ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিদেশে নজরুল-চর্চার যৎকিঞ্চিৎ || শরীফ আতিক-উজ-জামান

শরীফ আতিক-উজ-জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩৬, ২৫ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিদেশে নজরুল-চর্চার যৎকিঞ্চিৎ || শরীফ আতিক-উজ-জামান

২০০১ সালে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ড. ফিলিস হারমানের নেতৃত্বে ‘সাউথ এশিয়া ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা একটি অরাজনৈতিক, নির্দলীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চ যেখানে বিভিন্ন দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিনিময়ের লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু হয়। আন্তঃদেশীয় সংস্কৃতির মাঝে একটি যোগাযোগ স্থাপনের বিশেষ উদ্যোগও এই মঞ্চের ছিল, কারণ এখন বিশুদ্ধ ইংরেজি সাহিত্য বা শুধুমাত্র নিজদেশের সাহিত্য পড়েই সবকিছু জেনে যাওয়া সম্ভব নয়। তুলনামূলক সাহিত্য তাই সবদেশেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই বিনিময় তাই সময়ের দাবি। দক্ষিণ এশিয়ায় থেকে থেকে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তার গঠনমূলক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে তার স্বাতত্র্যমণ্ডিত ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্বরূপ জানা জরুরি। সেই উদ্দেশ্যেই ২০০২ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে বিষয় করে তরঙ্গ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনের সাফল্যই ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাটে উদ্যোক্তাদের নজরুল সম্মেলন আয়োজনে উদ্বুদ্ধ করে। সেখানে ড. হারমান নজরুলের ঐতিহ্য-চেতনার স্বরূপ অনুসন্ধানের মাধ্যমে একজন পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক মানুষকে তুলে আনেন। তার নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘রোমান্টিক নজরুল’।      

এই নিবন্ধে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন নজরুলের পৌরাণিক চেতনা। একজন ভারতীয় বংশোদ্ভুত মানুষ সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও কী গভীর অনুধ্যানে হিন্দু-পুরাণ আত্মস্থ করে নিজ সৃষ্টিতে স্থান দিয়েছেন। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে নজরুলের সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে তিনি অন্ধকারে ছিলেন। ভারতে পূজিত হন এমন অনেক দেবতা, যারা পৌরাণিক চরিত্র হলেও উনিশ ও বিশ শতকে জাতীয় আন্দোলনে প্রেরণা হতে পেরেছিলেন। নজরুল পাঠ শুরু করে তিনি দেখলেন মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তার রচনায় পৌরাণিক চরিত্রের সমাহার। এ প্রসঙ্গে আমার ভারতের পরলোকগত চিত্রশিল্পী ফিদা মকবুল হুসেনের কথা মনে পড়ছে। পৌরাণিক চরিত্র নিয়ে শিল্পকর্ম নির্মাণ করার অপরাধে যখন হিন্দু মৌলবাদিরা তার চিত্রকর্ম ভেঙে দিল তখন তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি ভারতীয়। আমার সম্প্রদায়গত পরিচয় কী তা মুখ্য নয়। ভারতের সকল ঐতিহ্যে আমার পূর্ণ অধিকার, হোক সে হিন্দু পুরাণ।’ একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে হুসেনই বলতে পারেন এমন কথা। একই কথা খাঁটে নজরুলের ক্ষেত্রে। তার জন্ম বর্ধমানে যা পশ্চিম বাংলায় অবস্থিত। সমৃদ্ধ হিন্দু ঐতিহ্যে তিনি অবগাহন করেছেন। একই সাথে তিনি লোকজ ঐতিহ্য, সুফিবাদ ও মুসলিম ঐতিহ্য ধারণ করেছেন। তিনি যে সাম্যের কথা বলেছেন সেখানে তার আকাঙ্ক্ষা ছিল হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান মিলবে মিলাবে সব কূপমণ্ডুকতা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে।

বাংলায় জন্মে ও বেড়ে উঠে তিনি হিন্দু-ঐতিহ্যের ভক্তিরসে আপ্লুত হয়েছিলেন বলে হারমানের মনে হয়েছে যা যথেষ্ট সত্য। তার বন্ধু বার্নাড কলেজের র‌্যাচেল ফিল ম্যাকডারমট দেবী উমা ও কালি নিয়ে একটি অনূদিত কবিতা সঙ্কলন প্রকাশ করেছেন যেখানে এদের সম্পর্কিত নজরুলের ১০টি কবিতা স্থান পেয়েছে। প্রতিটি কবিতায় নজরুলের রচনার ভিন্ন ভিন্ন শৈলী ও কাব্যিক ঘরানার খোঁজ পাওয়া যায়। তার কাছে খুব বিস্ময়ের মনে হয়েছে যে একজন মুসলিম কবি তার রচনায় ‘শাক্ত’ বা শক্তির দেবীর চিত্রকল্প বহুভাবে ব্যবহার করেছেন।

দক্ষিণ এশিয়ায় এই দেবীর অনেক রূপ আছে যার মধ্যে জনপ্রিয় রূপ হলো ‘কালি’ ও ‘উমা’ যারা উভয়েই শিবের স্ত্রী। কালি সবার কাছে পরিচিত ক্রুদ্ধ স্বভাবের দেবী হিসেবে যে হাতে খড়গ, গলায় মুণ্ডু মালা জড়িয়ে স্বামীর বুকের ওপর পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ধেক বেরিয়ে থাকা জিহ্বাটা রক্তে লাল। তার ভয়ালদর্শন রূপ সত্ত্বেও অনেক বাঙালি কবি তাকে চিত্রায়ন করেছেন স্নেহময়ী মাতা হিসেবে। যুগে যুগে তার প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দারুণ ভক্তি প্রকাশ করে আসছে। বিপরীতে উমা অনেক বেশি স্নিগ্ধ চেহারার দেবী তার পরিচয় অসুরমর্দিনীরূপে। উমার রূপটি একটু আলাদা। সে বছরে একবার তার পিতৃগৃহ থেকে স্বামী শিবের কাছে আসে। তবে যতটা সুশ্রী রূপের হিসেবে তাকে কল্পনা করা হোক না কেন সে অশুভ শক্তির বিনাশকল্পে ধরাধামে আসে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতে যে বাঙালি জাতীয়াতবাদী আন্দোলন শুরু হয় তখন বাঙালিরা তাদের মাতৃভূমিকে দেবীরূপে কল্পনা করে প্রেরণা খোঁজার চেষ্টা করেছে। ম্যাকডারমটের ভাষায়, তা বাঙালিদের মনে দেশপ্রেমের প্রেরণা জাগিয়ে তুলেছিল। এই সময়েই নজরুল এই দুই দেবী নিয়েই কবিতা ও গান লিখেছেন। কালি বা শ্যামাকে নিয়ে লিখিত তার শ্যামাসঙ্গীতের ভাণ্ডার অনেক বেশি সমৃদ্ধ। ম্যাকডারমটের মতে, নজরুল প্রথম দিককার ‘শাক্ত’ ঘরানার কবি। এই দেবীদের তিনি শুধু প্রতিবাদের প্রতীক রূপে নয়, বরং জাতপাতের ভেদনীতির বিরুদ্ধেও ব্যবহার করেছেন। ম্যাকডারমট লিখছেন: Nazrul Islam, writing in the early decades of the 20th century when success in the independence struggle was seen to be predicated upon Hindu-Muslim and intercuts unity, called upon the Goddess to return to India and Bengal both to crush the British and to help eradicate prejudice. (বিশ শতকের শুরুতে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের সফলতা নির্ভর করছিল হিন্দু-মুসলিম ও আন্তঃসম্প্রদায় সম্প্রীতির ওপর, নজরুল তখন ভারতে দেবী-আহ্বান জানাচ্ছেন ইংরেজদের বিতাড়িত করতে এবং সমস্ত কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করতে)।

হারমান বলছেন যে, নজরুল তার রচনায় যে হিন্দু পৌরাণিক চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন তা তাকে বিস্মিত করেছে। হিন্দু ঐতিহ্যের মাঝে যে সমস্ত শক্তির দেবী আছেন, আছেন মাতা, প্রেয়সীরূপী দেবী তাদের তিনি অতিসহজে ধারণ করতে পেরেছেন তার মানসিক উদারতায়। এখানেই তিনি অনেককে ছাড়িয়ে গেছেন। তার লেখনী ধর্মীয় সীমারখো অতিক্রম করে একটি জাতীয় সাংস্কৃতিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছে। হারমানের কাছে আরো মনে হয়েছে যে নজরুল ভারতের আরো বিস্তৃত ঐতিহ্য থেকে উঠে এসেছেন যিনি শুধু বাঙালি নয়, সব সম্প্রদায় সব জাতির মানুষকে একত্রিত করতে চেয়েছেন। হিন্দু পুরাণই নয় যিশু ও মাতা মেরির কথাও তার রচনায় উঠে এসেছে। তবে সবকিছুর মাঝে নজরুলের রোমান্টিক একটি ধাঁচ বিদ্যমান রয়েছে বলে তার কাছে মনে হয়েছে। হারমান নজরুলের অসাম্প্রদায়িক যে চরিত্র তুলে ধরেছেন তা নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। তার উপস্থাপিত প্রবন্ধে নজরুল একজন মুসলিম ও বাঙালি তাও উঠে এসেছে। এই দুই সত্তার কোনো বিরুদ্ধবাদিতা তার নজরে পড়েনি। তবে এরচেয়েও বড় কথা যা তা হলো তিনি সাম্যবাদি। ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান...’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মানুষ নজরুল বড় হয়ে উঠেছেন। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যসৃষ্টির প্রচেষ্টা এক ধরনের পরিচয়-সংকটে ভুগছিল। তারা নিজেরাই সে দ্বন্দ্ব নিরসনে সক্ষম হন নি। আরবীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নাকি বাঙালি ঐতিহ্য তাদের প্রকৃত পরিচয়- এ নিয়ে তারা দ্বন্দ্বে ছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই তাদের ভারতীয় বলে মানতে পারতেন না। বঙ্কিম চ্যাটার্জী আনন্দমঠে যেমন মুসলিম বর্জিত হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন, আবার ইসমাইল হোসনে সিরাজী হিন্দু দেব-দেবী-শাসকদের কঠোরভাষায় আক্রমণ করেছেন। এর মাঝে নজরুল ছিলেন আশ্চর্যরকমের ব্যতিক্রম। নজরুল মুসলমানদের সঙ্গীতে আকর্ষণ করার জন্য তার গানে হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের উদ্ধৃতি, আরবী-ফার্সি শব্দ ব্যবহার শুরু করলেন। তুর্কী জাতীয়তাবাদি নেতা কামাল আতাতুর্ককে নিয়ে কাব্য লিখলেন মুসলিমদের প্রগতিবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য। হারমান তার গবেষণায় আগামীতেও এইসব বিষয় তুলে আনবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।

বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী উপাচার্য এবং রাষ্ট্রবজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উইনস্টন ই ল্যাঙ্গলে ইংরেজি ভাষাভাষি মানুষের কাছে নজরুলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া জন্য Kazi Nazrul Islam: The Voice of Poetry and the Struggle for Human Wholeness শিরোনামে একটি বই রচনা করেন। ২০০৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়, দুই বছর পর বেরোয় দ্বিতীয় সংস্করণ। অনেকের মতো ল্যাঙ্গলেও বিশ্বাস করেন যে ইংরেজ কবি শেলীর দৃষ্টিভঙ্গি নজরুলের লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে।

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে The Nazrul-Burns Centre। এদের মূল উদ্দেশ্য হলো বহুমাত্রিক বৈশ্বিক সংস্কৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এগিয়ে নেওয়া এবং বিশ্ব্যবাপী তার প্রচার। এজন্য তারা স্কটিশ কবি রবার্ট বার্নস ও কাজী নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তাদের লেখনী নিয়ে গবেষণা করছেন। একদা এদেশের লেখকদের লেখনী অনুবাদ করে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত যে উদ্যোগ ছিল এখন তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে শুরু করেছে। জাপানের ড. কুয়েকার নিউয়া নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই সাথে নেদারল্যান্ডের লেখক-সাংবাদিক ড. পিটার কাস্টার্স, চিনের ইয়াং উইং মিং প্রমুখের নাম উল্লেখ করতে হয়। তবে নজরুলকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে মূল দায়িত্বটা আমাদেরই নিতে হবে। অন্যের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। আশার কথা সে বিষয়টি অনেকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, আর তাই নজরুলকে নিয়ে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় ICNAZRUL-এর উদ্যোগে যে সিম্পোজিয়াম হয়েছে সেখানে আমেরিকা, জাপান, তুরস্ক থেকে প্রাজ্ঞজনেরা এসেছেন। নজরুলের সৃষ্টিকর্মের অনুবাদ প্রকাশের মাধ্যমে তার রচনাকে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দিতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আরো ব্যাপকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সংকল্প ঘোষিত হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা এই সংকল্পের সাফল্য, তাতে নজরুল হয়ে উঠবেন আরো বৈশ্বিক এবং তার রচনা ছড়িয়ে পড়বে ভিন্নভাষি সাহিত্য পিপাসুদের মাঝে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়