম, আর আখ্যানটি শুরু হয় এমন এক আদিম সময় থেকে যখন চারপাশের সমস্ত কিছু নামহীন, উপন্যাস শেষ হয় একটি কিম্ভূত শিশুর জন্মের মাধ্যমে যে একটি শূকরের লেজ নিয়ে জন্মায়! এর মধ্যেই, ৫ বছর ধরে যুদ্ধ, ক্ষুধা, মারী, জাতিগত দাঙ্গা, ধর্মঘট, বিপ্লব, প্রতিবিপ্লব, আর উপন্যাসজুড়ে জাদুবাস্তবতার এমন এক আবহ বাস্তব আর পরাবাস্তব যেখানে একাকার হয়ে যায়। এখানেই আমার জিজ্ঞাসা, আপনার আখ্যান ঠিক কতটুক বাস্তবকে অনুসরণ করে লিখিত হয়?

: প্রতিটি লেখাই শুরু হয় বাস্তব থেকে, তারপর আমি আমার পাঠকের হাতে একটি করে আতশকাচ ধরিয়ে দিই যাতে তারা ঠিকঠাক সবকিছু ধরতে পারে। গল্পের সেই ইউলিসিস ('সরলা এরেন্দিরা আর তার নিদয়া ঠাকুমার আশ্চর্য করুণ কাহিনি' গল্পের) প্রতিবার গ্লাসে হাত দিলেই গ্লাসের রং বদলে যায়। এখন এই রং বদলে যাওয়ার ব্যাপারটি কিছুতেই তো সত্য ঘটনা হতে পারে না। কিন্তু ইউলিসিস তো তখন সাধারণ কেউ নয়, সে প্রেমে পড়েছে; প্রেমিক চরিত্রটির মনের ভাব বোঝাতে গ্লাসের রঙের বদলে যাওয়ার পদ্ধতিটিকেই আমার যুতসই মনে হয়েছে, নতুন মনে হয়েছে। ইউলিসিসের এ অবস্থা দেখে মা (গুয়াহিরো এলাকার ভাষায়) বলেন- 'প্রেমে পড়লেই এমনটি হয়। মেয়েটি কে?' প্রেমের মতো এক গভীর অনুভবকে এভাবে এই অভিনব উপায়ে প্রকাশই ছিল আমার একমাত্র পদ্ধতি! 

: এ উপন্যাসটির 'ভিসুয়্যাল ইমেজ' মানে, বলতে চাইছি, কীভাবে উপন্যাসটি এগিয়ে চলতে শুরু করেছিল?

:  একজন বৃদ্ধ একটি শিশুকে নিয়ে হেঁটে চলেছেন বহুদূর কোথাও, শিশুটিকে তিনি বরফ দেখাবেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল এ উপন্যাস। তখনকার দিনে 'বরফ' ছিল সার্কাসে দেখানো চমকপ্রদ জিনিস। 

(উপন্যাসটি শুরু হয় এভাবে- 'বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা, যেদিন তার বাবা তাকে বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন মাকোন্দ প্রাগৈতিহাসিক ডিমের মতো প্রকাণ্ড, মসৃণ আর সাদা পাথরের পাশ দিয়ে বয়ে-চলা কাকচক্ষু নদীর পাশে মাটি আর নল দিয়ে তৈরি বিশটি বাড়ির এক গ্রাম। তখন পৃথিবী ছিল এতই নতুন যে বহু কিছুই ছিল নামের অপেক্ষায়...'। অনুবাদক- আনিসুজ্জামান।)

: আমরা জানি যে, আপনি লেখার প্রথম বাক্যটিকে অসম্ভব গুরুত্ব দেন। মনে আছে একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন- আপনার ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে শুরুর বাক্যটি লিখতে লিখতে দীর্ঘ সময় চলে গেছে, যে-সময়ের মধ্যে পুরো লেখাটিই হয়তো লিখে ফেলতে পারতেন! কেন এমন করেন?

: কারণ, আমার কাছে লেখার প্রথম বাক্যটি পুরদস্তুর একটি গবেষণাগারের (ল্যাব) মতো, যেখান থেকে লেখার শৈলী, লেখার আঙ্গিক এমনকি লেখাটির বিস্তৃতি পর্যন্ত নির্ধারিত হয়ে থাকে।

: আপনার বাড়ির আনাচকানাচ আর টবে শুধুই হলদে ফুলের গাছ; প্রতিটি ফুলদানিতেও হলদে ফুল!

: এই আয়োজনটি অনর্থক নয়, নিরাপদ আর সুস্থ্য থাকবার জন্য আমি চাই আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলুক নারী আর অজস্র হলদে গোলাপ। চারদিকে এ রঙের ফুল থাকলেই কেবল মনে হয় যে, তেমন ভয়ানক কিছু আমার ভাগ্যে লেখা নেই। অঘটন কিছুই ঘটবে না।

: লেখার টেবিলেও তো মার্সেদিস প্রতিদিন একটি করে হলদে গোলাপ রেখে দেয়!

: হ্যাঁ, নিয়মিতই রাখে; এমন বহুবারই হয়েছে, লিখতে বসেছি কিন্তু যা লিখতে চাইছি তা কিছুতেই লিখতে পারছি না, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা যা তা লিখে চলেছি, ঘরের মেঝে ভরে উঠছে তালগোল পাকানো কাগজের টুকরোয়, হঠাৎ চোখ পড়তেই দেখি ফুলদানিটা খালি; ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন কয়েকটি ফুল সাজিয়ে দিয়ে গেল, তৎক্ষণাৎ আমার ভিতরটাও যেন অদ্ভুত মায়াবী সঙ্গীতে তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল... কাঙ্ক্ষিত লেখাটি তখন লিখতে শুরু করলাম। 

: লেখালেখিকে আপনি আনন্দময় ঘটনাও বলছেন, আবার কোথাও এটাও বলছেন যে, লেখা হচ্ছে ভিতরে ভিতরে প্রতিনিয়ত বয়ে চলা এক গভীর দুঃখ! কোনটিকে সত্য বলে ধরে নেব?

: সত্য তো দুটোই। শুরুর দিকে আমি যখন লেখালেখিতে অভ্যস্ত হতে অবিরাম চেষ্টা করছিলাম, ঠিক সে সময় আমি ছিলাম উন্মত্ত আর প্রচণ্ড উত্তেজিত; শরীর সব সময়ই লিখবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো তখন, এবং বেহিসেবির মতো খটখট করে লিখে যেতাম; লিখতেই থাকতাম, তেমন একটা সচেতনও ছিলাম না যে কী লিখছি। মনে আছে, তখন এক দিনেই চার পৃষ্ঠা, পাঁচ পৃষ্ঠা এমনকি টানা দশ পৃষ্ঠাও লিখে ফেলতাম। পত্রিকা অফিসের কাজ শেষ হতো তিনটের দিকে, তারপর দিনের বাকি সময়টুকু শুধু লেখা আর লেখা। আর কোনও কাজ নয়, লিখতে থাকা। একদিন পুরো একটি গল্প একটানে লিখে ফেল্লাম! 

: এখনও আগের মতোই আছেন, নাকি পরিবর্তন এসেছে?

: এখন সারাদিনেও যদি এক পরিচ্ছেদ চমৎকার গদ্য লিখতে পারি, তাহলে ধন্য মনে করি। আমার ক্ষেত্রে হচ্ছে কী, বুড়ো হচ্ছি যতো, লেখালেখিও ততো দুরূহ এবং বেদনাসঞ্চারি হয়ে উঠছে।

: কিন্ত লেখা তো এখন এত জটিল আর যন্ত্রণাদায়ক হওয়ার কথা নয়, মার্কেস! অভিজ্ঞতা যতো বাড়বে, লেখাও ততো সহজ হয়ে আসবে, তাই না?

: না, তা হয় না কখনও। মূল ব্যাপারটি হচ্ছে দিনে দিনে দায়িত্ববোধ বাড়তে থাকে। লেখক অনুভব করতে থাকেন প্রতিটি শব্দ যেন আর আগের মতো নেই, এখন অনেক ভারি হয়ে গেছে, কিংবা ভারি হচ্ছে; আগের চেয়ে অনেক বেশি ভার বইছে শব্দগুলো, আগের চেয়েও অনেক বেশিসংখ্যক মানুষকে তারা আক্রান্ত করতে চাইছে! এইসব কিছু সহজ ব্যাপার নয় একজন লেখকের জন্য।

: উপন্যাস লিখতে কি আপনার দীর্ঘ সময় লাগে?

: লিখতে কিন্তু খুব একটা সময়ের দরকার পড়ে না, কারণ লেখা তো একটা দ্রুতগামী প্রক্রিয়া, একবার শুরু করতে পারলে টানা চলতে থাকে, শেষও হয়ে যায়, মানে- ওই লেখাটা চলমান তো থাকেই; 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' বইটি লিখতে আমার দু-বছরেরও কম সময় লেগেছে; কিন্তু দীর্ঘ সময় লাগে, হ্যাঁ, পনেরো ষোলো বছরের মতো একটা দীর্ঘ সময় চলে যায় লিখতে শুরু করবার আগে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে ভাবতে। 

: লেখালেখির জন্য পছন্দের কোনও জায়গা নির্দিষ্ট করা আছে কি?

: বিচ্ছিন্ন মরুভূমির মতো কোনও দ্বীপ দরকার সকালে লিখবার জন্য, আর রাতের জন্য দরকার জনবহুল কোনও নগরী। দিনের শুরুতে আমি নীরবতার আশ্চর্য সৌন্দর্য অনুভব করতে করতে লিখি, দিনের শেষ অর্থাৎ আসন্ন সন্ধ্যায় আমি চাই কোলাহল, কথাবার্তা আর প্রচুর বন্ধুবান্ধব। সব সময়ই ভিড় পছন্দ করি, প্রচুর লোকজনের সঙ্গে থাকতে চাই যাতে দুনিয়ায় এই মুহূর্তে কি ঘটে চলেছে তা জানতে পারা যায়, সহজে; ব্যাপারটি ফকনারের কথার মতোই কিছুটা, তিনি বলতেন- লিখবার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হচ্ছে বেশ্যালয়। দিনের শুরুতে বেশ্যালয় আশ্চর্যরকমের শান্ত, রাতে সেখানে বেসামাল জীবনের হুল্লোড়।    





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়