ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বুক রিভিউ

চেতনায় দ্যুতি ছড়িয়ে যায়

কাউসার মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ১৯ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চেতনায় দ্যুতি ছড়িয়ে যায়

কাউসার মাহমুদ : ‘মুক্তিযুদ্ধ, পেনশনের চেক ও ঘুষের গল্প’ ইভান অনিরুদ্ধের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। তার গল্প পাঠ শেষে মনে হয়, গল্পের সমস্ত উপাদান নিয়ে তিনি খুবই প্রশান্ত এবং ঊর্বর গল্প রচনা করতে পারঙ্গম। সহজ, সাবলীলভাবে যাপিত জীবনের গল্প, দুঃখ, প্রেম, অহম বা কষ্টবোধ তিনি ফুটিয়ে তোলেন স্বাচ্ছন্দ্যে। আলোচ্য বইয়ের মূল ও প্রধান গল্পগুলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। এবং এমন ধারার একটি গল্পের নামে বইয়ের নামকরণ করেছেন তিনি। বইটিতে মোট দশটি গল্প রয়েছে।

বইটি পড়ে সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত হয়েছি তার চেতনা উপলদ্ধি করে। দেশ ও বাঙালি জাতির প্রতি তার মমত্ববোধ ও শেকড়ের আদি শৈল্পিক টান তিনি প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন গল্পে। সেইসঙ্গে ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধকালীন চিত্রছবি এঁকে একেকটি গল্পের শরীর নির্মাণে তার যে শৈল্পিকতা ও কালের সত্যকে তুলে আনার দক্ষতা পাঠককে মুগ্ধ করবে বলেই বিশ্বাস করি। মোটকথা, আশির দশকে জন্ম নেয়া এই গল্পকার বোধকরি তার এই গল্পভুবনে মুক্তিযুদ্ধের সময়টিকেই উপজীব্য করতে চেয়েছেন। তখনকার সত্য ঘটনা, পাক হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষকতা, মুক্তিবাহিনীর আত্মদান এবং তৎকালীন রাজাকারদের চরিত্রগুলো ইতিহাস পর্যালোচনা করে গল্পে তুলে আনতে সচেষ্ট থেকেছেন তিনি। এক্ষেত্রে তার সফলতা ষোলআনা না হলেও বেশ অনেকটাই অর্জন হয়েছে বলে মনে হয়। তাই বলে শুধু কেবল মুক্তিযুদ্ধি এবং সেই সময়ের ঘটনা অবলম্বনে বইয়ের সবগুলো গল্প নয়। প্রেম ও মধ্যবিত্ত পরিবারের গভীর দীর্ঘশ্বাস ও টানাপোড়েনের গল্পও রয়েছে। জীবনধর্মী এমন কয়েকটি গল্পের সন্নিবেশ আছে বইটিতে।

ইভান অনিরুদ্ধের গল্পের ভাষা খুবই সাবলীল ও স্বচ্ছ। কিন্ত  ঘটনাপ্রবাহ কখনো অনুমেয়। তিনি কি বলতে চেয়েছেন তা প্রথমেই বোঝা যায়। তবে বেশকিছু গল্প এই বিষয়টিকে উৎরে একটি উৎকর্ষতায় গিয়ে পৌঁছেছে। এই গল্পগুলোয় পাঠক কিছুটা দ্বিধায় পড়বেন। অপেক্ষা করবেন একটি বাঁক অথবা চরম সমাপ্তির। পড়তে পড়তে কখনো মনে হবে- এমন হবে কিন্তু মুহূর্তেই গল্পের বাঁক বদলে গতি প্রবাহিত হয় ভিন্ন কোনো টানেলে। গল্পগুলোতে তার ভাবনা শক্তি ও গল্পকে নিয়ে খেলতে পারার অস্বাভাবিক, ঈর্ষণীয়  সক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়েছে। বইয়ের প্রথম গল্পটি ‘দখল’। গল্পে তার ভাষা ব্যবহার ও চরিত্রের প্রয়োগ যথাযথ মনে হলেও সমাপ্তি অনুমান করা যায় শুরুতেই। যেন বুঝতেই পারছি শেষটা হবে যোগেন বাবু যুদ্ধের পর ভারত থেকে ফিরে এসে দেখবেন রাজাকার আবদুস সালাম তার বাড়িঘর সব দখল করে নিয়েছে। বলতে গেলে এই ধারা ও নির্দিষ্ট ঘটনাটিকে কেন্দ্র করেই বাংলা সাহিত্যে অনেক গল্প রচিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে ইভান অনিরুদ্ধের ‘দখল’ নতুন কিছু নয়। কিন্তু তারপরও গল্পটিতে যোগেন বাবু, রমা, রেণু ও আবদুস সালাম; মাত্র চারটি চরিত্র নির্ধারণ করে যেভাবে গল্পকার গল্পকে এগিয়ে নিয়েছেন তা পাঠককে মুগ্ধ করবে। একইভাবে ‘মালেকের যুদ্ধ জয়’ ও ‘পেনশনের চেক ও ঘুষের গল্প’ ঘটনা, সময়, চরিত্র সবকিছু মিলিয়ে এই গল্প দুটিকে মনে হয়েছে বইয়ের প্রধান ও শ্রেষ্ঠ দুটো গল্প। মালেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। শৈশবের মধ্যভাগে এসে নানা বাড়িতে একটি দুর্ঘটনায় প্রথম অসুস্থতা। তার কিছুকাল পরে আবিষ্কার করে স্ত্রী লিঙ্গের চালচলনের প্রতি নিজের বিশেষ আকর্ষণ। বুঝতে পারে ক্রমশ সে অস্বাভাবিক কোনো মানুষে রূপান্তরিত  হচ্ছে। জগত সংসারে এক ভাই ও ভাবি ছাড়া আপন বলতে কেউ নেই। অথচ ভাবি তাকে তাড়ানোর মতলবে থাকে সারাক্ষণ। একদিকে ঘরছাড়া অন্যদিকে ক্রমশ তৃতীয় লিঙ্গে রূপান্তরিত মালেকের কপালে জোটে সমাজের বঞ্চনা। শেষে বিকৃত রুচির চেয়ারম্যানের ঘরে জায়গা পাওয়া মালেক কিভাবে রাজাকার চেয়ারম্যানসহ গ্রামে অবস্থানরত পাকবাহিনীকে পরাস্ত করে কুপিয়ে হত্যা করে তা আছে গল্পের পরতে পরতে। মুক্তিযুদ্ধের সেই বিভীষিকাময় সময়ে একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের দেশপ্রেম অতুলনীয়ভাবে তিনি তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ জন্মের পেছনে লাখো শহীদ, বীর সন্তানের সঙ্গে সমাজের বঞ্চনামাখা এরকম মালেকও যে জড়িয়ে আছে, তা বেশ সুকরুণ ও তীব্রভাবে রূপায়ন করেছেন গল্পকার।  স্বীকার  করতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক শিল্প-সাহিত্যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ভূমিকা নিয়ে স্পষ্টভাবে কোথাও আলোচনা হয়েছে তা আমার অজানা। এক্ষেত্রে তাদের কথা ছোটগল্পের ক্যানভাসে  টেনে এনে তার লেখকঋণ শোধ করেছেন এবং আমাদের দায়মুক্তি দিয়েছেন।

‘পেনশনের চেক ও ঘুষের গল্প’ পড়ে মনে হয়েছে, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে পুতিময় দুর্গন্ধ বাস্তবতাকে।  মুক্তিযোদ্ধা ও রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার আবুল কালাম। স্কুলের সাধারণ শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট না থাকায় চার বছর হলো তার পেনশনের টাকা আটকে আছে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। ঘরে স্ত্রী নানা সময় তার সঙ্গে উচ্চগ্রামে কটাক্ষ করে বলে, ‘তুমি যে বীর মুক্তিযোদ্ধা তার প্রমাণ কী? তোমার কি কোন সার্টিফিকেট আছে?’  স্ত্রীর এই কথায় আহত হন আবুল কালাম। নিতান্ত দুঃখ, হতাশা, আক্ষেপের সঙ্গে একটি অহংকার মিশিয়ে কখনো কখনো বলেন, ‘তুমি কি পাগল হয়েছো হাসানের মা ! আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সারা জীবন ন্যায়ের পক্ষে থেকেছি। এখন শেষজীবনে ঘুষ দিয়ে আমার ন্যায্য পাওনা টাকা তুলবো?’ কিংবা তীব্র কষ্টে লীন হয়ে স্ত্রীকে বলেন, ‘কী বলছো তুমি! আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। আমি ঘুষ দিয়ে পেনশনের টাকা তুলবো না। যেদিন হবে সেদিন হবে – এটাই আমার ফাইনাল কথা।’ গল্পের এক পর্যায়ে ছেলে হাসান কিভাবে ঘুষ দিয়ে চরম বাস্তবতা মেনে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বাবার পেনশনের টাকা উদ্ধার করেন সেকথা বলা হয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত একজন রিটায়ার্ড স্কুলমাস্টার ও মুক্তিযোদ্ধার সাধারণ জীবন উপজীব্য করেই একটি দুর্দান্ত গল্প এটি। এমন সাধারণ জীবনগুলোর যে অসাধারণ গল্প থাকে, সেই গল্পগুলো পরম যত্নে ইতিহাসের আশ্রয়ে লিখেছেন গল্পকার।

তার এই বইটিতে রয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের কিছু অসাধারণ প্রেমের গল্প। ‘যুদ্ধ, প্রেম ও মৃত্যু’, ‘নীরার লাল টিপ’, ‘তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী’ গল্পগুলো প্রেমের। সেসব গল্পে উঠে এসেছে জনজীবনের প্রেম। কোনো ব্যাচেলর ছেলের মেস জীবনের গল্প এবং বাড়িওয়ালার মেয়ের সঙ্গে প্রেমের মিষ্টি রোমান্টিক মুহূর্তের ছোট ছোট বর্ণনা। যদিও এসব ঘটনা ও গল্পের কথকতা খুবই চর্চিত তবু এই বিষয়গুলো সহজ গদ্যে, সাধারণভাষ্যে পাঠককে নতুন করে স্পর্শ করতে সক্ষম হবে। নাইজেরিয়ার বিখ্যাত সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে যেমন বলেছেন, ‘মানুষ হতে হলে অবশ্যই তার একটা গল্প থাকতে হবে’। আলোচ্য গ্রন্থের লেখকেরও বোধকরি এমন অজস্র গল্প আছে। যা তিনি বলতে চান গণমানুষের কাছে। তার সেই গল্পের প্রধান অনুষঙ্গ হলো মুক্তিযুদ্ধ। আর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সবগুলো গল্প পাঠে বোঝা যায়- এইসব গল্পের স্থান, সংলাপ, ভাষা, চরিত্র বেছে নিতে তিনি সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেছেন তার জন্মস্থানকেই। প্রায় সবকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পেই তিনি স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন নেত্রকোণা এবং সেখানকার আঞ্চলিক কথায় সংলাপ ব্যবহার করেছেন। এটা একদিক থেকে তার শক্তির জায়গা হলেও গল্পে বিচিত্রতা ও বহুমাত্রিকতাকে ক্ষুণ্ন করেছে বলে মনে হয়। কারণ একই জায়গার ব্যবহার ও একই রকম সংলাপের ব্যবহারের চেয়ে ভিন্নতায় পাঠকের আনন্দ আসে বলেই আমাদের ধারণা।

বইটি প্রকাশিত হয়েছে পুথিনিলয় থেকে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য ১৫০ টাকা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়