ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বাস্তবতার বিবিধ বয়ান : শহীদুল জহির

কবি স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৭, ২২ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাস্তবতার বিবিধ বয়ান : শহীদুল জহির


যাদু-বাস্তবতার শক্তিমান কারিগর শহীদুল জহির। একটি পরিস্থিতি উপস্থাপন করতে গিয়ে যৌক্তিক ও পরিণত শব্দ প্রয়োগে তিনি বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়ার প্রবণতা দেখান না। তার গল্পে বাস্তবতা আসে কখনো বিপ্রতীপ ভঙ্গিতে, কখনো পাঠক অকস্মাৎ মুখোমুখী হন তির্যক বাস্তবতার এবং কখনো, যা আমাদের শহীদুল জহিরের প্রবণতা যাদু-বাস্তবতার। অন্তত তার ছোটগল্পে বাস্তবতার বিবিধ ভঙ্গি আর শৈলী দৃশ্যমান

এক.
জীবন যা কিছু নিয়ে চলমান, ভালোবাসা তার মধ্যে অন্যতম। ‘ভালোবাসা’ একটি শব্দ, নানা রূপ। শহীদুল জহির আমাদের সামনে এমন এক ভালোবাসার গল্প নিয়ে আসেন, যার পরিণতির কথা ভেবে আমাদের অস্থির হতে হয়।
মানুষের আছে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আলাদা আলাদা স্তর। সব মিলিয়ে ভালোবাসা প্রসঙ্গে যখন বস্তিতে বসবাসকারী একটি দম্পতি আর তার সন্তান কেন্দ্র হয়ে ওঠে; এই ভালোবাসা তার পারিপার্শ্বিক সব কিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিস্তার লাভ করে।
বস্তির নাম ‘বাবুপুরা’। এই নামটিই আলোচনার দাবি রাখে। আবেদার পিঠ কালো, চুল তেলহীন রুক্ষ। শহীদ দিবস উপলক্ষে অন্যরা যখন ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যায়, স্মৃতিসৌধে দেয়ার জন্য হাফিজুদ্দি একটি ফুল ছিঁড়ে বস্তির ঝুপড়িতে ফিরে আসে। তখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় না, ফুলটি কেন সে এনেছে। যে ফুল স্মৃতিসৌধে যেতে পারতো সেই ফুলটি ঠিক কোথায় শোভা পাবে। পাঠকের মনে ভয় হয়, তুলনামূলক মহত্ব আবিষ্কার করা কঠিন হয়ে পড়ে। একটি লাইন ছেড়ে অন্য লাইনে চলে যাওয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। কিন্তু ভেতরে তাগাদা তৈরি হয়। আমরা প্রস্তুত হই, ফুলটির পরিণতি জানার জন্য। তার আগেই আমরা একজন আবেদাকে আবিষ্কার করে ফেলি যে দুপুরে না-খেয়ে স্বামীকে মিথ্যে বলে, নিজের ভাগের সামান্য ভাত স্বামীকে দিয়ে দেয়। পানি সংকটে অর্ধেক গোসল করা হাফিজুদ্দি খেতে বসে হুপুস-হাপুস করে খায়। আধ পেট খাওয়া হাফিজের আবার খেতে পাওয়ার আনন্দের শব্দ তৈরিতে শহীদুল জহির আপস করেন না। আর সারাদিন না-খেয়ে থাকা আবেদা অন্যের বাসার কাজ শেষে ফিরেই রান্না করতে বসে। আগে স্বামীকে খেতে দেয়, তারপর মেয়েকে, এরপর নিজের পাতে খাবার নেয়।

খুব খেয়াল করে দেখলে আবেদার প্রতি আমাদের সম্মান বাড়তে থাকে। আরও পরে, হাফিজুদ্দিকে আমরা আরেক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি, সেই ভূমিকাও তার পেটে খাবার থাকা-না- থাকার সঙ্গে যুক্ত। হাফিজুদ্দি রাতে খেতে বসে। এর আগেই তার জানা হয়ে যায়, আবেদা এই ফুল চুলে গুঁজেছিল। আমরা বুঝতে পারি, মেয়ে তহুরার কাছ থেকে জেনেছে সে।  সে জানতে চায়, ‘তুই চুলে ফুল গোঁজস নাই?’ আর একবার আমরা আবেদাকে মিথ্যা বলতে শুনি। ভয়ে সে মিথ্যা বলে। হাফিজুদ্দি খাচ্ছিল, আমরা ধারণা করি তার পেট ভরে এসেছে; হাফিজুদ্দি বলে বসে ‘ফুলডা তরে দিয়ে দিলাম যা’।
আমরা স্বস্তি পাই। ঝড় শেষে আকাশের রং ম্লান আর আদুরে হয়ে যায়; গল্পের এই ঝড় শেষে শহীদুল জহির আমাদের যে দৃশ্যের সামনে দাঁড় করান আমরা দেখতে পাই কুপির ম্লান আলোয় তহুরার চোখ নরম হয়ে আসে। ফুঁ দিয়ে আলোটা নিভে যায়, আমরা জানতে পারি আবেদার ঠোঁট তহুরার কপাল ছোঁয়। এরপর জেনে যাই- একটি ফুল যৌক্তিক জায়গায় পৌঁছে গেছে।

দুই.
‘তোরাব সেখ’ শহীদুল জহিরের একটি গল্পের নাম। শেষ পর্যন্ত আমরা একটি ধারণার পৌঁছাতে চেষ্টা করি, এটি কেবল নাম নয়- ক্ষমতাচ্যুত অর্থনৈতিক বাস্তবতার একটি শ্রেণি। এই শ্রেণিটা এক সময় পুরো পরিবারের ভার একা বহন করতো। পরিবারে তার শাসন জারি থাকতো। সে যা বলতো সেটাই ছিল শেষ কথা। এরপর তার সামনেই পরিবারের প্রত্যেকে অর্থ উপার্জনমূলক কাজে যুক্ত হয়। নিয়মের বাইরে তাদের কোনো জীবন থাকে না। একা তোরাব সেখ সেই শ্রেণির প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে যে শ্রেণিটি আর কোনোদিন ফিরবে না।
কায়িক শ্রম দিয়ে উপার্জন করা তোরাবের শক্তি কমে আসে, কিন্তু সে কাজে যেতে চায়। কাজ করতে পারলে নিজেকে পুরুষ মনে করে। এখানে আমরা পুরুষের অন্য অর্থ আবিষ্কার করি। শ্রম বাজারে বয়স্কদের কদর কম তার এক নিদারুণ চিত্রও আমাদের সামনে চলে আসে। তোরাব সেখকে আমরা বলতে শুনি ‘বাজার ভর্তি জোয়ান-মর্দা মিন্তি থাকতে আমারে লইব ক্যাডা?’ তারপরও তোরাব মিন্তি কাজ নেয়ার প্রস্তুতি নেয়।
শহীদুর জহির বর্ণনা দেয়ার বেলায় যে মুন্সীয়ানা দেখান, তার প্রমাণ মেলে; আমরা দেখি তোরাব সেখ আধভাঙা ঝাকার কিনারা লোহার গুনা দিয়ে পেঁচিয়ে বাধে। বর্ণনার এই যে উপকরণ একসঙ্গে জাপটে ধরে তোরাব সেখের জীবন পরিস্থিত।

তোরাব শেখের শরীরে শক্তি কম, কথা বলতে গেলে গলার রগ তখনও ফুলে ওঠে। তার ইচ্ছাবিরুদ্ধ কোনো কাজ হলে সে রাগ সংবরণ করতে পারে না, শব্দ সংবরণ করে নিজের ইচ্ছার কথা জানায়। কিন্তু গুরুত্ব নেই বুঝতে পারে। তোরাব পরিচিত বন্ধন ছেড়ে নিজস্ব শক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে হারিয়ে যায়।
এই তোরাব স্ত্রীকে মারে, কন্যার সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলে, পুত্রবধূকে গালি দেয়, ছেলের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডা করে আবার মেয়েকে যখন অলঙ্কার বানাতে দেখে প্রশ্ন করে– ‘চুরি করস নাই তো? চুরি করবি না।’  আমরা বুঝতে পারি তোরাব আর যাই হোক চোর না। কিন্তু তার কন্যা যে নিজের ভার নিতে শিখেছে, জীবন সঙ্গী নির্বাচন করতে শিখেছে, বসদের আচরণ যার মুখস্ত সে অবলীলায় বলে দেয়- ‘এমুন কতা হুনায়ো না তুমি, চুরি করে না কোন সাবে?’ আমরা তখন আরেক বাস্তবতার মধ্যে পতিত হই। আমাদের সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়েএই সমাজ থেকে একজন তোরাব বিদায় নেয় নীরবে, সেদিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ থাকে না। আপাত রুক্ষ মানুষটির জন্য কাঁদতে পারে এমন পাঠককে আহত করে শহীদুল জহির। তার ধারালো বর্ণনা দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে পরিণতির বিপরীত দিক।

তিন.
ডুমুরখেকো মানুষ। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, এটা একজন জাদুকর মোহাব্বত আলীর জীবন পাঠ। তারপর মনে হলো- আমি কি যার কথা ভাবছি সে কি আদৌ আছে, নাকি ‘ওয়েটিং ফর গডো’র মতো কিছু ঘটতে যাচ্ছে? আবার মনে হলো- এটা কি ‘প্যারাডাইস লস্ট’? আবার মনে হলো- এ কি আদম-হাওয়ার গল্প? সব সংশয় পাশ কাটিয়ে মনকে বলি, তুমি ‘উত্তর উপনিবেশী’ নিজ ভূমে ফেরো। দেখছো না, একজন জাদুকরকে ঘিরে আছে একদল মানুষ যাদের প্রশ্ন করে দ্বিধায় ফেলে দেয়া যায়।  জাদুকরের হাতে থাকা হাড্ডির নাম প্রীতিলতা। সে তার স্ত্রী। প্রীতিলতার সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয় এবং শেষে প্রীতিলতাকে দেখাবে বলে কথা দেয়। তারপর উপস্থিত মানুষদের ধাঁধায় ফেলে দেয়ার জন্য প্রশ্ন ছুড়ে দেয়- ‘হাড্ডিটা কি হাড্ডি নাকি প্রীতিলতা?’
প্রথমে যারা জানতে পেরেছিল এই হাড্ডি, পরবর্তীতে তারা জানতে পারে এটা প্রীতিলতা, তারপরও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। আবার সংশয়। তারা উত্তর পেতে চায়। নিজেরা ভুল বলে যদি তাই কিছু বলে না। এই সারির লোকরা যে এক শ্রেণির নয়, শহীদুল জহির সেটা বোঝাতে বর্ণনায় কিছু নাম হাজির করেন। আমরা দেখি- ইদ্রিস আলী, জ্যোতিভূষণ দাস, আবদুল জব্বার, শহীদুল হক, ইলিয়াস আহমেদকে।
লোকটি কথা বলতে থাকে এবং বলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত লোকটি ডুমুর বিক্রি করতে চায়। ডুমুর কোথায় কোথায় উৎপাদন হয়- ‘এই দ্যাশের বনে-জঙ্গলে হয়’। এই ফল বিক্রি করতে পারলে বিক্রেতার কাপড় কেনার পয়সা মিলে যায়, কেরোসিন কেনারও সমর্থ হয়।

ডুমুর বিক্রি করার জন্য মোহাব্বত আলী বিভিন্ন রকম ছাড়ের কথা বলে, বিনা পয়সার দিতে চায় একটি, হাফ ডজন কিনলে নিতে চায় দুই টাকা। সে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে, শিশু ও বয়স্ক। শিশুদের ফ্রি দেয়। তারা ডুমুর খেয়ে মুখ বিকৃত করে। বয়স্করা খেতে চায় না, একজন  সাহস করে মুখে নেয় তারপর সাবধানে চিবোতে থাকে। উপস্থিতজনেরা হাসতে থাকে, লুটোপুটি খায়। আপাতত, প্রথম ব্যক্তি আর অন্যরা দুই ভাগে বিভক্ত। যে কোন একজন জিততে পারবে। পার্থক্য হলো প্রথম লোকটি খেয়েছে অন্যরা খায়নি। প্রথম লোকটি যা বলছে তাই সত্য। সে বলে ওঠে ‘খুব ভালো’। এই দুটি শব্দ আমাদের সমাজ-ব্যক্তিজীবনে প্রতিষ্ঠিত অনেক সত্যর নিচে চাপা পড়ে যায়, পিষ্ট করে। তবুও বাঁচার চেষ্টা নেই।  কারণ, অন্যরাও সেই ভালোটাকেই স্বীকৃতি দেয়।  এই যে ভালো নামান্তরে ডুমুর ফল যারা কিনে নিয়েছিল, মোহাব্বত আলী তাদেরকে বলে, ‘তাদের উচিত আস্তে আস্তে এই ফল খাওয়া যাতে করে কিছু ডুমুর জীবনের শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে’। 

আরও অনেকের আগ্রহ জন্মায় তারা ডুমুর ফল কিনে নেয়। মোহাব্বত আলীর ডুমুরের দাম বাড়তে থাকে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ডুমুর খেকোরা এবার ডুমুর গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়। তারা মোহাব্বত আলীর খোঁজ করে, তার কেন্দ্র অর্থাৎ বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছায়। ডুমুরের গাছ না-পেয়ে তাকে খুন করে। পালিয়ে আসে। নিজেদের রক্তাক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করে। এই মানুষদের নিয়েই তৈরি হয় নানা জনের নানা গল্প। তাদের আনন্দ আর বেদনার গল্প বলে মানুষেরা। অথচ এই ডুমুর খেকোরা সেদিন অল্প সময়ের ব্যবধানে ভুলে গিয়েছিল, মোহাব্বত আলী কথা বলা শেষে প্রীতিলতাকে দেখাবেন। তাতেও তাদের গল্প থামে না, তাদের দ্বিমুখী গল্প আমরা শুনতে থাকি। শুনছি অনন্তকাল! নিজ ভূমির মাটির প্রলেপ, কেরোসিনের অনিবার্যতা, একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় হাড্ডির উপস্থিতিতে চিরন্তন এক সত্যর মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হন শহীদুল জহির।


লেখক: কবি

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়