ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

শিশু চিত্রকলার গুরুত্ব।। কামালুদ্দিন

কামালুদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ১৬ জুলাই ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিশু চিত্রকলার গুরুত্ব।।  কামালুদ্দিন

চারাগাছগুলোয় যখন আমরা জল দেই, পাতা-কান্ড পরিষ্কার করি, তখন খুব যত্ন নিয়ে, আলতো করে কাজটি করি যাতে আঘাত না লাগে। ফুলের কুঁড়িগুলো এমনভাবে স্পর্শ করি যেন একটি পাপড়িও ঘুম থেকে জেগে না ওঠে আকস্মিক ভয়ে! আমরা সবাই জানি, যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে বীজের অঙ্কুরোদ্‌গম ঘটাতে হয়। অঙ্কুরোদ্‌গমের পর যখন চারাগাছে পরিণত হয়, তখন তার পরিচর্যা আরো বাড়িয়ে দিতে হয়। কারণ সেই চারাগাছটিই একদিন সাবালক হবে, পরিণত হবে মহীরূহে। ঠিক তেমনই সব শিশুই স্পর্শকাতর। সব শিশুরই পরিচর্যা করতে হয় চারাগাছের মতো। শিশুরা স্বর্গের ফুল। তারা এই পৃথিবীকে সুবাসিত করার জন্য নেমে আসে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে। তারা বর্তমানকে সুন্দর করে তোলে। উপহার দেয় স্বপ্নিল ভবিষ্যৎ।

আমাদের এই ক্ষুদে স্বচ্ছ, স্বতঃস্ফূর্ত শিশুদের নিষ্ঠার সঙ্গে পরিচর্যা করা দরকার। তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি শক্ত সামর্থ হওয়া অবধি পরিচর্যা চালিয়ে যেতে হয়। মানব শিশুর শৈশবের নির্মাতা হচ্ছে অভিভাবক বা শিক্ষক। কাদামাটির মতো এই শিশুদের যেমন ইচ্ছে গড়ে নেয়া যায়। আমরা যেমন চাইবো তারা তেমনই হয়ে উঠবে; আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে রূপদান করবে। তাই বলে ভুল রূপদান যেন না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। যেমন কবি কাহলিল জিবরান একবার এক নারীর কোলে শিশু দেখে ওই নারীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমরা তোমাদের ভালোবাসা তাদের দিতে পারো কিন্তু চিন্তা ভাবনা নয়, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তাভাবনা আছে। তাদের দেহ ধারণ করতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মা নয়। কারণ তাদের আত্মা বাস করে আগামীকালের গৃহে, সেখানে তোমরা যেতে পারো না, তোমাদের স্বপ্নেও না।’

সত্যিকারার্থে এই কোমল শিশুদের তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তি করে সনাতনী প্রথায় অযাচিত কিছু চাপিয়ে দিলে তাতে তাদের স্বপ্নগুলো জীর্ণকায় হয়ে যায়। আর যেসব তথাকথিত অভিভাবক এসব চাপিয়ে দিচ্ছেন তারা কতটুকু সচেতন, দায়িত্বশীল সেটাও দেখার বিষয়। অভিভাবকের চিন্তা ও শিক্ষার মান যদি হয় নেহায়েত সংস্কারাবদ্ধ আর পশ্চাৎপদ তাহলে তো কথাই নেই। শিশুর বিকাশের শুরুতেই লেগে যাবে গণ্ডগোল। তাতে তার গোড়া মাটির নিচে চাপা থাকবে আজীবন আর পৃথিবী নামক গ্রহের সাক্ষাৎ মিলবে না কখনোই।

আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ শতাংশ অভিভাবক কখনো তাদের সন্তানকে জিজ্ঞেস করেন না, তোমার কী হওয়ার স্বপ্ন আছে, ভবিষ্যতে তুমি কি হতে চাও? না। তাদের আবার স্বপ্ন কি! আমার এই অর্বাচীন সন্তান আমি যা হতে পারিনি সেটাই হবে। ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। কর্পোরেট বড় কর্তা হবে। কারণ এগুলো সম্ভবত সামাজিক মর্যাদা তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সবাই হতে চাইতো ব্যারিস্টার, দারোগা। আমরা ভুলে যাই, পৃথিবীতে সবাই সব কিছুর জন্য জন্মায় না। সবাই একদিকে গেলে পৃথিবী ভারসাম্য হারাবে। সুতরাং অভিভাবকদের বোধগুলোকে শান দিতে হবে। না হয় আপনার সন্তান সারাজীবন শিশু থেকে যাবে, মানুষ আর হবে না। মনে রাখা উচিৎ, মানুষের বর্ণাঢ্য জীবনে সবচেয়ে কম স্থায়ী থাকে শৈশবকাল। অথচ এ শৈশবই প্রতিটি মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই আমরা শিশুদের দেব এমন এক উদার শৈশব যা নিরবচ্ছিন্ন আনন্দে ভরপুর থাকবে। সেইসঙ্গে খুঁজে পাবে  ভবিষ্যতের রাস্তা।

উল্লেখ্য চারুকলা, কারুকলা, সঙ্গীত, নৃত্য, লেখালেখি, বিজ্ঞান চর্চা ইত্যাদি শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর মধ্য দিয়ে শিশুর মধ্যকার সুপ্ত সত্তা জাগরিত করতে হবে। এসব সৃষ্টিশীল শিক্ষায় শিশুর শারীরিক এবং মানসিক দুটোরই বিকাশ ঘটবে। সেইসঙ্গে খেলাধুলায়ও শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে, মনোবিদগণের মতে খেলাধুলা হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত একটা সৃজনশীল উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়া। উন্নতবিশ্বে জীবনের প্রথম ছয়টি বৎসর কাটে এসবের ভিতর দিয়ে। তাদের অজ্ঞাতে তারা বিস্তর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, সেসব অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হবার পর তারা কিন্ডারগার্টেনে যায়। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটা গ্রহণ করতে হয় এভাবে পরিবার, পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রকৃতি থেকে। এসব অধ্যায়কে নিবিড়ভাবে জানতে বা পরখ করতে সব থেকে বেশি সহায়তা করে ছবি আঁকা। মানুষ তার চৈতন্যের ঊষাকাল থেকেই বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে যেসব মাধ্যমে তার সম্পর্ক তৈরি করেছিল, ছবি আাঁকা তার মধ্যে প্রধানতম। তাই শিশুরাও তাদের চৈতন্যের ঊষাকালে ছবি আঁকতে পছন্দ করে। শিশুরা বারো থেকে আঠারো মাস বয়স থেকে পেন্সিল বা প্যাস্টেল দিয়ে অসংখ্য হিজিবিজি লাইন দিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করে। শিক্ষাব্রতী জ্যা জ্যাক রুশো এ কারণেই বলেন: ‘প্রত্যেক শিশুই জন্মগতভাবে শিল্পী।’

তাদের ছবি হচ্ছে সৃজনাত্মক, বাস্তবধর্মী নয়। ছবি এঁকে তারা নিজেদের আবিষ্কার  করে নানাভাবে। যেমন কল্পনার রঙের প্লেট আর বাস্তবের রঙের প্লেট এক করে ফেলে, কারণ শিশুরা কল্পনা আর বাস্তবের পার্থক্য বুঝে উঠতে পারে না। তাদের তুলি থেকে রঙ ঝরে পড়েই সাদা কাগজের উপর বিম্বিত হয় তাদের না-বলা কথা;  না-দেখা স্বপ্ন, মান-অভিমান, চেনা-অচেনা জীবনের নানা অনুষঙ্গ। এক রঙের সঙ্গে অন্য রঙের সন্ধি ঘটিয়েই আগামী দিনের স্বপ্নগুলোকে গেঁথে ফেলে মনের অজান্তে।

সাদা পাতায় লীলাক কাজীর রঙিন ছবি আঁকার চেষ্টা

শিশুরা আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। এই অনেকগুলো ভবিষ্যৎ মিলে পৃথিবী নামক এত বড় ক্যানভাসকে রাঙিয়ে দেবে নানা রঙের স্বপ্ন দিয়ে। এই নিষ্পাপ শিশুর আকাশ, বাতাস, মাটি, গাছ, ফুল, পশু-পাখি, মানুষ, নদী সবখানেই রঙধনুর সব রঙ গড়িয়ে আসে। তাদের আকাশ থাকে নানা রঙের পাখিতে মুখরিত। তাদের ফসলের মাঠে বাম্পার ফলন। তাদের নদীতে মাছের উপচে পড়া ভিড়। তাদের মানুষের মুখে রঙের প্রাচুর্য ঢের বেশি। কী অদ্ভুত রকম সৃষ্টি সুখের উল্লাস তাদের মানসপটে! শিশুদের চিত্রের ভাষা খুবই সহজ-সরল, কারণ তাদের জটিলতার অভিজ্ঞতা নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে: ‘বাল্যকাল থেকে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনমতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু বিকাশ লাভ হয় না।’ 

তাই বলছি, যেসব শিক্ষার্থীকে শুধুই পুঁথিগত গ্রন্থকীট হিসেবে তৈরি করা হয় বা কলের প্রণালী আঁকড়ে ধরে বসিয়ে রাখা হয় তাদের দ্বারা আর যাই হোক মননের চর্চা হবে না।

একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, শিশুরা স্কুলে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী থাকে ছবি আঁকার ক্লাসে। কারণ সৃষ্টিশীল কাজ শিশুদের ভীষণ আনন্দ দেয়। তারা ছবিতে নিজের জগত খুঁজে পায়। একমাত্র ছবি আঁকার ক্লাসে তারা স্বাধীনতা এবং স্বস্তি পায়। একঘেঁয়ে মুখস্থযন্ত্র হওয়া থেকে কিছুটা বিরত থাকতে পারে। আমরা সকলে অবগত যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প সাহিত্যের সমঝদার ছিলেন। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও কবি জসিমউদ্‌দিনকে অনেক সম্মান করতেন। শিশুদের অত্যধিক ভালোবাসতেন। শিশুদের সান্নিধ্য পেতে চাইতেন সবসময়। তাই তাঁর জন্মদিনে বাংলাদেশে শিশু দিবস পালিত হয়। আর সেই শিশু দিবসে সারাদেশে শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়। শিশুরা সেখানে ছবি আঁকে। এমনকি তিনি যখন রাষ্ট্রীয় সফরে যান সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন তিনি উপহার হিসেবে নিয়ে যান এদেশের শিশুদের আঁকা তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের ছবি, সোনার বাংলার ছবি। অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়করা সেসব ছবি পেয়ে উচ্চকিত প্রশংসা করেন। তাহলে বুঝতে হবে আমাদের শিশুরা মেধা মননে কতটা উজ্বীবিত। পক্ষান্তরে খুব দুঃখের সাথে বলতে হয়, শিশুকে জানবার বা আবিষ্কার করবার জন্য যে বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনা দরকার সেটা আমাদের দেশে নেই। শিশুর মনোজগতে প্রবেশের কৌশল আমরা জানি না। বর্তমানে আমাদের দেশে স্কুলে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সমাজবিজ্ঞান, ধর্ম এসব বিষয়ে যদি সৃজনশীল প্রশ্ন করা হয়, তাহলে চারুকলা বিষয়টি কি? কারো ক্ষীণ পরামর্শে এই বিষয়টি সরকারিভাবে বাদ বা নম্বরশূন্য করে দেয়ার অর্থ কী? তাহলে চারুকলা সৃজনশীল নয়? যেটা শতভাগ সৃজনশীল সেটাকেই চরম অবজ্ঞা করা হচ্ছে কেন? আমরা সৃজনশীল বা সুকুমারবৃত্তি বলতে তাহলে কী বুঝি?

এখন অনেকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে, শিশুরা ছবি আঁকলে কী উপকার হয়? নিশ্চয় উপকার হয়। নিম্নলিখিত লাইনগুলি হচ্ছে একটি শিশুর গড়ে ওঠার বুনিয়াদ। যেসব শিশু ছবি আঁকে তাদের- ১. পরিমিতিবোধ বাড়ে ২. রুচিবোধ বা নান্দনিক বোধ তৈরী হয় ৩. সৌন্দর্যবোধ বাড়ে ৪. চোখ ও মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র কার্যকর ও শক্তিশালী হয় ৫. চিন্তার আত্মপ্রকাশ ঘটে সেই সাথে আত্মশক্তি প্রতিষ্ঠা হয় ৬. নিয়মশৃঙ্খলা শেখে ৭. পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে ৮. কল্পনাশক্তির প্রসার ঘটে ৯. মানবিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে ১০. জীবন উপলব্ধি বাড়ে ১১. দেশপ্রেম জাগ্রত হয় ১২. সময়জ্ঞান বাড়ে ১৩. অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হয় ১৪. ‘থ্রি-আর’ (three -R ) অর্থাৎ পড়া, লেখা ও গণিত শেখার ব্যাপারে বেশ পারদর্শী হয় ১৫. চেতনাবোধ জাগ্রত হয় ১৬. একাকিত্ব ভুলে যায় ১৭. প্রাণচঞ্চল্য বাড়ে।

সুতরাং আমরা চাইবো আমাদের ফুটফুটে শিশুরা যেন উল্লেখিত মর্মবাণীগুলো ধারণ করতে পারে। একটি জাতি বা সমাজ বিকশিত করতে গেলে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। না হয় অশান্তির কালো ছায়া বা অপশক্তির ভীত জমাট বাঁধবে। জগতখ্যাত শিল্পী এসএম সুলতান বলেছেন, ‘যে শিশু একবার তুলি ধরে সে শিশু কখনো অস্ত্র ধরতে পারে না।’ সত্যিকারার্থে শিল্প-সংস্কৃতি না থাকলে মানুষের আশার মৃত্যু ঘটে। তাই আমাদের শিশুরা যেন সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শিল্প শিক্ষায়ও মনোনিবেশ করে নিজেকে উন্নত, মননশীল, রুচিশীল আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে সে বাস্তব পরিবেশ তৈরি করতে হবে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে। সে পরিবেশ গড়ে দিতে পারলে তারা পেশাদার শিল্পী না হলেও যেকোনো পেশায় গিয়ে নিজগুণে একটি ছবির মতো চমকপ্রদ, স্বপ্নীল, শিল্পিত সুসভ্য জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবে। সেজন্য আমাদের দরকার শিশু প্রতিপালনে সচেষ্ট হয়ে তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে তরান্বিত করা। তাই বলছি, একটি সমৃদ্ধ দেশ গঠনের জন্য সৃজনশীল মানুষের অসাধারণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিল্প-শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়ার কারণেই উন্নত বিশ্বের সর্বত্র নান্দনিক মূল্যবোধের পরিচয় মেলে। একটি সুন্দর দেশ দেখলে মনে হয় শিল্পী সব জায়গায় তুলি চালিয়েছেন প্রসন্ন মনে। আসুন আমরাও আমাদের দেশটি মননশীল, শিল্পীত ও সুন্দর মানুষে ভরে তুলি।

লেখক: প্রভাষক, চারুকলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জুলাই ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়